১০. ঈশ্বরের ভাষাজ্ঞান

ঈশ্বরের ভাষাজ্ঞান

প্রশ্নটা অনেক সময়ে আমার মনে জেগেছে–কিন্তু তাই বলে খবরের কাগজে ছাপিয়ে উচ্চকণ্ঠে চিন্তা করিনি। প্রশ্নটা হচ্ছে: ঈশ্বর কি সব ভাষা বোঝেন? এ প্রশ্ন আমি বিশেষ কাউকে জিজ্ঞেসও করছিনে। কারণ উত্তরটা হয়তো সঠিক কারো জানা নেই।

প্রস্তাবনাটা এ রকম। আগে যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার তুলনায় অনেক খারাপ ছিলো, তখন পৃথিবীতে ভাষা ছিলো এখনকার চেয়ে অনেক বেশি। একএকটা ছোটো-ছোটো অঞ্চলের এক-একটা ভাষা। এক-একটা ছোটো-ছোটো জনগোষ্ঠীর এক-একটা ভাষা। অপর পক্ষে, এখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া সহজ হয়েছে। এক জায়গার ভাষা অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়াও সহজ। এমন কি, বইপত্র এবং বেতার-টেলিভিশনের কল্যাণে এখন কতোগুলো ভাষা বড়ো বড়ো অঞ্চলের প্রামাণ্য ভাষায় পরিণত হয়েছে। বস্তৃত, বই এবং সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে প্রধান ভাষাগুলো আরও প্রবল হয়ে উঠছে, আর তার ফলে মার খাচ্ছে ছোটো ভাষাগুলো। কোনো কোনো ভাষা একেবারে হারিয়েও যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও এখনো পৃথিবীতে ছ হাজারেরও বেশি ভাষা চালু আছে। প্রশ্ন হচ্ছে: এই ছ হাজার ভাষাই কি ঈশ্বর জানেন? এতোগুলো ভাষা শেখা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু তিনি যেহেতু গোটা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং কল্পনাতীত শক্তির অধিকারী এবং সব ভাষাই তাঁর পক্ষে শিখে ফেলা সম্ভব। তা ছাড়া, তাঁর যে রকম জনবল, তাতে তাঁর পক্ষে বিভিন্ন ভাষার ইন্টারপ্রেটার অথবা দোভাষী রাখারও কোনো সমস্যা নেই। এতো বিশাল মহাবিশ্বে নতুন নতুন অফিস ভবন তৈরিরও কোনো সমস্যা নেই। তদুপরি, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন!

কিন্তু রসিকতা থাক এমন উদ্ভট প্রশ্ন আমার মনে আসার কারণ কী? আপাতত দুটো কারণ বলছি। প্রথমটা হলো: পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় মানবতা-বিধ্বংসী এতো সব প্ৰলয় কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে যে, তার মধ্যে অসহায় লোকেরা সারাক্ষণই নিজেদের বাঁচানোর জন্যে আকুল কণ্ঠে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন। কিন্তু ঈশ্বর যে তার কিছু মাত্র প্রতিকার করছেন, দেখে-শুনে তা মনে হয় না। তা থেকে এমন ধারণা হতেই পারে যে, তিনি নির্দয় অথবা তিনি এসব ভাষায় ডাকলে বুঝতে পারেন না। তবে নির্দয় আমি তাঁকে বলছিনে, কেননা সবাই তাঁকে দয়াময় বলেই জানেন। এতোগুলো লোক না-বুঝেশুনে তাঁকে কি এমন একটা বিশেষণ দিলেন!! তা হতেই পারে না। তা হলে? বাকি থাকলো: অন্য সম্ভাবনাটি! অর্থাৎ তিনি সব ভাষা বোঝেন না। কিন্তু তাই বা মনে করি কি করে? ধৰ্মগ্রন্থগুলো একেবারে অসার না-হলে, যেসব ভাষায় এগুলো লেখা হয়েছে, তাঁর অন্তত সে ভাষাগুলো তো জানারই কথা! অথচ হিব্ৰু-ভাষী (যেমন ইসরাইলের), আরবি-ভাষী (যেমন ইরাকের), সংস্কৃত-ভাষী–সব ভাষাভাষী লোকেদেরই দুঃখ-কষ্টের সীমা নেই। তাঁরা তারস্বরে হাহাকার করে কপাল চাপড়ে ঈশ্বরকে ডেকে ডেকে স্বরভঙ্গ করে ফেলছেন, কিন্তু ঈশ্বর তবু নির্বিকার!

এ থেকে আরও একটা সম্ভাবনা মনের কোণে উঁকি দেয়। সে হলো: ঈশ্বর সব ভাষাই বোঝেন, কিন্তু তিনি সব প্রার্থনা মঞ্জর করেন না তার উপায়ও নেই। চোর নিরাপদে চুরি করে ফিরে আসার প্রার্থনা জানায়, বাড়ির মালিক তাঁর সম্পত্তি রক্ষা করার জন্যে প্রার্থনা করেন। হবু ধর্ষক সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে জিভা লকলক করতে করতে সাফল্য লাভের জন্যে প্রার্থনা জানায়, মানত করে, আর সুন্দরী মেয়েটি এবং তার স্বজনরা সে যাতে নিরাপদে ফিরে আসতে পারে, আকুল হৃদয়ে তার প্রার্থনা জানান। এই দু পক্ষের প্রার্থনাই মঞ্জুর করা সম্ভব নয়। অথবা এমনও হতে পারে যে, বিশ্বে যা কিছু ঘটে, তা ঈশ্বরের অজ্ঞাতেই ঘটে। ঈশ্বর শুধু কল্পনা! মনকে সান্তুনা দেবার প্রতীক। বিপদে আপদে রোগে শোকে ঈশ্বর নামটি সাহস জোগায়। কিন্তু এমন নাস্তিকের মতো কথা বলে আস্তিকদের মনে আঘাত দিতে আমি চাইনে।

ধরে নিচ্ছি, ঈশ্বর সব ভাষা বোঝেন। প্রশ্ন করতে পারেন: তা হলে তিনি বিশেষ বিশেষ ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পাঠালেন কেন? এর উত্তর খুব কঠিন নয়। ধর্মপ্রচার করেছেন। যে মহাপুরুষরা তাঁরা তা করেছেন তাঁদের মাতৃভাষায়। কারণ, ঈশ্বর জানলেও এই মহাপুরুষরা সব ভাষা জানতেন না। অথবা তারা যাদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করেছেন, তাঁরাও সব ভাষা জানেন না। তবে এ প্রশ্নের সহজ উত্তর থাকলেও যে-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শক্ত, তা হলো: ধর্মগুরু এবং ধর্মব্যবসায়ীরা এক-একটা ভাষাকে অন্যান্য ভাষার তুলনায় বেশি পবিত্র বলে দাবি করেন কেন? তাঁরা এমনভাবে এ দাবি করেন যা থেকে মনে হতেই পারে যে, সেই ভাষায় ঈশ্বরকে না-ডাকলে তিনি তার অর্থ বুঝতে পারবেন না অথবা সেই ভাষায় ডাকলে ঈশ্বর একটু বেশি সদয় হবেন।

ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছিলো আরব দেশে। এবং তখনকার আরবি ছিলো প্রাচীন আরবি। তা সত্ত্বেও বিশ্বের তাবৎ মুসলমান ঈশ্বরকে ডাকেন সেই প্রাচীন আরবি ভাষায়। ভাবখানা এমন যে, আরবিতে না-ডাকলে তিনি শুনবেন না, অথবা আরবিতে ডাকলে তাতে তিনি বেশি প্ৰসন্ন হবেন। পোপ তাঁর ধর্ম প্রচার করেন। ল্যাটিন ভাষায়। ল্যাটিন ভাষায় খৃস্টধর্ম প্রচারিত হয়নি। তা সত্ত্বেও ল্যাটিন ভাষায় বাইবেল আবৃত্তি করলে অথবা বাইবেলের বাণী প্রচার করলে বেশি পুণ্য হবে বলে মনে করেন অনেক খৃস্টান। বেদ-উপনিষদ লেখা হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়। আধুনিক বাঙালিরা সংস্কৃত জানেন না। পুরুতরাও কমই জানেন। আর যে-উচ্চারণে তাঁরা সংস্কৃত আওড়ান। তাতে শতায় হওয়ার আশীৰ্বাদ হতায়ু হওয়ার অভিশাপে পরিণত হয়। অর্থাৎ হিতে বিপরীত হয়। সুতরাং ধ্রুপদী ভাষার দেয়াল তুলে ধর্মকে সাধারণ মানুষের নাগাল থেকে দূরে রাখার কারণটা কী?

কারণের কথায় পরে আসি। তার আগে ইতিহাসের দিকে এক ঝলক তাকানো যাক। বেদ-উপনিষদ আবৃত্তি করতে হবে সংস্কৃত ভাষায় এবং তা করতে পারবেন একমাত্র ব্ৰাহ্মণরা–এই ছিলো হিন্দুধর্মের বিধান। তাই ধর্মগ্রন্থ দেশীয় ভাষায় শুনলে অথবা শোনালে তার শাস্তি হিশেবে নির্ধারিত হলো রৌরব নরকে গমন। অর্থাৎ ধৰ্মচর্চা করবেন ব্ৰাহ্মণরা, অন্যরা কেবল তাদের ব্যাখ্যা এবং অমৃতবাণী শুনেই ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাদের অষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করবেন। তাদের দক্ষিণা দেবেন। গৌতম বুদ্ধ এটা মানতে পারেননি। তিনি তাই ধৰ্ম প্রচার করেছিলেন মুখের ভাষা পালিতে। এভাবে তার ধর্ম আলাদা হয়ে গেলো বৈদিক ধর্ম থেকে।

খৃস্টধর্মের সে অর্থে কোনো প্রেরিত গ্ৰন্থ নেই। তবে যিশু খৃষ্টের বাণী তাঁর শিষ্যরা প্রচার করেছিলেন হিব্রু ভাষায়। কিন্তু কালে কালে খৃস্টধর্মের ভাষা হিশেবে দাঁড়িয়ে গেলো ল্যাটিন। কারণ, রোমে অবস্থিত পোপ হলেন খৃস্টধর্মের প্রধান নেতা। পােপরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ল্যাটিন ভাষায় খৃস্টধর্ম প্রচার করেছেন। তার ফলে সে ধর্ম দূরে সরে যায়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। ধর্ম প্রাত্যহিক জীবনের আচরিত বস্তু না-হয়ে পরিণত হয় একটা দুর্বোধ্য রহস্যে। ধর্মচৰ্চার অধিকার এবং ব্যবসা সীমিত থাকলো পুরুতদের মধ্যে। মার্টিন লুথার সেটা ভাঙতে চেষ্টা করলেন। তিনি প্রথমেই বাইবেলের অনুবাদ করলেন সাধারণ মানুষের ভাষায়। তিনি রহস্য উন্মোচন করে বাইবেলের বক্তব্য তুলে ধরলেন। সাধারণ মানুষের কাছে। ফলে ফতোয়া দিয়ে পোপ তাঁকে বহিষ্কার করলেন খৃস্টধর্মের আওতা থেকে। মধ্যযুগের বাঙালি কবি সৈয়দ সুলতান ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন বাংলা ভাষায়, এবং এটা অনেকে ভালো চোখে দেখেননি। তাঁর রচনা থেকে জানা যায় যে, তাকে অনেকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন, যদিও তিনি ধর্মের বাণী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই বাংলায় ধর্মের কথা লিখেছিলেন।

সারা পৃথিবীর মুসলমানরা মনে করেন যে, তাদের ধর্মীয় ভাষা হলো আরবি। পৃথিবীর যেখানেই তাঁরা বাস করেন না কেন, তাঁরা ধর্ম পালন করেন আরবি ভাষায়, বেশির ভাগই না-বুঝে। যেখানটায় হয়তো বলা হয়েছে কোন কোন মহিলাকে বিবাহ করা যাবে না–না-বুঝে সে কথা শুনেই হয়তো ধর্মভীরু মোমিন ফুপিয়ে কেঁদে ওঠেন। অথচ ধর্মগ্রন্থের মূল বিধান তাঁদের কাছে রয়ে যায় অজানা। অনেক সময়ে তাই কুসংস্কারকেও তাঁরা গণ্য করেন ধর্ম বলে।

মোট কথা, কোনো বিশেষ ভাষাকে পবিত্র বলে বিবেচনা না-করে সাধারণ মানুষের ভাষায় যদি ধর্মের বাণী প্রচার করা হয়, তা হলে চোরে না-শুনলেও, সাধারণ ভক্ত শুনতে এবং খানিকটা বুঝতে পারবেন। এমন কি, সে বাণী থেকে কিছু শিক্ষা হয়তো বাস্তব জীবনে গ্রহণও করতে পারেন। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এ যদি তারা সত্যি বিশ্বাস করেন, তা হলে, সেই ঈশ্বর নিশ্চয় সব ভাষাই বুঝতে পারবেন। তা হলে এই সত্য আমরা উপলব্ধি করতে পারবো যে, কোনো ভাষা পবিত্র অথবা অপবিত্র নয়–সব ভাষাই আসলে কেবল ভাব প্রকাশের বাহন।

(যুগান্তর, ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *