০৮. বৌদ্ধ লেখক শান্তিদেব

বৌদ্ধ লেখক শান্তিদেব

আমি মনে করি যে, যিনি বৌদ্ধ ধর্মের কয়েকখানি খুব চলিত পুঁথি লিথিয়া গিয়াছেন, সেই মহাত্মা শান্তিদেব বাঙালী ছিলেন। কিন্তু তারানাথ আমার বিরোধী। তিনি বলেন, শান্তিদেবের বাড়ি সৌরাষ্ট্রে ছিল। দুঃখের বিষয় এই যে, আমি শান্তিদেবের যে অমূল্য জীবনচরিতখানি পাইয়াছি, তাহাতে কে তাঁহার জন্মভূমির নামটি কাটিয়া দিয়াছে- এমন করিয়া কাটিয়াছে যে, পড়িবার জো নাই ! কিন্তু তাঁহার লীলাক্ষেত্র মগধের রাজধানী ও মালদা। তিনি যখন বাড়ি হইতে বাহির হন, তাঁহার মা বলিয়া দিয়াছিলেন, “তুমি মঞ্জুঞ্জান লাভ করিবার জন্য মঞ্জুবজ্রসমাধিকে গুরু করবে।” সৌরাষ্ট্রে মঞ্জুশ্রীর প্রাদুর্ভাব বড় শোনা যায় না। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাদুর্ভাবই বড় কম ছিল।

তাঁহাকে বাঙালী বলিয়া মনে করিবার আরও একটি কারণ আছে। নালন্দায় তাঁহার একটি ‘কুটী’ বা কুঁড়ে ঘর ছিল। লোকে দেখিত, তিনি যখন ভোজন করিতে বসিতেন তাঁহার মুখ প্রসন্ন থাকিত, যখন শয়ন করিতেন তাঁহার মুখ প্রসন্ন থাকিত, যখন কুঢ়ীতে বসিয়া থাকিতেন তখনও তাঁহার মুখ প্রসন্ন থাকিত ; সেইজন্য—

ভুঞ্জানোপি প্রভাস্বরঃ
সুপ্তোপি প্রভাস্বরঃ
কুটীং গতোপি প্রভাস্বরঃ।

এই জন্যে তাঁহার নাম হইয়াছিল ‘ভুসুকু’। তিনি যখন মগধের রাজধানীতে থাকিতেন, তখন তিনি রাউতের কার্য করিতেন। এমন কতগুলি বাংলা গান আছে, যাহার ভণিতায় লেখা আছে ‘রাউতু ভণই কট, ভুসুকু ভণই কট।’ এখন এই রাউতু, ভুসুকু ও শান্তিদেব একই ব্যক্তি কিনা, ইহা ভাবিবার কথা। তিনজনই এক, ইহাই অধিক সম্ভব।

আরও এক কথা, শান্তিদেব তিনখানি পুস্তক লিখিছেন–(১) সূত্র সমুচ্চয়, (২) শিক্ষাসমুচ্চয় ও (৩) বোধিচর্যাবতার। শেষ দুইখানি পাওয়া গিাছে ও ছাপা হইয়াছে। প্ৰথমখানি এখনও পাওয়া যায় নাই। কিন্তু ভুসুকুর নামে আমরা একখানি বই পাইয়াছি, সেখানি ভুসুকুর লেখা। উপরের দুইখানির মত এইখানিও সংস্কৃতে লেখা, তবে মাঝে মাঝে বাঙ্গলা আছে। উপরের দুইখানির মধ্যেও আবার শিক্ষাসমুদয়ে অনেক অংশ সংস্কৃত ছাড়া অপর আর এক ভাষায় লেখা ! এখন আপত্তি উঠতে পারে যে, শান্তিদেবের যে দুইখানি পুস্তক ইতিপূর্বেই পাওয়া গিয়াছিল, সে দুইখানিই মহাযানের বই ; শেষে যেখানি পাওয়া গিয়াছে, সেখানি হয় বজ্রযানের, নাহয় সহজযানের। এক লোক কি দুই যানের পুস্তক লিখে? এ সম্বন্ধে বেন্‌ডল সাহেব বলেন যে, শিক্ষ-সমুচ্চয়েও তান্ত্রিক ধর্মের অনেক কথা পাওয়া যায়। আমরাও দেখিয়াছি যে, বজ্রযান সহজযান ও কালচক্রযান মহাযানছাড়া নয়। এই সকল যানের লোকেরা মনে করিত যে, “আমরা মহাযানেরই লোক, কেবল আমরা মহাযানকে সহজ করিয়া তুলিয়াছি ও উহার অনেক উন্নতি করিয়াছি।” এখনও নেপালী বৌদ্ধেরা বলে, “আমরা মহাযান বৌদ্ধ।” কিন্তু তাহারা বাস্তবিক বজ্রযান বা সহজযানের উপাসক।

বোধিচর্যাবতারে শান্তিদেব বার বার বিপক্ষদের একটি কথা বলিয়া গালি দিয়াছেন। সে গালিটি কিন্তু বাংলা ছাড়া আর কোথাও শুনি নাই ; সে কথাটি ‘গূথ-ভক্ষক’। আমাদের দেশে দিনরাত্রি এই গালিটি শুনা যায়।

আরও কথা, একটি ভুসুকর গানে আছে,–
আজ ভুসুকু তু ভেলি বাঙ্গালী।
নিজ ঘরিণী চণ্ডালী নেলী।
আজ ভুসুকু তুই সত্য সত্য বাঙ্গালী হইয়াছিল ইত্যাদি।

এই সকল কারণে আমি শান্তিদেবকে আমাদের অষ্টম গৌরব মনে করি। তেঙ্গুর গ্রন্থে লেখা আছে, শান্তিদেবের বাড়ি জাহোর। জাহোর কোথায় জানি না, তবে উহার সন্ধান হওয়া আবশ্যক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *