১২. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত

আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের আইনটা বেশ শক্ত। যে-দেশে নানা ধর্মের লোক বাস করেন, সে দেশে শক্ত থাকাই উচিত। কারণ প্রত্যেকেরই নিজনিজ মত অনুসারে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা আছে। সেই অধিকারে বঞ্চিত করলে, মৌলিক অধিকারেই আঘাত করা হয়। সুতরাং এ আইন অবশ্যই থাকা দরকার। এবং তা যথাযথভাবে পালন করাও দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: যে-দেশে একাধিক ধর্ম আছে, সে দেশে বাস্তবে এ আইন কিভাবে প্রয়োগ করা হবে? কী ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। ধৰ্ম আর ধর্মীয় অনুভূতির?

এই প্রশ্নের জবাব দিতে হলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতে হয়, ধর্মের সংজ্ঞা কী? কোনটা সত্যিকারের ধর্ম, কোনটা অধৰ্ম–সেই তাত্ত্বিক প্রশ্নে যাবো না। আমরা যদি ধরেও নিই যে, ধর্ম মানে বিধিবিধান সংবলিত আনুষ্ঠানিক ধর্ম, তা হলেও ধর্মের ংজ্ঞা দেওয়া এমন কিছু সহজ হয় না। বাংলাদেশ কেবল মুসলমান-প্রধান দেশ নয়, এরশাদী সংশোধন অনুসারে এ দেশের প্রধান হলেন স্বয়ং আল্লাহ। সুতরাং বাংলাদেশ আল্লাহ-তন্ত্রী দেশ, অর্থাৎ ইসলামী দেশ। সেই ইসলাম ধর্মের অনুভূতি নিয়েই তাত্ত্বিক আলোচনা করা যাক।

ইসলাম ধর্মের একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ আছে। কিন্তু যেভাবে বাস্তবে তা পালিত হয়, তা থেকে বলতে হয়: তার কি কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা আছে? এ ধর্মের একেবারে গোড়ার শর্ত হলো: ঈশ্বর এক এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষ হলেন হজরত মোহাম্মদ। কিন্তু শুধু এটুকুন মেনে নিলে তবেই তাবৎ মুসলমান এক খেয়ায় চড়তে পারেন। এর বেশি কোনো শর্ত দিলে তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন বাহন বেছে নিতে বাধ্য হবেন। কারণ, তার পরেই আসে ধর্মের বিচিত্র দিকের ব্যাখ্যা নিয়ে নানা মতের কথা। প্রথমেই সুন্নি আর শিয়ার পার্থক্য। শিয়ারা মনে করেন, তাঁরা সঠিক, সুন্নিরা মনে করেন তারা সঠিক। সুন্নিরা তাদের ধর্মমতের কথা বললে, শিয়ারা মনে করতে পারেন যে, তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। আবার, উল্টোটাও হতে পারে। সেই আঘাত এবং প্রত্যাঘাতের ফলে কী হতে পারে–ইরাক এবং পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নির বিরোধ থেকেই অনুমান করতে পারবেন। কথা হচ্ছে: বিচারক কোন শাখার মতানুসারে রায় দেবেন?

সুন্নিদের মধ্যেও সবাই এক মতে বিশ্বাস করেন না। বড়ো চারজন ধর্মগুরু এই ধর্মের যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেই ব্যাখ্যা অনুসারে সুন্নিরা চারটি ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের লোকেরা যা বিশ্বাস করেন, অন্য ভাগের লোকেদের সঙ্গে তার অনেক অমিল লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি বাস করলে এই চার সম্প্রদায়ের মধ্যে তা নিয়ে সংঘর্ষ দেখা দেওয়াও অসম্ভব নয়। এক সম্প্রদায় যেভাবে ধর্ম পালন করবেন, তাতে অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি আহত হতে পারে। তখন বিচারক কোনটাকে অনুমোদন করবেন? শাস্তি দেবেন কাকে?

ভাগ্য ভালো: বাংলাদেশের সুন্নিরা বেশির ভাগই হানাফি। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে তাদের মধ্যে অনৈক্য থাকার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের তাবৎ হানাফি কি একই তরিকায় বিশ্বাস করেন? যেমন, আহালে হাদীস সম্প্রদায়ের সঙ্গে মূলধারার মুসলমানদের মতের কি মিল হয়? মধ্যযুগে বাংলাদেশে ধর্ম প্রচার করেছিলেন প্রধানত সুফি-পীরেরা। তারা যে-ভক্তিবাদী ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তার সঙ্গে হানাফি মতের মিল হয় না। সে জন্যে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আদর্শের বিরোধ এবং তা থেকে সংঘর্ষ হতেই পারে। সাম্প্রতিক কালেও হয়েওছে। জঙ্গী ইসলামীরা সুফি পীরের আখড়ায় হামলা চালিয়েছে, এমন কি, পীর এবং তার সাগরেদদের খুন করেছে। এ তো কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নয়, রীতিমতো ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।

এ রকমের আর-একটি সম্প্রদায় হলো আহমদিয়া। আহমদিয়ারা অনেকেই যেহেতু সচ্ছল, সে জন্যে সুফিদের মতো নীরবে তাঁরা অত্যাচার মেনে নেননি। তাঁরা রীতিমতো আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তাঁদের আন্দোলনের প্রতি দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী লোকেরা, এমন কি, কূটনীতিকেরাও সমর্থন জানিয়েছেন। তা সত্ত্বেও খতমে নবুয়তের জঙ্গীরা নানা জায়গায় আহমদিয়াদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু সেই জঙ্গীদের কোনো আদালতে বিচার হয়েছে বলে খবর পাইনি। আল্লাহ এবং তার প্রেরিত পুরুষে আহমদিয়ারা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। নিজেদের তাঁরা মুসলমান বলেই দাবি করেন। তাই তারা তাদের উপাসনালয়কে বলেন মসজিদ। জঙ্গীরা তাতেও আপত্তি করে। তাদের যুক্তি হলো: এটা মূলধারার মুসলমানদের মসজিদ নয়। সুতরাং এটাকে মসজিদ বলা যাবে না। যারা আহমদিয়া নন, তাদের চোখেও এটাকে অত্যন্ত অযৌক্তিক বলে মনে হবে।

উপাসনালয়ের নাম যা-ই রাখুন না কেন— গির্জা, মন্দির, সিনাগগ–তাতে অন্য সম্প্রদায়ের কিছু মাত্র বলার নেই। তারা যদি দাবি করেন, ঈশ্বর একজন নয়, সহস্ৰজন–তাতেও অন্যদের কিছু যায় আসে না–আপত্তির কারণ থাকাতো দূরের কথা। মুসলমানরা মনে করেন, যিশু খৃষ্ট ছিলেন প্রেরিত পুরুষ। কিন্তু খৃস্টানরা মনে করেন, তিনিই ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অংশ। এ নিয়ে খৃস্টান এবং মুসলমানদের মাথা ফাটাফাটি হওয়ার কারণ নেই। কারণ, নিজের মত অনুসারে ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে প্রত্যেকেরই। মূল কথাটা হলো: নিজের ধর্ম। ধর্ম মানে কতোগুলো বিশ্বাসের সমাহার। আপনার চোখে যা অধৰ্ম, আমার চোখে হয়তো সেটাই পরম পবিত্র ধর্ম। আপনার ধর্মের সমালোচনা করে আপনাকে আমি পরিকল্পিতভাবে দুঃখ দিতে পারি না। অথবা তা দেওয়া উচিত নয়। তেমনি আমি কোনো ধর্ম পালন না-ও করতে পারি। তাতে আপনার কিছু বলার থাকতে পারে না। অথবা আপনি জোর করে আমাকে কোনো ধর্ম পালন করতে বাধ্য করতে পারেন না। আমি যদি বলি, বহু বছর প্রবাসে থাকার সময়ে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বহু বার আমি শুয়োরের মাংস খেয়েছি অথবা বলি রোজ আমি এক গেলাশ লোহিত মদ্য পান করি।–তাতে আপনি চমকে উঠতে পারেন। কিন্তু তা বন্ধ করার জন্যে আমাকে বাধ্য করতে পারেন না। আপনার ধর্ম আপনার, আমার ধর্ম আমার। আপনার ধর্মীয় অনুভূতিতে ইচ্ছা করে আঘাত করা যেমন ভদ্রতা, ভব্যতা এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী— অন্যায়; তেমনি আমার ধর্মীয় অনুভূতিতেও আপনার আঘাত করা সমান অন্যায়। আমার ধর্মীয় মতামত প্ৰকাশ করার অধিকার আমার অবশ্যই আছে। আপনি আগ্রহী হলে সেটা শুনতে পারেন। অপছন্দ হলে, সেটা শুনবেন না। অপর পক্ষে, আপনার মত আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি— রাষ্ট্র নয়, ধর্মও নয়।

(যুগান্তর, ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *