১৪. হিন্দুমন্দিরে মিথুনমূর্তি

হিন্দুমন্দিরে মিথুনমূর্তি

ভারতের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরগাত্রে কামকলার অনেক নিদর্শন আছে । বহু স্থানে ( যেমন ভুবনেশ্বরের রাজারাণী মন্দিরে) এমন অনেক দুঃসাহসিক ধরণের রমণমূর্তি আছে, যেগুলো দেখলে মনে হবে যে প্ৰাচীনকালের হিন্দুরা মৈথুনক্রিয়ার কৌশলে বিশেষ রকমের acrobats ছিলেন । মৈথুনক্রিয়ার এসকল পদ্ধতি বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’-এও বর্ণিত হয়েছে । সুতরাং এগুলো কামকলার যে অসম্ভব বা অবাস্তব পদ্ধতি তা নয় ।

মন্দিরগাত্রে এরূপ খোদিত কামকলার প্রদর্শনে রত নরনারীর মূর্তির কথা উঠলেই আমরা কোনারক, পুরী, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো প্রভৃতি স্থানের মন্দিরের উল্লেখ করে থাকি । কিন্তু এই শ্রেণীর ভাস্কর্যের সংস্থান এত সঙ্কীর্ণ ভৌগলিক গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । এরকম মূর্তি মহারাষ্ট্রের ইলোরার শৈলমন্দিরে, মহীশূরের হলেবিদে অবস্থিত হরশৈলেশ্বরের মন্দিরে, পশ্চিম, মধ্য ও প্রাচ্য ভারতের বহু স্থানের মন্দিরে লক্ষ্য করা যায় । ১৯২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপর অবস্থিত এক নেপালী মন্দিরেও আমি এরূপ ভাস্কৰ্য লক্ষ্য করেছিলাম। বাঙলার মন্দিরের পোড়ামাটির অলংকরণেও এর নিদর্শনের প্রতুলতা কম নয়। এক হাওড়া জেলারই দশটা মন্দিরে মৈথুন অলংকরণ আছে। চব্বিশ পরগণারও অনেকগুলি মন্দিরে আছে। বস্তুতঃ বাঙলার মন্দিরে মিথন দৃশ্যের অলংকরণ অতি প্রাচীন । পাহাড়পুরে অবস্থিত পালযুগের মন্দিরসমূহের মিথবুনমূতিগুলি দেখলেই এটা বুঝতে পারা যায় ।

।। দুই ।।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে দেবতার মন্দিরে মিথন দৃশ্যের বিদ্যমানতার কারণ কি ? এটা বিংশশতাব্দীর শেষপাদের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আমরা বুঝতে পারব না। আপাতদৃষ্টিতে মূর্তি বা দৃশ্যগুলির মধ্যে আমরা অশ্লীলতারই গন্ধ পাব ; কিন্তু ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে। পরবর্তীকালের সাহিত্য পড়লে আমরা বুঝতে পারব যে হিন্দুর কাছে সৃষ্টিই ছিল সবচেয়ে বড় ধর্ম । যে কর্মের মাধ্যমে যে ধর্ম পালিত হত, মিথন মূর্তিগুলি তারই সজীব প্রতীক মাত্র। প্রজাপতি ব্ৰহ্মাই প্ৰথম প্রজা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অন্তরের মধ্যেই ছিল সৃজন শক্তির উৎস। সেজন্যই তিনি দ্বিধাগ্ৰস্থ হয়ে গিয়েছিলেন সেই সুপ্ত শক্তিকে সঙ্গিনী হিসাবে পাবার জন্য। এক কথায় পুরুষ প্ৰকৃতির সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন। ইহজগতে নারী ও পুরুষের মিলন, সেই বৃহত্তম মিলনেরই প্রতীক। এই মিলনের মধ্যেই আছে সৃষ্টি, কামনার নিবৃত্তি ও সুখ দুঃখের বন্ধন থেকে মুক্তি । ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১।৪।৪-৮) ।

।। তিন ।।

যৌন মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকে সংরক্ষিত করবার জন্য আমরা ঋগ্বেদের ঋষিদের পরম ব্যাকুলতা লক্ষ্য করি। এই মিলনে যারা ব্যাঘাত ঘটায় তাদের বিনাশ সম্বন্ধে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৬২ সূক্তে বলা হয়েছে—“যে তোমার যোনি আক্রমণ করে, অগ্নি তাকে বিনাশ করুন। পুরুষের শুক্র সঞ্চারকালেই হােক অথবা গৰ্ভমধ্যে আন্দোলিত হবার কালেই হােক অথবা ভূমিষ্ঠ হবার সময় হােক, তোমার গর্ভকে যে নষ্ট করে বা নষ্ট করতে ইচ্ছা করে, তাকে আমরা এখান হতে দূরীভূত করলাম। গর্ভ নষ্ট করবার জন্য যে তোমার দুই উরু বিশ্লেষিত করে দেয়, অথবা যে ওই উদ্দেশ্যে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যস্থলে শয়ন করে অথবা যে যোনির মধ্যে বিপতিক পুরুষ শুক্ৰকে লেহন করে, তাকে এখান হতে দূরীভূত করলাম।” ( ঋগ্বেদ ১।১৬২৷১-৬ )।

বিংশ শতাব্দীর উন্নত নাসিকা বিশিষ্ট মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে যারা কপটভানের সঙ্গে মন্দির গাত্রের মিথন মূর্তি বা দৃশ্যগুলিকে অশ্লীল বলে ঘোষণা করেন, তাদের মনে রাখা উচিৎ যে তাদের পিতামাতার এই অশ্লীল কৰ্মদ্বারাই তারা ইহজগতের মুখ দেখতে পেয়েছেন । হিন্দুর সবচেয়ে প্রাচীন গ্ৰন্থ ঋগ্বেদে এ সম্বন্ধে কোন কপটতার ভান নেই। প্ৰথম মণ্ডলের ১৬৪ সূক্তে বলা হয়েছে–‘মাতা পৃথিবী বৃষ্টির জন্য পিতা দ্যুলোককে কৰ্মদ্বারা ভজনা করেন । তার পূর্বেই পিতা মনে মনে এর সাথে সঙ্গত হয়েছিলেন এবং বিবিধ শস্য উৎপাদন হেতু পরস্পর পরস্পরের কথাবার্তা বলেছিলেন । (ঋগ্বেদ ১।১৬৪।৮) । বস্তুতঃ মৈথুন ক্রিয়াটা হিন্দুদের ধর্মচিন্তায় biology-র এক পরম সত্যের অভিব্যক্তি । সেজন্য প্ৰাচীন ঋষিরা কথায় কথায় মৈথুনক্রিয়ার কথা বলতে লজ্জা বা সঙ্কোচ বোধ করতেন না । যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদে অরণীর সাহায্যে অগ্নি উৎপাদন মিথুন ক্রিয়ার সঙ্গে তুলিত হয়েছে। (৬।৪।২২) । বস্তুতঃ দেবায়তনে মিথুন মূর্তি প্ৰদৰ্শন যদি অশ্লীল ব্যাপার হয়, তা হলে তার চেয়ে কতগুণ অশ্লীল ছিল অশ্বমেধ যজ্ঞে সর্বসমক্ষে প্ৰধান রাজমহিষীর অশ্বের সঙ্গে মৈথােন ক্রিয়ায় রত হওয়া বা প্ৰধান পুরোহিতের সঙ্গে সঙ্গত হওয়া ?

।। চার ।।

খুব যুক্তিযুক্ত কারণে অনেকে অনুমান করেছেন যে মন্দির গাত্রের এই সকল মিথন মূর্তির সঙ্গে তান্ত্রিক ধর্মের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা প্রভাব ছিল। সকলেরই জানা আছে যে নারী সঙ্গমই তান্ত্রিক সাধনার ভিত্তি । বস্তুতঃ তন্ত্রগ্রন্থসমূহে বলা হয়েছে যে মৈথন ছাড়া কুলপূজা হয় না । তান্ত্রিক সাধনায় মৈথুন কামমাৰ্গ নয়, জ্ঞানমােগ । তন্ত্ৰমতে নারীর দুই স্বরূপ কামিনী ও জননী–একই। গোড়াতে প্ৰকৃতি কামিনী, সৃষ্টিতে সম্ভোগার্থে তার সার্থকতা । তারপর যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, সেই সৃষ্ট জীবের অসহায় ও দুর্বল অবস্থায় তার লালন পালন ও বৃদ্ধির জন্যই তো জননী ভাব ! তান্ত্রিক সাধনায় রাত্রিকালে সাধক ‘আমি শিব’” ( ‘ধ্যাত্বা শিবোহমত্তি’ ) এইরূপে ভাবতে ভাবতে নগ্ন অবস্থায় নগ্ন রমণী রমন করত ( ‘ততো নগ্নাং স্ক্রিয়াং নগ্নং রমণ ক্লেদ যুতোহপিাবা” ) রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত নিজ সাধন কার্যে লিপ্ত থাকে। কুলানির্বতন্ত্র অনুযায়ী এই সাধন প্রক্রিয়া কি, তা এখানে উদ্ধত মূল শ্লোক থেকে বুঝা যাবে।

‘আলিঙ্গনং চুম্বনঞ্চ চ স্তনয়োমর্দন স্তথা।
দর্শনং স্পৰ্শনং যোনিৰ্বিকাশে লিঙ্গঘর্ষণম্।’

( লেখকের ‘হিন্দুসভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষা’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৭১-৮৩ দেখুন ) ৷

।। পাঁচ ।।

পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে আমরা তান্ত্রিক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। এই মন্দিরের তান্ত্রিক শক্তি হচ্ছেন বিমলা । বিমলা অধিষ্ঠিতা আছেন মাটির তলায় এক মন্দিরে । জগন্নাথ মন্দিরের চত্বর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেখানে যেতে হয় । জগন্নাথের উপাসনা বৈষ্ণব তন্ত্রমতে হয় । আরাধনার সময় পঞ্চ-’ম’কারের বিকল্প হিসাবে মৎস্যের পরিবর্তে হিঙ্গুমিশ্ৰিত সবজী, মাংসের পরিবর্তে ‘আদাপচেদি’, মদ্যের পরিবর্তে কাংস্য-পাত্রে নারিকেলের জল, মুদ্রার পরিবর্তে ‘কান্তি’ (গোধূমচূর্ণ ও শর্করা মিশ্রিত দ্রব্য) ও মৈথুনের পরিবর্তে দেবদাসীর নৃত্য ও অপরিজাতা ফুল উৎসর্গ করা হয়। আসল আমিষ দ্রব্য পুরীর মন্দিরে কখনও প্রবেশ করানো হয় না। কিন্তু বৎসরে একদিন এর ব্যতিক্রম করা হয়। সেদিনটা হচ্ছে মহাষ্টমীর দিন। মাত্র মহাষ্টমীর দিন পুরীর মন্দিরে বিমলার ভোগ রন্ধনের জন্য মৎস্য ব্যবহার করা হয়। যাঁরা মহাষ্টমীর দিন বিমলার ভোগ খেয়েছেন, তঁরা জানেন এটা মাছের পোলাও বিশেষ ।

আমি আগের এক অধ্যায়ে প্রাচীন ভারতে সহােদরা বিবাহের উল্লেখ করেছি। পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহত্রয়ের সমাবেশ তারই ইঙ্গিত করে। এই সম্পর্কে আগে উদ্ধৃত কুলচূড়ামণি তন্ত্রের উক্তি স্মরণীয়। সেখানে বলা হয়েছে যে সাধনার সময় যদি অপর নারী পাওয়া না যায়, তা’হলে নিজের কন্যা, নিজের কনিষ্ঠা বা জ্যেষ্ঠ ভগিনী, মাতুলানী, বা বিমাতাকে নিয়ে কুলপূজা করবে।

।। ছয় ।।

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যে সব দুঃসাহসিক নারী-পুরুষ মৈথুনের মূর্তি আছে (মন্দিরের ভিতর ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না বলে ) সে সব মূর্তির ছবি এখনও ছাপা হয় নি। সে গুলো দেখলেই বুঝতে পারা যাবে যে এক সময় শ্ৰীক্ষেত্র তান্ত্রিক সাধনারই এক পীঠস্থান ছিল । তবে পুরীর মন্দিরের মৈথুন মূর্তিগুলি সম্বন্ধে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে। সত্তর বছর আগে ওই মূর্তিগুলি আমি যখন প্ৰথম দেখি, তখন ওগুলো নানা রঙে রঞ্জিত ছিল । আজ আর ওগুলোর সে রূপ নেই। শালীনতা রক্ষার খাতিরে ওগুলোকে কলিচুন দিয়ে আবৃত করা হয়েছে ।

ভুবনেশ্বরে এক সময় ৭০০ মন্দির ছিল। সত্তর বছর আগেও আমি তিন-চারশ মন্দির দেখেছি। এখানেও মৈথুন মূর্তির ছড়াছড়ি । তবে রাজা রানী মন্দিরের মৈথুন মূতিগুলি হচ্ছে সবচেয়ে দুঃসাহসিক ধরণের ।

কোনারক পরিত্যক্ত মন্দির । এখানে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ নয়। সেজন্যই আমরা কোনারকের রমনমূর্তিগুলির সহিত বেশী পরিচিত। অনুরূপভাবে আমরা পরিচিত খাজুরাহোর মন্দিরের রমণ বিলাস মূর্তিগুলির সঙ্গে । এখানেও বহু দুঃসাহসিক ধরনের রমন মূৰ্তি আছে। খাজুরাহােতেও এক সময় অগণিত মন্দির ছিল। তাদের মধ্যে এখনও গোটা পঁচিশ বিদ্যমান । নাগর রীতিতে গঠিত মন্দিরের এখানেই চরম পরাকাষ্ঠা প্ৰদৰ্শিত হয়েছিল। মূল দেবতার মন্দিরকে অবলম্বন করে এখানে ৬৪ যোগিনীর মন্দিরও রচিত হয়েছিল । এ থেকেই এগুলির তান্ত্রিক উৎপত্তি প্ৰকাশ পায় ।

।। সাত ।।

একটা প্রশ্ন এখানে খুব স্বাভাবিকভাবে উঠতে পারে । ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য তো খুব সুপ্রাচীন। তবে আগেকার যুগের ভাস্কর্যে মিথন মূর্তি না দেখিয়ে, হঠাৎ দশম একাদশ শতাব্দীর মন্দিরগুলিতে তার প্রথম আবির্ভাব ঘটল কেন ? মিথন মূর্তিগুলি যদি তান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হয়, তা হলে এর ব্যাখ্যা খুবই সহজ । তান্ত্রিক সাধনসদৃশ ধৰ্মপদ্ধতি পূর্ব ভারতের জনগণের মধ্যে প্ৰাক-বৈদিক কাল হতে প্রচলিত ছিল । এর সাধন পদ্ধতি অতি গূঢ় বলে, এটা সুপ্ত অবস্থায় গোপনভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় লুক্কায়িত ছিল। জনপ্রিয়তা লাভের জন্য বৌদ্ধ মহাযানীদের মধ্যেই তান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডের অনুপ্ৰবেশ ঘটে। এর ফলে বজ্ৰযান নামে এক নূতন যানের সৃষ্টি হয়। বজ্রযানকে সহজযান বা সহজিয়া ধৰ্মও বলা হত । যাঁরা সহজপথে যান, তাদের আর জন্মমৃত্যুর আবর্তের মধ্যে ফিরে আসতে হয় না। এই বৌদ্ধ চিন্তাধারাই আমরা চর্যাপদ-সমূহের মধ্যে লক্ষ্য করি। দেহই হচ্ছে এ সাধনার অবলম্বন ৷ দেহভাণ্ডই হচ্ছে ক্ষুদ্রাকৃতি ব্ৰহ্মাণ্ড । মহাসুখের মধ্যে চিত্তের নিঃশেষ নিমজ্জনই হল পরম নির্বাণ । বৌদ্ধরা যখন তন্ত্রের গূহ্যসাধন পদ্ধতি প্ৰকাশ করে দিল, হিন্দুরা তখন আর চুপ করে বসে রইল না। তারাও এই লোকায়ত গৃহসাধনা সম্বন্ধে গ্ৰন্থরচনায় প্ৰবৃত্ত হল। পালরাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ও সিদ্ধাচার্যদের সক্রিয় প্রভাবেই বৌদ্ধ বজ্রযান ধৰ্ম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে জন্যই পালরাজগণের পূর্বের মন্দির ভাস্কর্যে আমরা মিথুন মূর্তির অভাব দেখি ।

।। আট ।।

অনেকে বলেন যে মাত্র রমণমূর্তিগুলির মাধ্যমেই যে সৃষ্টিতত্ত্ব (Cosmic principle ) বুঝানো হয়েছে, তা নয়। মন্দিরগুলোও স্ত্রী-পুরুষ রমণের প্রতীক । এসন্মন্ধে হেগেলই প্রথম মতবাদ প্রকাশ করেন যে শিখর বিশিষ্ট মন্দিরগুলো হচ্ছে পুংলিঙ্গের প্রতীক। তঁাকে সমর্থন করেন হারবাট রীড । আমার সহাধ্যায়ী বন্ধুবর প্রয়াত অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু মন্দির নির্মাণ সন্মন্ধে ওড়িয়া ভাষায় রচিত শিল্পশাস্ত্ৰ সমূহ গভীর ভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। তারই ফলশ্রুতি হচ্ছে তার ‘ক্যাননস্‌ অভ্‌ ওড়িশান আরকিটেকচার’ । তিনিও ওই একই মত পোষণ করেন। ওড়িশার মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ‘রেখা।’ রীতিতে গঠিত একটি মূল শিখর মন্দিরের সামনের দিকে সংযুক্ত করা হয় ‘ভদ্র’ রীতিতে গঠিত আর একটি মন্দির, যেন গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছে নববধূর শাড়ীর সঙ্গে বরের বসনের। শিল্পশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে ‘রেখ’ পুরুষ, ‘ভদ্র’ নারী। তাদের সংযোগ যৌনসঙ্গমের প্রতীক । যে অলিন্দপথ ভদ্রাকে রেখ-এর জঙ্ঘার সঙ্গে সংযুক্ত করছে তা হচ্ছে স্ত্রীযোনির প্রতীক। এখানে স্মরণীয় যে মূল মন্দিরের প্রধানতম অংশকে ‘গৰ্ভ’ বলা হয় ।

এই আলোচনার পর এই কথাই বলতে চাই যে মন্দির গাত্রের মৈথুনমূতিগুলি অশ্লীল মানসিকতার পরিচায়ক নয়। রূপের পূজারী শিল্পী মন্দিরগাত্রে এসকল মূর্তি গঠন করে যে মাত্র সৃষ্টিতত্ত্বই বুঝাতে চেয়েছেন তা নয় ; জীবনরসের প্রবাহ ঢেলে স্বৰ্গ-মর্ত্য একসূত্ৰে গ্ৰন্থণাও করে গেছেন ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *