১৪. ধর্ম ও আধুনিকতা

ধর্ম ও আধুনিকতা

সব আইনের মধ্যেই সময়ের একটা ছাপ থাকে। কারণ, একটা আইন তৈরি হয় একটা বিশেষ সময়ে, বিশেষ পরিবেশে, বিশেষ প্রয়োজনের খাতিরে। তারপর সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনের যদি সংশোধন না-হয়, তা হলে সে আইনে সময়ের মড়চে ধরে। জীবন থেকে তা পিছিয়ে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা প্রয়োজন মেটায় না এবং তা মেনে চলাও শক্ত হয়। এমন কি, তা মেনে চললে উন্নতির পথে সেটা বাধা হয়ে দেখা দেয়। এক সময়ে দেশ চলতো রাজার ইচ্ছেয়। তিনি ইচ্ছে করলেই কাউকে শূলে চড়াতে পারতেন। কিন্তু এখন দেশ চলে বেশির ভাগ মানুষের ইচ্ছেয়। বিচার চলে আদালতে–বিধিবদ্ধ আইন অনুযায়ী। সত্যযুগের আইন দিয়ে এখন আর কলি কালের পৃথিবী চলতে পারে না।

আনুষ্ঠানিক ধর্ম হচ্ছে কতোগুলো আইনের একটা সংগ্ৰহ। সে আইন বিধাতা প্রণয়ন করেছেন, নাকি মানুষ–এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে। সে বিতর্কের কোনো মীমাংসাও না-হতে পারে। কিন্তু সে আইন যে একটা বিশেষ সময়ে প্রণীত–এটা ঐতিহাসিক সত্য এবং এর মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। আর-একটা সত্য হলো, ধর্মগ্রন্থে যা লেখা থাকে আর যুগে যুগে মানুষ যেভাবে ধর্ম পালন করে, তা হুবহু এক রকম নয়। তত্ত্ব এবং বাস্তবে পার্থক্য তৈরি হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তত্ত্ব এবং বাস্তবের এই দূরত্ব বাড়তে থাকে। তখন সমাজ ধর্মের খানিকটা সংস্কার করে নেয়। যেমন, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী চারটে পর্যন্ত বিয়ে করার বিধান আছে। কিন্তু ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে যে-পারিবারিক আইন প্রণীত হয়, তাতে একাধিক বিয়ে করার ব্যবস্থাটা নিরুৎসাহিত হয়েছে। বিশেষ অবস্থায় প্রথম স্ত্রীর সম্মতি নিয়েই এখন দ্বিতীয় বার বিয়ে করা যায়।

মহাযান, হীনযান, বোজযান, কালচক্ৰযান ইত্যাদি নানা মতের সৃষ্টি হয়েছে। যে-বুদ্ধ ঈশ্বরকে মানেননি, সেই বুদ্ধ স্বয়ং ভক্তদের চোখে ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন। কেবল তাই নয়, ধর্মগ্রন্থের পরিবর্তন না-হলেও জীবন থেকে ধর্ম অনেকটাই সরে এসেছে। অহিংসা পরম ধর্ম হলেও, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জাপানীরা যুদ্ধ করার আগে বৌদ্ধমন্দিরে গিয়েই অন্য মানুষ খুন করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। তাই শুনে আমাদের কবি দুঃখ করেছেন।

যিশু খৃষ্ট এক গালে চড় দিলে অন্য গাল এগিয়ে দেওয়ার মহান আদর্শ প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অনুসারীরা মধ্যযুগে ধর্মযুদ্ধে রক্ত ঝরিয়েছেন। অন্ত্য-মধ্যযুগে রক্ত ঝরিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা এবং অ্যামেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করেছেন। এমন কি, ধ্বংস করেছেন স্থানীয় ধর্মগুলোকে। আর এ যুগে খৃষ্ট-অনুসারীরা বজনিয়া, রোয়ান্ডা, ইরাকে অসহায় এবং নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছেন। পুনর্জন্মপ্রাপ্ত খৃষ্টান (বর্ন এগেইন) প্রেসিডেন্ট বুশ শান্তির বদলে জঙ্গীবাজ সেজেছেন।

ইসলাম মানে শান্তির ধর্ম। কিন্তু বাংলাদেশের কয়েকজন বড়ো মওলানার হাতে ৭১-এর রক্তের দাগ এখনো লেগে আছে। শায়খ রহমান আর তার জেহাদী বাহিনী নিজেদের হাতে মানুষ জবাই করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। সংক্ষেপে বলা যায়, ধর্মগ্রন্থে যা আছে, যুগে যুগে তার খানিকটা সংস্কার করে নেন ধর্মের অনুসারীরা। কারণ, এই সংস্কার ছাড়া, ধর্মের অনেক বিধান অচল হয়ে পড়তো।

এর আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে। শায়খ রহমান এবং তাঁর অনুসারীরা বলেন যে, মানুষ আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আইন হলো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার তৈরি। মানুষ তা বাস্তবায়িত করবে। তার ব্যাখ্যা দেবে। সে জন্যেই শায়খ রহমানরা দেশের আইন-ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চান। তাদের মতে, দেশে কোনো আদালত থাকবে না। আইনের শাসন চলবে মসজিদকে কেন্দ্র করে। এমন কি, ইসলাম ধর্ম অনুসারে নির্বাচনে ভোট দেওয়াও নাকি নিষিদ্ধ। কারণ, ভোট দেওয়ার আইনটা হলো মানুষের তৈরি। গণতান্ত্রিক সরকার হলো মানুষের তৈরি একটা ব্যবস্থা। এই উগ্ৰবাদী ধর্মগুরুরা তাই এসব ভেঙে ফেলার কথা প্রচার করেন। তাঁরা কেবল বাংলাদেশে নয়, তাবৎ পৃথিবীতে মানুষের তৈরি যে-সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তার বিরোধিতা করেন। তা মুছে ফেলে নতুন বিশ্ব গড়ে তুলতে চান। যে-বিশ্ব চলবে ধর্মগ্রন্থে যেসব বিধান লেখা আছে, সেই বিধান এবং শায়খ রহমানের মতো ধর্মগুরুদের ব্যাখ্যা অনুসারে। ইরান অথবা আফগানিস্তানের মোল্লা বাহিনীর মতো ধর্মীয় বাহিনী সেই আইন বাস্তবায়িত করবেন।

প্রশ্ন হচ্ছে: এটা কি একটা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব, নাকি আজগুবি ভাবনা? জ্ঞানেবিজ্ঞানে-প্ৰযুক্তিতে পৃথিবী এখন যেখানে পৌঁছেছে, এবং যে-দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাকে থামিয়ে দেওয়া অথবা এই অগ্রগতিকে উল্টো পথে নেওয়া কি সম্ভব? সম্ভব ঘড়িকে ঘুরিয়ে প্রাচীন এক স্বপ্ন-জগতে ফিরে যাওয়া? বিশ্বে যে-জ্ঞানের চর্চা হয়েছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে-দর্শন গড়ে উঠেছে–তাকে কি সীমাবদ্ধ করা যাবে একটি অথবা কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে?

ধর্ম বলে: চলো নিয়মমতো। ডানে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো। কেন ডানে তাকাবো না, কেন ঘাড় বাকাবো না, ধর্ম তার ব্যাখ্যা দেয় না। ধর্ম চায় অন্ধ আনুগত্য। এভাবে আনুষ্ঠানিক ধর্ম মানুষকে যুক্তি এবং জিজ্ঞাসার পথ থেকে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। নিয়ম চলে, মানুষ চলে না। ধর্মের বিধান অনুযায়ী: নিয়মের জন্যে মানুষ, মানুষের জন্যে নিয়ম নয়।

বেশির ভাগ ধর্মই শত শত বছরের পুরোনো। তাদের মধ্যে এমন অনেক কথা আছে, এমন অনেক বিধান আছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং মূল্যবোধের সঙ্গে যাদের মেলানো শক্ত। ধর্ম বলেছে, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সমস্ত বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড ঘুরছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখলেন, এটা ভ্ৰান্ত। ধর্ম বলেছে, জন্মের আগে পর্যন্ত সন্তানের লিঙ্গ জানা যাবে না। বিজ্ঞানের দৌলতে এখন অনেক আগে থেকেই তা জানা যাচ্ছে। এমন কি, ইচ্ছে করলে সন্তানের লিঙ্গও পিতামাতা আগে থেকে নির্ধারণ করতে পারছেন। নারীপুরুষের সঙ্গম ছাড়াও এখন সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। বস্তুত, ধর্ম মানুষের মঙ্গলের জন্যেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ধর্মগ্রন্থে যেসব কথা আছে, তার সবই আক্ষরিকভাবে সঠিক নয়। আমার ধারণা, ধর্মের স্পিরিট মেনে সৎ মানুষ হয়ে ওঠাই আসল কথা। কিন্তু ধর্মের সব বিধান যুগোপযোগী না-ও হতে পারে।

১৮২০-এর দশকে রামমোহন রায় এক-ঈশ্বরের আদর্শ প্রচার করলেও তাকে ঠিক আনুষ্ঠানিক ধর্মের রূপ দেননি। ব্ৰাহ্মধর্মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৪০-এর দশকে। তিনি তখন ভাবলেন যে, এই ধর্মের জন্যে একটি ধর্মগ্রন্থ থাকা দরকার। সেই ধর্মগ্রন্থ তিনি রচনা করতে চান বেদ-উপনিষদের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু যখন দেখলেন, বেদ এবং উপনিষদের অনেক কথাই আধুনিক চিন্তাধারা ও যুক্তিবাদের সঙ্গে মেলে না এবং ঠিক আধুনিক কালের উপযোগী নয়, তখন সেসব শ্লোক তিনি খানিকটা সংশোধন করে নেন। গ্ৰহণ-বর্জনের মাধ্যমে তিনি বেদউপনিষদকেই আধুনিক কালের উপযোগী করে তোলেন। ফলে বঙ্গীয় সমাজে তখন চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে ব্ৰাহ্মরাই সবচেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। অন্য শিক্ষিত হিন্দুরা তাদেরই কমবেশি অনুকরণ করেছিলেন। এভাবে যুগে যুগে বৌদ্ধধর্ম এবং খৃস্টধর্মেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেকে মনে করেন, পরিবর্তনকে গ্রহণ করার ইচ্ছা এবং ক্ষমতাই আধুনিকতা। একজন ফরাসি মনীষী বলেছেন যে, এই আধুনিকতা যে-ধর্ম মেনে নিতে পারে না, সে ধর্ম ধর্মই নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *