১০. দেবদেবীর কুলজী

দেবদেবীর কুলজী

বৈদিক দেবতাগণের মধ্যে ইন্দ্ৰই শ্রেষ্ঠ । তঁর উদ্দেশ্যে ঋগ্বেদে যত সূক্ত আছে। অন্য কোন দেবতার উদ্দেশ্যে তত নেই। পুরুষসূক্তে ( ১০।৯০৷১৩) ইন্দ্র ও অগ্নি পুরুষের মুখ থেকে উৎপন্ন বলা হয়েছে। অন্যত্র অদিতি তাঁর মা বলা হয়েছে। তিনি মাতৃগৰ্ভ থেকে মাতার পার্শ্বভেদ করে জন্মাবার চেষ্টা করেন । তিনি জন্মাবধিই যোদ্ধা এবং অসুরবধের জন্য সৃষ্ট হয়েছিলেন । প্ৰধান প্ৰধান অসুর যথা বৃত্ৰ, নমুচি, বল, জম্ভ, অহি, চুমুরি, ধুনি, পিপিন, শুষ্ণ প্রভৃতি তাঁর হাতেই নিহত হয়েছিল। তিনি অসুরগণের নগরসমূহ ধ্বংস করেছিলেন বলে, পুরন্দর আখ্যা পেয়েছিলেন।

ইন্দ্রের স্ত্রী শচী বা ইন্দ্ৰানী । তৈত্তিরীয়ব্ৰাহ্মণ অনুযায়ী ইন্দ্ৰ ইন্দ্ৰাণীর যৌনআবেদনে আকৃষ্ট হয়ে অন্যান্য সুন্দরীদের প্রত্যাখান করে ইন্দ্ৰাণীকে বিয়ে করেছিলেন । অন্যান্য গ্রন্থে আছে যে তিনি ইন্দ্ৰাণীর সতীত্ব নষ্ট করে তাকে বিবাহ করেছিলেন । পুলোবা তার শ্বশুর। ইন্দ্রের পুত্রের নাম জয়ন্ত ।

মহাভারতে আছে গৌতম মুনির অনুপস্থিতিতে ইন্দ্ৰ তাঁর রূপ ধরে তাঁর স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন। মহাভারতে আরও আছে যে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ইন্দ্রের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে । ইন্দ্রের রেতঃ থেকে বালীরও জন্ম হয়েছিল ।

অগ্নিও ঋগ্বেদের এক প্রধান দেবতা । ঋগ্বেদে অগ্নি সম্বন্ধে যতগুলি সূক্ত আছে, ইন্দ্র ভিন্ন আর কোন দেবতার তত নেই। অগ্নি দ্যাবা পৃথিবীর পুত্র । আবার বলা হয়েছে। অরণিদ্বয় অগ্নির জনক-জননী । জাতমাত্রই অগ্নি জনক-জননীকে ভক্ষণ করেছিলেন । আবার মহাভারতে আছে যে ধর্মের ঔরসে বসুভাৰ্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম। তিনি দক্ষের মেয়ে স্বাহাকে বিবাহ করেছিলেন। বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী অগ্নির তিন পুত্র–পাবক, পবমান ও শুচি।

অগ্নি সর্বভূক। মহাভারতে আছে। অগ্নি শ্বেতকী রাজার যজ্ঞে অতিরিক্ত হবি ভক্ষণ করে দুঃসাধ্য অগ্নিমান্দ্য রোগে আক্রান্ত হন । ব্ৰহ্মা উপদেশ দেন অগ্নি যদি সমস্ত জীবজন্তু সমেত খাণ্ডকবন দাহন করতে পারে, তা হলে রোগ থেকে মুক্তি পাবে । কিন্তু খাণ্ডববন দেবরক্ষিত বলে ইন্দ্ৰ ওতে বাধা নি । কৃষ্ণ ও অর্জুনের সাহায্যে অগ্নি খাণ্ডবদাহন করে রোগমুক্ত হন।

সূৰ্যও আর্যদের একজন উপাস্য দেবতা । নানা নামে যথা সুৰ্য, সবিতা, আদিত্য, বিবস্বান, বিষ্ণু ইত্যাদি নামে সূর্যের স্তুতি দেখতে পাওয়া যায় । যাস্ক বলেন–আকাশ হতে যখন অন্ধকার যায় ও কিরণ বিস্তৃত হয়, সেই সবিতার কাল। সায়ন বলেন, উদােয়র পূর্বে সূর্যের যে মূর্তি তাহাই সবিতা, উদয় হতে অস্ত পর্যন্ত যে মূর্তি তাহা সূর্যের উদয়গিরিতে আরোহন, মধ্য আকাশে স্থিতি, এবং অস্তাচলে অস্তগমন, এই তিনটি বিষ্ণুর পদ-বিক্ষেপ ।

সূর্য পুরুষের চক্ষু হতে উৎপন্ন। সূর্যের মাতা অদিতি । উষাকেও সূর্যের জনয়িত্রী বলা হয়েছে । আবার বলা হয়েছে সূর্য প্রণয়ীর ন্যায় ঊষার অনুগমন করেন । রামায়ণ ও মহাভারত অনুযায়ী সূর্য কশ্যপ ও অদিতির পুত্র। বিশ্বকৰ্মার কন্যা সংজ্ঞার সহিত সূর্যের বিবাহ হয় । সংজ্ঞার গর্ভে সূর্যের বৈবস্বত মনু, যম ও যমুনা নামে তিন সন্তান হয় । সংজ্ঞা সূর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে, নিজের অনুরূপ ছায়াকে সৃষ্টি করে সূর্যের কাছে রেখে অশ্বীর রূপ ধারণ করে উত্তর কুরুতে পালিয়ে যায়। ছায়ার গর্ভে সূর্যের সাবৰ্ণি মনু ও শনি নামে দুই পুত্র ও তপতী নামে এক কন্যা হয়। পরে সূর্য যখন সংজ্ঞার শঠতা বুঝতে পারে তখন অশ্বরূপ ধারণ করে উত্তর কুরুতে গিয়ে সংজ্ঞার সঙ্গে মিলিত হয় । এর ফলে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের জন্ম হয়। মহাভারত অনুযায়ী সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে কর্ণের জন্ম হয় । ঋক্ষরজার গ্রীবায় পতিত সূর্যের বীর্য থেকে সুগ্ৰীবের জন্ম হয় ।

বরাহপুরাণ অনুযায়ী ব্ৰহ্মার দক্ষিণ অঙ্গ থেকে ধর্মের জন্ম হয় । বামনপুরাণ মতে ধর্মের স্ত্রী অহিংসা। এর গর্ভে চারিটি পুত্র হয়–সন্যকার, সনাতন, সনক ও সনন্দ । মহাভারত অনুযায়ী ধর্মের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। পুরাণ মতে ধর্ম ও যম একই। বলা হয়েছে যে দেবগণের মধ্যে যম সর্বাপেক্ষা পূণ্যবান বলে ওঁর নাম ধৰ্মরাজ । কিন্তু তার জন্মবৃত্তান্ত ভিন্ন দেওয়া আছে। সূর্যের ঔরসে ও তার স্ত্রী সংজ্ঞার গর্ভে যমের জন্ম বলা হয়েছে। যম পাপ পুণ্যের বিচারকর্তা । চিত্রগুপ্ত তাঁর পাপপুণ্যের হিসাবরক্ষক। ঋগ্বেদে বিবস্বান ও সরন্যুর সন্তান যম-যমী-যমজ ভ্ৰাতা ও ভগিনী । ঋগ্বেদে যমী যমের সহবাস আকাঙ্খা করেছেন। (আগে দেখুন )। যমলোক মনুষ্যলোক হতে ৮৬,০০০ যোজন দূরে অবস্থিত।

পৌরাণিক যুগের তিন শ্রেষ্ঠ দেবতা- ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। শিবের কথা আমরা আগেই বলেছি। ব্ৰহ্মার কথা পরে বলব। এখানে বিষ্ণুর কথাই বলছি। বিষ্ণু বৈদিক দেবতা। বেদে বিষ্ণুকে সূর্যের সঙ্গে অভিন্ন করা হয়েছে। পুরাণ মতে প্রজাপতি কশ্যপের ঔরসে অদিতির গর্ভে বিষ্ণু জন্মগ্রহণ করেন । বিষ্ণুর দুই স্ত্রী–লক্ষ্মী ও সরস্বতী। পুত্ৰ কামদেব। বিষ্ণু পালন কর্তা । বলা হয়েছে পৃথিবীর কল্যাণের জন্য দেবতাদের সাহায্য করবার জন্য ও দানব দলনের জন্য ইনি যুগে যুগে আবির্ভূত হন । বিষ্ণুর এইরূপ আবির্ভাবকে অবতার বলা হয়। বিভিন্ন যুগে বিষ্ণু মৎস্য, কুৰ্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, রাম, পরশুরাম, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি–এই দশ অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছেন। প্ৰলয়সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় নারায়ণরূপে মনুষ্যদেহধারী হয়ে বিষ্ণু শেষনাগের ওপর শায়িত ছিলেন । এঁর নাভিপদ্ম থেকে ব্ৰহ্মার উৎপত্তি হয়েছিল । জগৎ সৃষ্টির কালে মধু ও কৈটভ নামে দুই দানবকে হত্যা করে তাদের মেদ থেকে তিনি মেদিনী সৃষ্টি করেছিলেন।

মহাপ্রলয়ের শেষে বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে ব্ৰহ্মার উৎপত্তি হয়। জলে তিনি সৃষ্টির বীজ নিক্ষেপ করেন । ওই বীজ অণ্ড হয়ে দুভাগে বিভক্ত হলে, একভাগ আকাশে ও অন্যভাগ ভূমণ্ডলে পরিণত হয়।

এরপর ব্ৰহ্মা মন থেকে মরীচি, অত্ৰি, অঙ্গিরা, পুলস্তা, ক্রতু, বশিষ্ঠ, ভুগু, দক্ষ, নারদ এই দশজন প্ৰজাপতিকে সৃষ্টি করেন। ব্ৰহ্মার স্ত্রী সরস্বতী ও দুই কন্যা দেবসেনা ও দৈত্যসেনা । দেবসেনা ষষ্ঠী নামেও পরিচিতা । ইনি মাতৃকাশ্রেষ্ঠ ও শিশুপালিকা। দেবসেনার ভগিনী দৈত্যসেনাকে একবার কেশীদানব হরণ করে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিবাহ করে । ইন্দ্ৰ দেবসেনাপতি কার্তিককে বলেন যে, এই কন্যার ( দেবসেনার ) জন্ম না হতেই ব্ৰহ্মা একে আপনার স্ত্রী বলে নিদিষ্ট করেছেন। কাৰ্তিকের সঙ্গে এর বিবাহ হয়।

ব্ৰহ্মার প্রথমে পাঁচটা মুখ ছিল। একবার শিবকে তাচ্ছিল্য করায় শিব তঁর তৃতীয় নয়নের অগ্নিতে ব্ৰহ্মার একটি মস্তক দগ্ধ করে । সেই থেকে ব্ৰহ্মার চার মস্তক । ব্ৰহ্মা চতুর্ভূজ ও রক্তবর্ণ। অপর এক কাহিনী অনুযায়ী বিশ্বকৰ্মা যখন অপ্সরা তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করে, এবং সৃষ্টির পর তিলোত্তম যখন দেবতাদের প্রদক্ষিণ করে, তখন তাকে দেখবার জন্য ব্ৰহ্মার চারদিকে চারটি মুখ সৃষ্টি হয় ।

অথর্ববেদে কামদেব স্রষ্টা হিসাবে পুজিত হয়েছেন। কিন্তু পুরাণে তিনি যৌনাকাঙ্খার দেবতা । মৎস্যপুরাণে আছে ব্ৰহ্মার হৃদয় হতে কামদেবের জন্ম ৷ ব্ৰহ্মা নিজে তার শরে জর্জরিত হয়ে নিজ কন্যা শতরূপায় উপগত হন । মহাদেবের তপস্যা ভঙ্গ করতে গিয়ে কাম শিবের তৃতীয় নয়নদ্বারা ভস্মীভূত হয়েছিল। অভিশাপের ফলে কাম শ্ৰীকৃষ্ণের পুত্ৰ প্ৰদ্যুম্নরূপে জন্মগ্রহণ করে। তারপর বিদ্যাধরদের পিতা হয়ে দেবত্ব লাভ করে । কামের স্ত্রী রতি। রতি দক্ষের কন্যা । ইনি যৌন আকাঙ্ক্ষার দেবী । কালিকাপুরাণ অনুযায়ী দক্ষ নিজ কন্যা রীতিকে দেখিয়ে কামদেবকে বলেন, এ আমার দেহজাত কন্যা এবং গুণে তোমার অনুরূপ । এই বলে তিনি রতিকে কামদেবের হাতে সমর্পণ করেন । রতিকে দেখে দেবতারা তার প্রতি অনুরক্ত হন । শিবের অভিশাপের ফলে কামদেব যখন শ্ৰীকৃষ্ণের পুত্ৰ প্ৰদ্যুম্নরূপে জন্মগ্রহণ করে, রতি তখন মর্ত্যলোকে তাঁর স্ত্রী মায়াবতী রূপে জন্মান ।

কুবের মহাদেবের ধনরক্ষক। পিতা পৌলস্ত্য বা বিশ্রবা, মাতা ভরদ্বাজ-কন্যা দেববর্ণিনী ৷ ব্ৰহ্মার বরে তিনি উত্তর দিগন্তের দিকপাল ও ধনাধিপতি হন। ব্ৰহ্মা তার আবাসস্থান নির্দেশ না করায় পিতার নির্দেশে ত্ৰিকুট-শিখরস্থ লঙ্কাপুরীতে গিয়ে বাস করেন। কিন্তু কুবেরের বৈমাত্রেয় ভাই রাবণ লঙ্কাপুরীর অধিকার চাইলে, পিতার উপদেশে লঙ্কা ত্যাগ করে কৈলাসে যান। সেইখানেই তঁর বাসস্থান ঠিক হয়। কুবের একদা হিমালয়ে তপস্যাকালে দৈবাৎ দেবী রুদ্রাণীকে দর্শন করেন। ফলে তার দক্ষিণ চক্ষু দগ্ধ ও বামচক্ষু ধূলিকলুষিত ও পিঙ্গলবৰ্ণ হয় । বহু বৎসর ধরে কঠোর তপস্যায় মহেশ্বরকে গ্ৰীত করেন ও তার সঙ্গে সখ্য স্থাপন করেন। কুবেরের চেহারা খুব কুৎসিৎ ছিল। তার তিনটি পা ও আটটি দাঁত ছিল । আহুতি তাঁর স্ত্রী, নলকুবের ও মনিগ্রীব তাঁর দুই পুত্র ও মীনাক্ষী তাঁর কন্যা । কুবের যক্ষরাজ নামেও পরিচিত ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *