১৮. ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সেনরাষ্ট্র

ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সেনরাষ্ট্র

রাষ্ট্রে এই একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন সুস্পষ্ট। তাহা না হইবারও কারণ নাই, কারণ ভবদেবের বংশ, হলায়ূধের বংশ, অনিরুদ্ধ ইঁহারা তো সকলেই রাষ্ট্রেরই সৃষ্টি এবং সে রাষ্ট্রের নায়ক হরিবর্মণ, সামল (শ্যামল) বর্মণ, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন। শেষোক্ত দুইজন তো নিজেরাই ভাবাদর্শে সমাজাদর্শে অনিরুদ্ধ-হলায়ূধের সমগোত্রীয, নিজেরাই স্মৃতিশাসনের রচয়িতা। তাহা ছাড়া, শান্ত্যাগারিক, শান্ত্যাগারিধিকৃত, শান্তিবারিক, পুরোহিত, মহাপুরোহিত, ব্রাহ্মণ-রাজপণ্ডিত, ইঁহারা রাজপুরুষ হিসাবে স্বীকৃত হইতেছেন এই যুগেই—কম্বোজ-বর্মণ-সেন রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রে ইঁহাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িতেছে, ইঁহারা রাষ্ট্রের অজস্র কৃপালাভ করিতেছেন, নানা উপলক্ষ্যে অপরিমিত ভূমিদান ইঁহারাই লাভ করিতেছেন। কাজেই রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন দেখা যাইবে, ইহা তো বিচিত্র নয়।

বিজয়সেন ও বল্লালসেন উভয়েই ছিলেন পরম মাহেশ্বর অর্থাৎ শৈব; লক্ষ্মণসেন কিন্তু পরম বৈষ্ণব এবং পরম নারসিংহ (অর্থাৎ বৈষ্ণব); লক্ষ্মণসেনের দুই পুত্র বিশ্বরূপ ও কেশব উভয়েই সৌর অর্থাৎ সূর্যভক্ত। সেন-বংশের আদিপুরুষ সামন্তসেন শেষ বয়সে গঙ্গাতীরস্থ আশ্রমে বানপ্রস্থে কাটাইয়া ছিলেন; এইসব আশ্রম-তপোবন ঋষিসন্ন্যাসী দ্বারা অধ্যুষিত এবং যজ্ঞাগ্নিসেবিতঘৃতধূমের সুগন্ধে পরিপূরিত থাকিত; সেখানে মৃগশিশুরা তপোবন-নারীদের স্তন্যদুগ্ধ পান করিত এবং শুকপাখীরা সমস্ত বেদ আবৃত্তি করিত! কবিকল্পনা সন্দেহ নাই, কিন্তু বস্তুসম্পর্কবিহীন কবি-কল্পনাও রাষ্ট্রের সমাজাদর্শকেই ব্যক্ত করিতেছে এবং প্রাচীন তপোবনাদর্শের দিকে সমাজের মনকে প্রলুব্ধ করিবার, সেই স্মৃতি জাগাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছে, সে-বিষয়েও সন্দেহ নাই। সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের উপর এত রূপ বর্ষণ করিয়াছিলেন এবং সেই কৃপায় তাঁহারা এত ধনের অধিকারী হইযাছিলেন যে, তাহাদের পত্নীদিগকে নাগরিক রমণীরা মুক্তা, মরকত, মণি, রৌপ্য, রত্ন এবং কাঞ্চনের সঙ্গে কার্পাস বীজ, শাকপত্র, অলাবুপুষ্প, দাড়িম্ববীচি এবং কুষ্মাণ্ডলতপুষ্পের পার্থক্য শিক্ষা দিত। যজ্ঞকার্যে বিজয়সেনের কখনও কোনও ক্লান্তি ছিল না। একবার তাঁহার মহিষী মহাদেবী বিলাসদেবী চন্দ্র গ্রহণের সময়ে কনক-তুলাপুরুষ অনুষ্ঠানের হোমকার্যের দক্ষিণাস্বরূপ রত্নাকর দেবশর্মার প্রপৌত্র, রহস্কর দেবশর্মার পৌত্র, ভাস্কর দেবশর্মার পুত্র, মধ্যদেশাগত, বৎসগোত্রীয়, ভাগব-চ্যবনআপ্লুবান-ঔর্ব-জামদগ্ন্য প্রবর, ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন শাখার ষড়ঙ্গধ্যায়ী ব্রাহ্মণ উদয়কর দেবশর্মাকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। বল্লালসেনের নৈহাটিলিপি আরম্ভ হইয়াছে অৰ্দ্ধনারীশ্বরকে বন্দনা করিয়া; তাঁহার মাতা বিলাসদেবী একবার সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে গঙ্গাতীরে হেমাশ্বমহাদান অনুষ্ঠানের দক্ষিণাস্বরূপ ভরদ্বাজ গোত্রীয়, ভরদ্বাজআঙ্গিরস-বার্হস্পত্য প্রবর, সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী ব্রাহ্মণ  শ্রীওবাসুদেবশর্মাকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। বল্লালসেন এই লিপি দ্বারা এই দান অনুমোদিত ও পট্টিকুত করেন। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া লিপির ভূমিদানগ্রহীতা হইতেছেন কৌশিক গোত্রীয়, বিশ্বামিত্র-বন্ধুল-কৌশিক প্রবর, যজুর্বেদীয় কান্বশাখাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রঘুদেব শর্মণ। লক্ষ্মণসেন যে অসংখ্য ব্রাহ্মণকে ধান্যশস্যপ্রসূ উপবনসমৃদ্ধ বহু গ্রামদান করিয়াছিলেন তাহাও এই লিপিতে উল্লিখিত আছে। এই রাজার গোবিন্দপুর পট্টোলির ভূমিদান গ্রহীতাও একজন ব্রাহ্মণ, উপাধ্যায় ব্যাসদেব শর্মণ—বৎসগোত্রীয় এবং সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী। এই ্ভূমিদান কার্য প্রথম করা হইয়াছিল লক্ষ্মণসেনের অভিষেক উপলক্ষে। সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী, ভরদ্বাজ গোত্রীয় আর এক ব্রাহ্মণ ঈশ্বরদেবশর্মণও কিছু ভূমিদান লাভ করিয়াছিলেন রাজা কর্তৃক হেমাশ্বরথমহাদান যজ্ঞাতুষ্ঠানে আচার্যক্রিয়ার দক্ষিণাস্বরূপ। এই ভূমির সীমানির্দেশ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে, পূর্বদিকে বৌদ্ধ বিহারদেবতার এক আঢ়বাপ নিষ্কর ভূমির পূর্ব সীমা আলি (বৌদ্ধবিহারী দেবতা নিকরদেয়ম্‌ মালভূম্যাটাবাপ-পূর্বালিঃ)। সেন বংশের লিপিমালার মধ্যে এই একটি মাত্র স্থানে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ পাওয়া গেল; বরেন্দ্রীতে তাহা হইলে দ্বাদশ শতকের শেষপাদেও বৌদ্ধধৰ্ম্মের প্রকাশ্য অস্তিত্ব ছিল। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর লিপি সর্বত্র সুম্পষ্ট ও সুপাঠ্য নয়; মনে হয় রাজা তাহার মূল অভিষেকের সময় ঐন্দ্ৰীমহাশান্তি যজ্ঞানুষ্ঠান উপলক্ষে কৌশিকগোত্রীয়, অথর্ববেদীয় পৈপ্পলাদশাখাধ্যায়ী শান্ত্যাগারিক ব্রাহ্মণ গোবিন্দ দেবশর্মণকে যে ভূমিদান করিয়াছিলেন তাহাই এই শাসন দ্বারা অনুমোদিত ও পট্টিকৃত করা হইয়াছে। আর একবার এই রাজাই সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে জনৈক কুবের নামীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। এই রাজার সুন্দরবন লিপিতেও কয়েকজন শান্ত্যাগারিক ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের খবর পাওয়া যায়, যথা, প্রভাস, রামদেব, বিষ্ণুপাণি গড়োলী, কেশব গড়োলি এবং কৃষ্ণধর দেবশর্মা; ইঁহারা প্রত্যেকেই শান্ত্যাগারিক। শেষোক্তটি গার্গগোত্রীয় এবং ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়নশাখাধ্যায়ী। লক্ষ্মণসেনের পুত্র কেশবসেন ধান্য শস্যক্ষেত্র ও অট্টালিকা পূর্ণ বহু প্রসিদ্ধ গ্রাম ব্রাহ্মণদের দান করিয়াছিলেন। তদনুষ্ঠিত যজ্ঞাগ্নির ধূম চারিদিকে এমন বিকীর্ণ হইত যেন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া যাইত। তিনি একবার তাঁহার জন্মদিনে দীর্ঘজীবন কামনা করিয়া একটি গ্রাম বাৎস্যাগোত্রীয় নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ ঈশ্বরদেবশর্মণকে দান করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনের আর এক পুত্র বিশ্বরূপসেন শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফললাভের আকাঙ্ক্ষায় বাৎস্যগোত্রীয় নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ বিশ্বরূপ দেবশমর্শকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। এই রাজারই অন্য আর একটি লিপিতে দেখিতেছি হলায়ূধ নামে বাৎস্যগোত্রীয় যজুর্বেদীয়, কান্বশাখাধ্যায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ আবল্লিক পণ্ডিত রাজপরিবারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীদের নিকট হইতে প্রচুর ভূমিদান লাভ করিতেছেন— উত্তরায়ণ-সংক্রান্তি, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থানদ্বাদশীতিথি, জন্মতিথি ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে।

ত্রিপুরা-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেববংশের লিপিগুলিতেও অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। এই রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী এবং বিষ্ণুভক্ত। এই বংশের অন্যতম রাজা দামোদর একবার জনৈক যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ পৃথ্বীধরশর্মণকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। বোধ হয়, এই বংশেরই আর একজন রাজা, অরিরাজ দনুজমাধব শ্ৰীদশরথদেবের (= কুলজী গ্রন্থের দনুজমাধব = মুসলমান ঐতিহাসিকদের সোনারগাঁর রাজা, দনুজ রায়) আদাবাড়ী লিপি দ্বারা যে সমস্ত ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করা হইয়াছে তাহাদের গাঞী পরিচয় আছে; যথা, সন্ধ্যাকর, শ্রীমাক্রি (দিণ্ডী গাঞী), শ্রীশক্র, শ্রীসুগন্ধ (পালি গাঞী), শ্ৰীসোম (সিউ গাঞী), শ্ৰীবাদ্য (পালি গাঞী) শ্ৰীপণ্ডিত (মাসচটক গাঞী), শ্ৰীমাণ্ডী (মূল গাঞী), শ্রীরাম (দিণ্ডী গাঞী), শ্ৰীলেঘু (সেহন্দায়ী গাঞী), শ্ৰীদক্ষ (পুতি গাঞী), শ্ৰীভট্ট (সেউ-গাঞী,), শ্রীবালি (মহান্তিযাড়া গাঞী), শ্ৰীবাসুদেব (করঞ্জ গ্রামী), এবং শ্রীমিকো (মাসচড়ক গাঞী), ইত্যাদি। গাঞীপ্রথার প্রচলন ভবদেবভট্টের কালেই আমরা দেখিয়াছি; বোধ হয় তাহারও বহু পূর্বে গুপ্ত আমলেই এই প্রথা প্রবর্তিত হইয়া থাকিবে (গুপ্ত আমলের লিপিগুলিতে ভট্ট, বন্দ, চট্ট, প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য পদবী-পরিচয গাঞী-পরিচয় হওয়াই সম্ভব)। ত্রয়োদশ শতকে এই প্রথা একেবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। আদাবাড়ী লিপির গাঞী তালিকায় রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র উভয গাঞী পরিচয়ই মিলিতেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *