১০. উত্তরাধিকার

উত্তরাধিকার

এ-পর্যন্ত যে-সব ইঙ্গিত ধরিতে চেষ্টা করিলাম, তাহা বাঙালীর গভীর চরিত্র ও জীবন-দর্শনগত, যে-চরিত্র ও জীবন দর্শন গড়িয়া উঠিয়াছে বাঙালী-জনের গঠন, ভৌগোলিক পরিবেশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্ৰীয় সংস্থা ও ইতিহাসের আবর্তন-বিবর্তনের সম্মিলিত ফলে। এই চরিত্র ও জীবনদর্শন একাধারে প্রাচীন বাঙালীর শক্তি ও দুর্বলতা। তাহার সমাজ ও রাষ্ট্রবিন্যাসে, জীবন ও সংস্কৃতিতে এই শক্তি দুর্বলতা উভয়ই প্রতিফলিত, এবং লাভ এবং ক্ষতি দুইই সেই শক্তি ও দুর্বলতা অনুযায়ী।

আদিপর্বের বাঙালী যে-উত্তরাধিকার তাহার মধ্যপর্বের বংশধরদের হাতে তুলিয়া দিয়া গেল। তাহার মধ্যে প্রধান ও প্রথম উত্তরাধিকার এই চরিত্র ও জীবনদর্শন। মধ্যপর্বে ইতিহাসের আবর্তনে এই চরিত্র ও জীবনদর্শনের কোন দিকে কতখানি অদল বদল হইবে সেই আলোচনা আদিপর্বে অবাস্তুর, কিন্তু এই উত্তরাধিকার লইয়াই মধ্যপর্বের যাত্রারম্ভ, এ-কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন।

সদ্যোক্ত চরিত্রও জীবনদর্শন ছাড়া আর যাহা উত্তরাধিকার তাহা এক এক করিয়া তালিকাগত করা যাইতে পারে। ক্ষতির ও ক্ষয়ের অঙ্কের দিকটাই আগে বলি।

ক্ষতি ও দুর্বলতার দিক

মুহম্মদ বখতইয়ারের সফল নবদ্বীপাভিযানের ফলে গৌড়ে ও রাঢ়ে মুসলিম-আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইল, সন্দেহ নাই; সঙ্গে সঙ্গে এ-তথ্যও নিঃসন্দেহে যে, পূর্ববঙ্গে স্বাধীন সেনবিংশ আরও প্রায় সার্ধশতাব্দী কলেরও বেশি রাজত্ব করিয়াছিলেন; তাহা ছাড়া, ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বাধীন, এবং গৌড়ে-রাঢ়ে ও দেশের অন্যত্র প্রায় স্বাধীন সমস্ত হিন্দু রাজবংশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আধিপত্য বহুদিন পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। কেশবসেন বোধহয় একাধিকবার যবন-রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধও করিয়া থাকিবেন। কিন্তু যে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা এবং তাহার চেয়েও বড় কথা, বাঙালী ও বাঙলাদেশ যে সর্বব্যাপী মহতী বিনষ্টির সম্মুখীন হইয়াছিল। সেই পরাধীনতা ও বিনষ্টির স্থাত হইতে বাচিতে হইলে যে চরিত্রবল, যে সমাজশক্তি এবং সুদৃঢ় প্রতিরোধ-কামনা থাকা প্রয়োজন সমসাময়িক বাঙালীর তাহা ছিল না। কারণ, দ্বাদশ শতকের বাঙলাদেশ পরবর্তী দুই শতকের হাতে যে-সমাজবিন্যাস উত্তরাধিকার স্বরূপ রাখিয়া গেল সেই সমাজ জাতি-বর্ণ এবং অর্থনৈতিক শ্রেণী উভয় দিক হইতেই স্তরে স্তরে অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত; প্রত্যেকটি স্তর ও স্তরাংশ সুদৃঢ় প্রাচীরে নিশ্চিছদ্র করিয়া গাথা; এক স্তর হইতে অন্য স্তরে যাতায়াতে প্রায় দুর্লঙ্ঘ বাধা, এক স্তর স্তরের প্রতি অবিশ্বাস্যপরায়ণ, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একের স্বাৰ্থ অন্যের পরিপন্থী।

দ্বিতীয়ত, সে-সমাজের চরিত্র শিথিল। ব্যাপক সামাজিক দুর্নীতির কীট ভিতর হইতে সামাজিক জীবনের সমস্ত শাস ও রস শুষিয়া লইয়া তাহাকে ফাঁপা করিয়া দিয়াছিল। তখন রাষ্ট্রে, ধর্মে, শিল্পে, সাহিত্যে, দৈনন্দিন জীবনে যৌন অনাচার নির্লজ্জ কর্মপরায়ণতা, মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, রুচিতারল্য এবং অলংকারবাহুল্যের বিস্তার।

তৃতীয়ত, সে-সমাজ একান্তভাবে ভূমি ও কৃষিনির্ভর, এবং সেই হেতু উচ্চস্তরে ছাড়া বৃহত্তর বাঙালী সমাজ সাধারণভাবে দরিদ্র, এবং যেহেতু তাহার বিত্তশক্তি পরিমিত সেই হেতু বৃহত্তর সমাজের উদ্ভাবনী শক্তিও দুর্বল, জীবনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা শিথিল।

চতুর্থত, সে-সমাজ, বিশেষত তাহার উচ্চতর স্তরগুলি একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন। এই আচ্ছন্নতায় দোষ ছিল না। যদি সেই ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টি প্রাগ্রসর সৃষ্টিপ্রেরণায় উদ্ধৃদ্ধ হইত। কিন্তু সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টি ধর্মশাস্ত্রের সুদৃঢ় বিধিবিধানে আঁটি করিয়া বাধা; সে-দৃষ্টি রক্ষণশীল এবং চলচ্ছক্তিহীন, অর্থহীন আচার বিচারের মরুবালিরাশির মধ্যে তাহা পথ হারাইয়াছে; অথচ, সামাজিক নেতৃত্বের বল্গার একটা রসি তাঁহাদেরই হাতে; আর একটা দিক রাজা বা রাষ্ট্রের হাতে এবং সেই রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত প্রভূতিদেরই প্রাধান্য। যাহারা এই সব ধর্মশাস্ত্রের রচিয়তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাহারাই আবার প্রধান রাজকর্মচারী।

পঞ্চমত, সে-সমাজ একান্তই ভাগ, অর্থাৎ জ্যোতিষনির্ভর; এবং যেহেতু ভাগ্যনির্ভর সেই হেতু সেই সমাজে প্রতিরোধের ইচ্ছা ও শক্তি অত্যন্ত শিথিলী, প্রায় নাই বলিলেই চলে। সমসাময়িক বাঙলার রাজা ও প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীরা অনেকেই নিজেরা জ্যোতিষ চর্চা করিতেন, দিনক্ষণ না দেখিয়া ঘর ছাড়িয়া এক পা বাহির হইতেন না; রাজসভার এবং উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীর এই ভাগ্যনির্ভর মনোবৃত্তি ধীরে ধীরে বৃহত্তর সমাজদেহে বিস্তারিত হইয়া এবং দেশের সমস্ত সংগ্রাম ও প্রতিরোধকামনার মুলোচ্ছেদ করিয়া দিয়াছিল। মুসলমানাধিপত্যের সূচনা ও ক্রম বিস্তারকে দেশ ভাগ্যের অমোঘ লিখন বলিয়াই গ্ৰহণ করিতে শিখিয়াছিল; কাজেই প্রতিরোধ নিরর্থক!

যষ্ঠত, সে-সমাজে অসংখ্যা নরনারী ছিলেন যাঁহাদের ধর্মমত ও পথ এবং ধর্মের আচারানুষ্ঠান প্রভৃতি ছিল সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্য সমাজদার্শের পরিপন্থী। এই সৰ্ব্ব নরনারী এমন ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন বাধ্য হইয়াই যাঁহাদের জীবনযাত্রা ছিল গোপন; লোকচক্ষুর অন্তরালে রাত্রির অন্ধকারে ছিল তাঁহাদের যত ক্রিয়াকর্ম। গুহ্য, গোপন, রহস্যময় ছিল বলিয়াই ইঁহারা অনেকের চিত্তকে আকর্ষণও করিতেন। এই ধরনের গুহ্য, গোপন, গোষ্ঠী সকল দেশে সকল কালেই সমাজশক্তির অন্যতম প্রধান দুর্বলতা, কারণ যে-শক্তি সমাজের নায়কত্ব করিতেছে তাহাকে দুর্বল করাই ইহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু, এই সব গুহ্য, গোপন গোষ্ঠীগুলির যে ধর্মমত ও পথ তাহা কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক মুক্তির বাণী বহন করিয়া আনে নাই; কাজেই সামাজিক দিক হইতে এইসব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈপ্লবিক সক্রিয়তা বিশেষ কিছু ছিল না। তাহা ছাড়া, গুহ্য রহস্যময় গোপনতার আড়ালে এই সব সম্প্রদায়ের ভিত্তির ও বাহিরে নানাপ্রকারের অসামাজিক যৌন আচারানুষ্ঠান এবং ধর্মের নামে নানা ব্যভিচারও বিস্তৃত লাভ করিতেছিল। তাহাও ভিতর হইতে সমাজকে পঙ্গু ও দুর্বল করিয়া দিয়াছিল, সন্দেহ কী?

সপ্তম, সে-সমাজের নিম্নতর কৃষিজীবী স্তরগুলি ছিল একান্ত অবজ্ঞাত, হতচেতন ও সংকীর্ণ; যে-সব উচ্চতর স্তরের হাতে ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের নায়কত্ব তাহদের দৃষ্টিপরিধির মধ্যে এই স্তরগুলির কোনো স্থান ছিল না। স্বভাবতই সে-জন্য রাষ্ট্র ও সমাজ-নায়কদের প্রতি তাহদের কোনো বিশ্বাস ও আন্তরিক শ্ৰদ্ধা ছিল না, সচেতন দায়িত্ববোধও ছিল না। গুহ্য রহস্যময় গোপন ধৰ্মসম্প্রদায়গুলি সম্বন্ধেও এ-কথা সমান প্রযোজ্য। কাজেই ইহুদের মধ্যে বিপ্লব-বিদ্রোহের একটা বীজ সুপ্ত থাকিবে ইহা কিছু অস্বাভাবিক নয়। হয়তো সুনিহিত সুষুপ্ত এই বীজটি সম্বন্ধে ইহাদের মধ্যে কোনো সচেতনতা ছিল না; জল ঢালিয়া, উত্তাপ সঞ্চার করিয়া সেই বীজ হইতে গাছ জন্মাইয়া ফুল ও ফল ফলাইবার মত সচেতন নেতৃত্ব কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণী গ্রহণও করে নাই; করিলে কী হুইত বলা যায় না। বস্তুত, শ্রেণী-হিসাবে শ্রেণীচেতন ছিল না বলিয়া নেতৃত্ব দিবার মত শ্রেণী গড়িয়াও উঠে নাই। একটা বৃহৎ গভীর ব্যাপক সামাজিক বিপ্লবের ভূমি পড়িয়াই ছিল; কিন্তু কেহ তাহার সুযোগ গ্রহণ করে নাই। মুসলমানেরা না আসিলে কিভাবে কী উপায়ে কী হইত, বলিবার উপায় নাই। যাহা অনুকূল অবস্থায় একটা সামাজিক বিপ্লবের রূপ গ্রহণ করিতে পারিত তাহাই মুসলমানের রাষ্ট্ৰীয় অধিকার পাওয়ার ফলে অন্যতার খাতে বহিতে আরম্ভ করিল। এ-সমস্ত কথাই এই গ্রন্থের যথাস্থানে সবিস্তারে প্রমাণ-প্রয়োগ সহকারে বলিয়াছি; এখানে সংক্ষেপে ইঙ্গিতগুলি তুলিয়া ধরিলাম মাত্র।

কিন্তু ক্ষয় ও ক্ষতির কথা যদি বলিলাম, লাভের দিকটার কথাও বলি। যে গুহা রহস্যময় গোপন সম্প্রদায়গুলির কথা একটু আগেই বলিয়াছি তাহাদের মধ্যে সমাজের একটা শক্তিও প্রচ্ছন্ন ছিল। সে-শক্তি মানবতার এবং সাম্যভাবনার শক্তি। পুনরুক্তি করিবার প্রয়োজন নাই যে, এই ধৰ্মসম্প্রদায়গুলির মধ্যে, বিশেষভাবে সহজযানী প্রভৃতি বৌদ্ধ ও নাথসম্প্রদায় প্রভৃতির মধ্যে মানুষের বর্ণ ও শ্রেণীগত বিভেদ-ভাবনা প্রায় ছিল না বলিলেই চলে। তাহা ছাড়া, মানবতার একটা উদার আদর্শও ছিল ইহাদের মধ্যে সক্রিয়। এই উদার সাম্যম্ভাবনা ও মানবতার আদর্শের স্থান সমসাময়িক, অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শতকের ব্রাহ্মণ্য সমাজদর্শ ও সংস্থার মধ্যে কোথাও ছিল না। অথচ, ইহার, অর্থাৎ এই সাম্যম্ভাবনা ও মানবতার আদর্শেরও উপরই মধ্যযুগীয় বাঙলার বৃহত্তম ও গভীরতম ধর্ম ও সমাজ-বিপ্লবের অর্থাৎ চৈতন্যদেব প্রবর্তিত সমাজ ও ধর্মন্দােলনের প্রতিষ্ঠা। বস্তুত, দেশে দেশে যুগে যুগে মুক্ত মানব ও আদর্শের জন্যই সংগ্ৰাম করিয়াছে, এখনও করিতেছে, ভবিষ্যতেও করিবে। এই আদর্শেই মধ্যপর্বের হাতে আদিপর্বের শ্রেষ্ঠতম, বৃহত্তম উত্তরাধিকার।

লাভ ও শক্তির দিক

দ্বিতীয় উত্তরাধিকার, ভূমিনির্ভর, কৃষিনির্ভর সমাজ। ঐকান্তিক ভূমি ও কৃষিনির্ভরতার দুর্বলতার কথা নানাসূত্রে বলিয়াছি ; কিন্তু তাহার একটি গভীর শক্তিও আছে, এবং সে-শক্তি অনস্বীকার্য। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামকেন্দ্ৰিক কৃষিনির্ভর সমাজ প্রায় অনড়, অচল; তাহার জীবনের মূল মাটির গভীরে। সে-সমাজের সংস্কৃতি সম্বন্ধেও একই উক্তি প্রযোজ্য। বিশেষভাবে যে-সমাজে যতদিন পর্যন্ত গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিই ধনোৎপাদনের একমাত্র বা অন্তত প্রধানতম উপায় সেখানে ততদিন পর্যন্ত সেই জীবন ও সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন ঘটানো সহজে সম্ভব নয়—যদি উৎপাদন পদ্ধতির বিবর্তন কিছু না ঘটে, এবং তেমন বিবর্তন প্রাচীন বাঙলায় কিছু ঘটে নাই। এই শক্তির বলেই ভারতীয়, তথা বাঙলার সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা আজও অক্ষুঃ, এবং এই শক্তিই জনসাধারণকে রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন, রাজবংশের সৃষ্টি ও বিলয়, যুদ্ধবিগ্রহ, ধর্মের ও সমাজের সংঘাত প্রভৃতি উপেক্ষা করিয়া নিজের দৈনন্দিন জীবনযাপন করিবার ক্ষমতা ও বিশ্বাস যোগাইয়াছে।

তৃতীয় উত্তরাধিকার, শক্তিধর্মের দিকে বাঙালীর ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ। এ-তথ্য লক্ষণীয় যে, আদিপর্বের শেষের দিক হইতেই দুর্গা, কালী ও তারার প্রতিপত্তি বাড়িতেছিল, এবং এই তিন দেবীই যে শক্তির আধার, ঘনায়মান অন্ধকারে ইহায়াই যে একমাত্ৰ আশা ও ভরসা এ-বিশ্বাস যেন ক্রমশ বাঙালীচিত্তকে অধিকার করিতেছিল। বস্তুত, এই সময় হইতেই বাঙলায় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সাধনায় তান্ত্রিক শক্তিধর্মের প্রাধান্য সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। ইহাও লক্ষ্য করিবার মত যে, মুসলমানাধিকারের কিছুকাল পরই শক্তিসাধক বাঙালীর অন্যতম বেদ কালিকাপুরাণ রচিত হয় এবং শক্তিময়ী কালী বাঙালীর অন্যতম প্রধান উপাস্যা দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিতা হন। এয়োদশ-চতুর্দশ শতকের বাঙলার অন্যতম শ্মশানে কালীর উপাসনা করিয়াই বাঙালী ভয়-ভাবনার কিছুটা উর্ধের্ব উঠিতে, চিত্তে একটু সাহস ও শক্তি সংগ্ৰহ করিতে চেষ্টা করিয়াছে। এই কালীই তাহার চণ্ডী, এবং সমস্ত মধ্যপর্বে চণ্ডীর প্রতাপ দুৰ্জয়!

চতুর্থ উত্তরাধিকার, সৃজ্যমান বাঙলাভাষা। ক্রমবর্ধমান এই ভাষাই একদিক দিয়া ধীরে ধীরে জনসাধারণের মনকে মুক্তি দিতে আরম্ভ করিল। সংস্কৃতের সুদৃঢ় প্রাচীর যখন শিথিল হইল তখন জনসাধারণ আপন ভাষার মাধ্যমেই তাহদের চিস্তাভাবনা স্বপ্নকল্পনাকে রূপদান করিবার একটা সুযোগ পাইল। বস্তুত, বাঙলার ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম দেশের লোক দেশী ভাষায় আপন প্রকাশ খুঁজিয়া পাইল ; ব্যাপকভাবে জনসাধারণের মন ও হৃদয়ের কথা শোনা গেল। মধ্যপর্বের গোড়ায় সেইজন্যই এই ভাষার প্রতি ব্ৰাহ্মণ এবং গোড়া ব্ৰাহ্মণ্য সমাজের একটা বিরাগ ও বিরোধিতা সক্রিয় ছিল, এবং সেই কারণেই এই ভাষার প্রতি মুসলমান রাষ্ট্রশক্তি কিছুটা আকৃষ্ট হইয়াছিল। এই ভাষাই মধ্যপর্বে বাঙালীর অন্যতম প্রধান শক্তিরূপে বিবর্তিত হইল।

 

***

 

ইতিহাসের কথা বলা শেষ হইল। কিন্তু ঐতিহাসিকও তো সামাজিক মানুষ ; একটি বিশেষ কালে একটি বিশেষ সমাজসংস্থার মধ্যে তাহার বাস। তাহার কাজ পশ্চাতের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করিয়া ‘রাগদ্বেষবহির্ভূত হইয়া ভূতাৰ্থ’ বলা। কিন্তু সামাজিক মানুষ হিসারে সেই ভূতাৰ্থই তাহাকে তাহার সমসাময়িক সমাজকে দেখিবার ও বুঝিবার যথাযথাদৃষ্টি ও বুদ্ধি দান করে, এবং ভবিষ্যতের সমাজসংস্থা কল্পনা করিবার এবং গড়িবার প্রেরণা সঞ্চার করে। আবার, এই দৃষ্টি ও প্রেরণাই তাঁহাকে ভূত অর্থাৎ অতীত এবং ভূতাৰ্থকে বুঝিতে, ধরিতে সাহায্য করে।

ঐতিহাসিকের ভাবনা

বলিয়াছি, মুসলিম-রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বের হিন্দুস্থানের অবস্থার কথা স্মরণ করিয়া প্রসিদ্ধ উর্দুভাষী কবি হালি বলিয়াছিলেন, ‘ইধর হিন্দমে হরতরফ আন্ধেরা’-‘এদিকে হিন্দুস্থানে তখন চারিদিকে অন্ধকার’! এ-কথার ঐতিহাসিক সত্যতা অস্বীকার করিবার উপায় নেই। বাঙলাদেশের পক্ষেও এ-কথা সমান প্রযোজ্য। বস্তুত, এদেশে বৈদেশিক মুসলিম-রাষ্ট্ৰশক্তির প্রতিষ্ঠা কিছু আকস্মিক ঘটনা নয়; দেবের অভিশাপ ও নয়; তাহা কার্যকরণ সম্বন্ধের অনিবার্য শৃঙ্খলায় বাধা। তখন দেশের সমসাময়িক সমাজের যে-অবস্থা তাহার মধ্যে একটা বিরাট ও গভীর বিপ্লব্যাবর্তের নানা ইঙ্গিত নিহিতই ছিল। কিন্তু সজ্ঞান সচেতনতায় সেই ইঙ্গিতকে ফুটাইয়া তুলিয়া তাহাকে সংহত করিয়া বৈপ্লবিক চিন্তা ও কর্মপ্রচেষ্টায় নিয়োজিত করিবার নেতৃত্ব সমাজের ভিতর হইতে উদ্ভূত হয় নাই। এই ধরনের বিপ্লব্যাবর্ত আপনা হইতেই ঘটে না; ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকিলেও সময় মন্ত বীজ না ছাড়াইলে ফুলস ফলে না। এদেশেও হইল তাঁহাই; সময় বহিয়া গেল, ফসল ফলাইবার কাজে কেহ অগ্রসর হইল না। তাহার দামও দিতে হইল; পঙ্গু ও দুর্বল, ক্ষীণায়ত ও শক্তিহীন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা বাহির হইতে এক একটি ধাক্কায় ধ্বসিয়া ধ্বসিয়া পড়িল এবং সেই সুযোগে বৈদেশিক রাষ্ট্ৰশক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া বসিয়া গেল।

সমাজদেহে যতদিন জীবনীশক্তি থাকে, ততদিন ভিতর-বাহির হইতে যত আঘাতই লাগুক সমাজ আপনি শক্তিতেই তাহাকে প্রতিরোধ করে; প্রত্যাঘাতে তাহাকে ফিরাইয়া দেয়, অথবা জীবনের কোনো ক্ষেত্রে, বা কোনো পর্যয়ে পরাভব মানিলেও অন্য সকল ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে নূতনতর শক্তিকে আত্মসাৎ করিয়া নিজেকেই শক্তিমান করিয়া তোলে। সমাজেতিহাসের এই যুক্তি প্রায় জৈব জীবনেরই বিবর্তনের যুক্তি। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস এই বিবর্তন-যুক্তির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এই যুক্তিতেই ভারতবর্ষ বার বার তাহার রাষ্ট্ৰীয় পরাধীনতাকে নূতনতর সমাজশক্তিতে রূপান্তরিত করিয়াছে, সকল আপাতবিরুদ্ধ প্রবাহকে বিরোধী শক্তিকে সংহত করিয়া তাহাকে নতুন রূপদান করিয়া নিজেকেই সমৃদ্ধ ও শক্তিমান করিয়াছে, সমাজদেহে জড়ের জঞ্জাল স্তুপীকৃত হইতে দেয় নাই।

কিন্তু নানা রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে, ব্যক্তি, বর্ণ ও শ্রেণীস্বর্থবৃদ্ধির প্রেরণায় সমাজদেহ যখন ভিতর হইতে ক্রমশ পঙ্গু ও দুর্বল হইয়া পড়ে তখন ভিতরে ভিতরে জাড়ের জঞ্জাল এবং মৃতের আবর্জনা ধীরে ধীরে জমিতে জমিতে পুঞ্জ পুঞ্জ স্তূপে পরিণত হয় : জীবনপ্রবাহ তখন আর স্বচ্ছ সবল থাকে না, মরুবালিরাশির মধ্যে তাহ রুদ্ধ হইয়া যায়, অথবা পঙ্কে পরিণত হয়। সমাজদেহে তখন ভিতর-বাহিরের কোনো আঘাতই সহ্য করিবার মতন শক্তি ও বীর্য থাকে না, প্রত্যাঘাত তো দূরের কথা। বিবর্তনের যুক্তিও তখন আর সক্রিয় থাকে না; বস্তুত, দান ও গ্রহণের, সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণের যে যুক্তি বিবর্তনের গোড়ায়, অর্থাৎ বিবর্তনের যাহা স্বাভাবিক জৈব নিয়ম তাহা পালন করিবার মতো শক্তিই তখন আর সমাজদেহে থাকে না।

সমাজের এই অবস্থাই বিপ্লবের ক্ষেত্র রচনা করে; বস্তুত, ইহাই বিপ্লবের ইঙ্গিত। কিন্তু ইঙ্গিত থাকিলেই, ক্ষেত্ৰ প্ৰস্তুত হইলেই বিপ্লব ঘটে না; সেই ইঙ্গিত দেখিবার ও বুঝিবার মত বুদ্ধি ও বোধ থাকা প্রয়োজন, ক্ষেত্রে ফসল ফলাইবার মত প্রতিভা ও কর্মশক্তি, সংহতি ও সংঘশক্তি থাকা প্রয়োজন। নহিলে ইঙ্গিত ইঙ্গিতই থাকিয়া যায়, সময় বহিয়া যায়, বিপ্লব ঘটে না। এমন অবস্থায় বাহির হইতে ঝড় আসিয়া যখন বুকের উপর ভাঙ্গিয়া পড়ে তখন আর তাহাকে ঠেকানো যায়না, এক মুহূর্তে সমস্ত ধূলিসাৎ হইয়া যায়, বিপ্লবের ইঙ্গিত অন্যতর, নূতনতর ইঙ্গিতে বিবর্তিত হইয়া যায়; ক্ষেত্রের চেহারাই অনেক সময় একেবারে বদলাইয়া যায়, একেবারে নূতন সমস্যা দেখা দেয়। আর, বাহির হইতে ঝড় না লাগিলে, যথাসময়ে বিপ্লব না ঘটাইলে, পঙ্গু ও দুর্বল, ক্ষীয়মান সমাজ-আপনা হইতেই তখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হইতে থাকে, এবং একদিন জৈব নিয়মেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়ে। তখন আবার ভ্রূণাবস্থা হইতে, অর্থাৎ প্রায় আদিম অবস্থা হইতে নূতন সমাজদেহের উদ্ভব ঘটে। উভয় ক্ষেত্রেই দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ ধরিয়া পরবর্তী কালকে তাহার মূল্য দিয়া যাইতে হয়।

বাঙলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসের গভীরে নানা দিক হইতে দেখিলে মনে হয়, বোধহয় সেই মূল্যই আজও আমরা দিতেছি, এবং পূর্ণ মূল্য না দিয়া অগ্রসর হইবার উপায়ও বোধহয় নাই।

 

।।১৫ আগস্ট, ১৯৪৯।।