০৭. নারীসঙ্গম ও তন্ত্রধর্ম

নারীসঙ্গম ও তন্ত্রধর্ম

হিন্দু ধর্মের এক বিশেষ “ইডিয়াম” হচ্ছে তান্ত্রিক সাধনা, তান্ত্রিক সাধকদের মধ্যে যাঁরা বামাচারী তাদের নারী সঙ্গমই হচ্ছে সাধনার প্রধান অঙ্গ । কিভাবে ধর্মের সঙ্গে নারী সঙ্গম জড়িত হয়ে পড়েছিল তার বিবরণ নীচে দিচ্ছি।

সকলেরই জানা আছে যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল ভূমিকৰ্ষণ নিয়ে। ভূমিকৰ্ষণই মানুষকে বাধ্য করেছিল স্থায়ী বসবাস স্থাপনে। এই স্থায়ী বসবাস প্ৰথমে গ্রামের রূপ নিয়েছিল, পরে বিকশিত হয়েছিল নগরে ৷ স্থায়ী বসবাস স্থাপনের পূর্বে মানুষ ছিল যাযাবর প্রাণী। কেননা, তখন পশুমাংসই ছিল তার প্রধান খাদ্য । পশুশিকারের জন্য তাকে স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করতে হত । পশুশিকার ছিল পুরুষের কর্ম। আর ভূমিকৰ্ষণের সূচনা করেছিল মেয়েরা। পশু শিকারে বেরিয়ে পুরুষের যখন ফিরতে দেরি হত, তখন মেয়ের ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল (ইভের গাছের ফল খাওয়া তুলনা করুন) এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্য শস্য খেয়ে প্ৰাণধারণ করত । তারপর তাদের ভাবনাচিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা । সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেইহেতু তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি (আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্ৰেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা “ভূমি” বলে বর্ণনা করা হয়েছে) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন ? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক ষষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমি কর্ষণ করতে থাকে ( Przyluski তাঁর “Non-Aryan Loans in Indo Aryans” প্ৰবন্ধে দেখিয়েছেন যে “লিঙ্গ”, “লাঙ্গুল” ও “লাঙ্গল” এই তিনটা শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন ) । মেয়েরা এইভাবে ভূমিকৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল । যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল, তখন পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। লক্ষ্য করল লিঙ্গপুরী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active | Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর যে প্রথম নবান্ন উৎসব হল সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। এ সম্বন্ধে Clodd তার Animism গ্রন্থে বলেছেন :

“In earth worship is to be found the explanation of the mass of rites and ceremonies to ensure fertilisation of the crops and cattle and woman herself.” এ থেকে কিভাবে লিঙ্গ ও শক্তিপূজার উদ্ভব হল, সে সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা অবগত হবার জন্য বর্তমান লেখকের “Pre-Aryan Elements in Indian Culture”, Calcutta Review 1931 দেখুন।

।। দুই ।।

এই আদিম ধারণা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল শিব ও শক্তির কল্পনা । এবং এদের উপাসনা নিয়েই উদ্ভূত হয়েছিল তন্ত্রধর্ম। সুতরাং তন্ত্রধর্মটা হচ্ছে মূলত এক অতি প্ৰাচীন ধর্ম, যদিও পরবর্তীকালে এটা বিকশিত হয়েছিল নানারূপে । শিব ও শক্তির আরাধনা মোটেই বৈদিক উপাসনা পদ্ধতির অন্তভুক্ত ছিল না। লিঙ্গ পূজা নবপলীয় যুগ থেকেই হয়ে এসেছে (লেখকের “Beginnings of Linga Cult in India” in Annals of the Bhandarkar Oriental Institute’’ 1929 দ্রষ্টব্য) । আর আদি শিব ও মাতৃকাদেবীর পূজার অজস্র নিদর্শন আমরা প্ৰাগাৰ্য সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্ৰসমূহে পেয়েছি। সিন্ধুসভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা । কিন্তু আর্যরা প্ৰথমে কৃষিকৰ্ম জানতেন না । এটা শতপথব্ৰাহ্মণের (২।৩৭-৮ ) এক উক্তি থেকে প্ৰকাশ পায় । সেখানে বলা হয়েছে-“প্রথমতঃ দেবতারা একটি মানুষকে বলিস্বরূপ উৎসর্গ করলেন, তার উৎসর্গীকৃত আত্মা অশ্বদেহে প্ৰবেশ করল। দেবতারা অশ্বকে উৎসর্গ করলেন। উৎসগীকৃত আত্মা অশ্বদেহ হতে পুনরায় বলীবৰ্দে প্ৰবেশ করল। বলীবর্দকে উৎসর্গ করা হলে, ওই আত্মা মেষদেহে প্ৰবিষ্ট হল । মেষ উৎসর্গীকৃত হলে, উহা ছাগদেহে প্রবিষ্ট হল । ছাগ উৎসৰ্গীকৃত হলে, পৃথিবীতে প্ৰবেশ করল । দেবতারা পৃথিবী খনন করে গম ও যাব আকারে ওই আত্মাকে পেলেন । তদবধি সকলে শস্যাদি কর্ষণ দ্বারা পেয়ে থাকে।” শতপথব্রাহ্মণের এই বিবরণটি অত্যন্ত অর্থদ্যোতক । এর মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় লুক্কায়িত আছে আর্যদের কৃষ্টির ইতিহাস। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে আর্যর প্রথমে ভূমিকৰ্ষণ দ্বারা শস্যাদি উৎপাদন করতে জানত না । সুতরাং তাদের মধ্যে তন্ত্রধর্মের প্রচলন ছিল না ।

আমি বহুকাল ধরে বহু জায়গায় বলে এসেছি যে আর্যরা যখন এদেশে আসে, তখন তাদের সঙ্গে মেয়েছেলের সংখ্যা ছিল কম । সেজন্য তারা অনার্য রমণীদের বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। ‘গৃহিণী গৃহমুচ্যতে’, এই বচন অনুযায়ী অনার্য রমণী যখন গৃহিণী হয়ে বসলেন, তখন তিনি ধর্ম সম্বন্ধে আৰ্য চিন্তাধারাকে প্ৰভাবান্বিত করলেন । তখনই শিব ও শিবানীর অনুপ্ৰবেশ আর্য দেবতামণ্ডলীতে ঘটল । প্ৰথমেই শিবের কথা ধরুন । বৈদিক রুদ্রদেবতা যে মহেঞ্জোদারোর আদি শিবের প্রতিরূপেই কল্পিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । কেননা ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে রুদ্র সুবর্ণ নির্মিত অলঙ্কার ধারণ করেন, এবং মহেঞ্জোদারোয় আমরা আদি-শিবের যে মূর্তি পেয়েছি, সেখানেও আমরা আদি-শিবকে বাহুতে ও কণ্ঠে অলঙ্কার ধারণ করতে দেখি । বৈদিক রুদ্র যে আর্যদের একজন অর্বাচীন দেবতা ছিলেন, তা বুঝতে পারা যায়। এই থেকে যে, সমগ্ৰ ঋগ্বেদে তাঁর উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি স্তোত্র রচিত হয়েছিল, এবং অগ্নিদেবতার সঙ্গে তাঁর সমীকরণ করা হয়েছিল। আর্যরা যখনই তঁদের দেবতামণ্ডলীতে কোন নূতন দেবতার পত্তন করতেন, তখনই অগ্নির সঙ্গে তাঁর সমীকরণ করে নিতেন । এটা কালী ও করালীর অনুপ্রবেশের সময়ও করা হয়েছিল, অথচ আমরা জানি কালী ও করালী অনার্য দেবতা । এখানে উল্লেখযোগ্য যে সংস্কৃতে ‘রুদ্র’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্তবর্ণ, এবং দ্রাবিড় ভাষাতেও ‘শিব’ শব্দের মানে হচ্ছে ‘রক্তবর্ণ’ । এছাড়া শতপথ ব্ৰাহ্মণে বলা হয়েছে যে ‘শৰ্ব’ ও ‘ভব’ এই দেবতাদ্বয় প্রাচ্য দেশীয় অসুরগণ ও বাহকগণ কর্তৃক পূজিত হন । কিন্তু বাজসনেয়ী সংহিতায় এ দুটি দেবতা অশনি, পশুপতি, মহাদেব, ঈশান, উগ্ৰদেব প্ৰভৃতির সঙ্গে আর্য দেবতামণ্ডলীতে স্থান পেয়ে অগ্নি দেবতার সঙ্গে সমীকৃত হয়েছেন । অগ্নিদেবতার সঙ্গে সমীকরণের ফলে শেষের দিকের বৈদিক সাহিত্যে আমরা হর, মৃন্দ, শর্ব, ভব, মহাদেব, উগ্র, পশুপতি, শঙ্কর, ঈশান-প্ৰভৃতি দেবতাকে শিবের সঙ্গে অভিন্ন হিসাবে দেখি । বৈদিক রূদ্রাগ্নির উপাসনাই এটাকে সম্ভবপর করেছিল । এ সম্বন্ধে বেরিয়েডেল কীথের একটা মন্তব্য বিশেষ প্ৰণিধানযোগ্য । তিনি বলেছেন- “এ প্রশ্ন মনে উদয় হয় যে বৈদিক যুগের শেষের দিকের রুদ্র দেবতার মধ্যে আমরা একাধিক দেবতার সমন্বয় ও আর্য মানসিকতার ওপর অনার্য প্রভাব পাই কিনা ? এটা নিশ্চয়ই সম্ভবপর যে কতকগুলি অরণ্য, পর্বত ও কৃষি সংক্রান্ত দেবতা বা মৃতাত্মা সম্পকিত দেবতা বৈদিক রুদ্র দেবতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শিবরূপে কল্পিত হয়েছিল । পরবর্তী কালের শিবের মধ্যে আমরা কৃষি সম্পকিত অনেক ধ্যান-ধারণা লক্ষ্য করি এবং দেখতে পাই যে শিবের লিঙ্গ পূজা যে ঋগ্বেদে নিন্দিত হয়েছে তা হিন্দুদের মধ্যে যেরূপ জনপ্রিয়, ভারতের আদিবাসিগণের মধ্যেও সেরূপ জনপ্রিয় ” (A.K. Sur. “Pre-Aryan Elements in indian Culture”, Calcutta Review 1931 দ্রষ্টব্য)।

এবার দেবীপূজার কথা বলি। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, প্রভৃতি নগরে দেবীপূজার যে ব্যাপক প্ৰচলন ছিল, তা মৃন্ময়ী মাতৃকাদেবীর মূৰ্তিসমূহ থেকে প্ৰকাশ পায় । পুরুষ দেবগণ কর্তৃক অধিকৃত ঋগ্বেদের দেবতামণ্ডলীতে মাতৃদেবীর কোন স্থান ছিল না । পরবর্তীকালে যখন সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটেছিল, তখনই প্ৰাগাৰ্য দেবীসমূহের হিন্দুধর্মে অনুপ্রবেশ ঘটে। যেমন বৈদিক যুগের অন্তিমে আমরা কালী, করালী প্রভৃতি দেবীর নাম পাই। কিন্তু তখনও তাঁরা তাদের মৌলিক স্বরূপ বা স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে অনুপ্রবেশ করতে পারেন নি। তাঁরা বৈদিক অগ্নি উপাসনারই অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন । কিন্তু আর্যরা যত পূর্বদিকে অগ্রসর হতে লাগলেন, তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ততই হ্রাস পেতে লাগল। তখন এইসব অনার্য দেবতা বেশ রীতিমত হানা দিয়ে আর্যমণ্ডলীতে তাঁদের আসন করে নিলেন। পুরাণাদি গ্রন্থে আমরা বিন্ধ্যবাসিনী, পর্ণশবরী প্রভৃতি দেবীকে অনার্যদেবীর স্বরূপেই পাই। তারপর মাতৃপূজা প্ৰাগাৰ্য তন্ত্রধর্ম ও ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মকে প্রভাবান্বিত করে। ( লেখকের ‘সিন্ধুসভ্যতার স্বরূপ ও অবদান” জিজ্ঞাসা, পৃষ্ঠা ৫৬-৫৮ দেখুন । )

।। তিন ॥

অথর্ববেদের পঞ্চদশ কাণ্ডে যে ব্রাত্যধর্মের বর্ণনা আছে, তা প্ৰাচ্য ভারতে প্ৰচলিত তন্ত্রধর্মেরই অনুরূপ কোন ধর্ম। তঁদের ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের জন্য আর্যরা প্ৰথমে ব্রাত্যদের ঘৃণা করতেন। আর্যরা বলতেন তারা বেদবিহিত কোন যজ্ঞাদি ক্রিয়া করবার অধিকারী নয় । কিন্তু পরে অথর্ববেদের যুগে তাদের মনোভাব পরিবর্তিত হয়। কেননা, অথর্ববেদের সমস্ত পঞ্চদশ কাণ্ডটাকেই ব্রাত্যমহিমা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—“ব্রাত্য পুরুষ মহানুভব, দেবপ্রিয়, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় তেজের মূল, অধিক কি ব্রাত্য পুরুষ দেবাদিদেব।” ব্রাত্যধর্মের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এর অনেক উপাদানই তন্ত্রধর্মের উপাদান । এটাই প্ৰাচ্যভারতের ধর্ম ছিল । অন্যত্র আমি উল্লেখ করেছি যে বৈদিক আৰ্যদের (Nordics) এদেশে আসবার পূর্বে আর এক আর্যভাষাভাষী দল (Alpines) এদেশে এসেছিল । তাদের আদি পিতৃভূমিতে দুই দলের মধ্যে বিরোধ ঘটার দরুণ, শেষোক্ত দল নিজ পিতৃভূমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল । এরা (Alpines) ছিল কৃষিজীবীর দল, আর অপররা (Nordics) ছিল পশুশিকারীর দল । সুতরাং কৃষিপরায়ণ ছিল বলেই এদের মধ্যে শক্তিপূজার প্রচলন ছিল । আমি আমার “বাঙলার সামাজিক ইতিহাস”-এ বলেছি যে এরা শেষ পর্যন্ত বাঙলা দেশে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। বাঙলা দেশে এসে যখন তারা পৌঁছেছিল তখন তাদের সেখানে সাক্ষাৎ হয়েছিল অপর এক কৃষিপরায়ণ জাতির সঙ্গে, যাদের মধ্যেও মাতৃপূজার প্রচলন ছিল। (আনন্দবাজার পত্রিকার ১৯৭৯ সালের বার্ষিক সংখ্যায় লেখকের ‘বাঙলা কি সভ্যতার জন্মভূমি’ প্রবন্ধ দেখুন )। সান্নিধ্যে থাকার দরুন পরস্পরের মধ্যে যে মাত্র রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল ( লেখকের ‘বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়”, জিজ্ঞাসা, দেখুন ) তা নয়, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণও ঘটেছিল। এই সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের যুগেই তান্ত্রিক ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল ।

।। চার ।।

তন্ত্রধর্মের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মত প্ৰচলিত আছে। হিন্দুরা বলেন যে, তন্ত্রধর্মের বীজ বৈদিক ধর্মের মধ্যেই নিহিত ছিল। আর, বৌদ্ধরা দাবী করেন যে, তন্ত্রের মূল ধারণাগুলি ভগবান বুদ্ধ যে সকল, মুদ্রা, মন্ত্র মণ্ডল, ধারণা, যোগ প্রভৃতির প্রবর্তন করেছিলেন তা থেকেই উদ্ভূত। মনে হয় তন্ত্রধর্মের আসল উৎপত্তি সম্মন্ধে সূত্ৰকৃতঙ্গ’ নামে এক প্ৰাচীন জৈনগ্রন্থ বিশেষ আলোকপাত করে । এটা সকলেরই জানা আছে যে, তন্ত্রের আচার-অনুষ্ঠান ও পদ্ধতি অত্যন্ত গূঢ় এবং উক্ত প্ৰাচীন জৈনগ্রন্থ অনুযায়ী গূঢ় সাধন পদ্ধতি শবর, দ্রাবিড়, কলিঙ্গ ও গৌড় দেশবাসীদের এবং গন্ধৰ্বদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। মনে হয় এই জৈন গ্রন্থের কথাই ঠিক, কেননা, তান্ত্রিক সাধনসদৃশ ধৰ্মপদ্ধতি পূর্ব ভারতের প্রাক্‌-বৈদিক জনগণের মধ্যেই প্রচলিত ছিল এবং উহাই ‘ব্রাত্যধৰ্ম’ বা অনুরূপ কোন ধর্ম হবে । ( লেখকের “History & Culture of Bengal” গ্রন্থ দেখুন )। পরে বৌদ্ধ ও ব্ৰাহ্মণ হিন্দুরা যখন উহা গ্রহণ করেছিল, তখন তারা দার্শনিক আবরণে তাকে মণ্ডিত করেছিল । প্ৰায় ষাট বছর আগে এ সম্বন্ধে বক্ৰেশ্বরের বিখ্যাত তান্ত্রিক অঘোরীবাবা যা বলেছিলেন তাও এখানে প্ৰণিধানযোগ্য । তিনি বলেছিলেন, “বেদের উৎপত্তির বহু শতাব্দী পূর্বে তন্ত্রের উৎপত্তি । তন্ত্র মন্ত্রমূলক নয়, ক্রিয়ামূলক । অনার্য বলে আর্যরা যাদের ঘৃণা করতেন, সেই দ্রাবিড়দের ভাষাতেই তন্ত্রের যা কিছু ব্যবহার ছিল । পুঁথিপুস্তক তো ছিল না, বেদের মতই লোকপরম্পরায় মুখে মুখে তার প্রচার ছিল । সাধকদের স্মৃতির মধ্যেই তা বদ্ধ ছিল । তার মধ্যে ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র জাতির নামগন্ধও ছিল না। কারণ, তন্ত্রের ব্যবহার যে-সব মানুষকে নিয়ে, তার মধ্যে জাত কোথায় ? সাধারণ মানুষের ধৰ্মকৰ্ম নিয়েই তো তন্ত্রের সাধন । তন্ত্রের জগতে বা অধিকারে ঘৃণার বস্তু বলে কিছুই ছিল না । শবসাধন, পঞ্চমুণ্ডি আসন, মদ্য-মৎস্যমাংসের ব্যবহার এ সবই তো তন্ত্রের, আর্য ব্ৰাহ্মণদের ধারণায় ভ্ৰষ্টাচার । শুদ্ধাচারী ব্ৰাহ্মণরা যতদিন বাঙলায় আসেন নি, ততদিন তাঁদের এ ভাবের যে একটা ধর্ম সাধনা আছে, আর সেই ধর্মের সাধন প্রকরণ তাদেরই একদল গ্রহণ করে ভবিষ্যতে আর একটি ধর্ম গড়ে তুলবেন, একথা তারা কল্পনায়ও আনতে পারেন নি। তারপর তন্ত্রের ধর্ম গ্রহণ করে ক্রমে ক্রমে তারা অনার্যই হয়ে পড়লেন–তাঁদের বৈদিক ধর্মের গুমোর আর কি রইল ?” ( প্ৰমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, “তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ” ) । বস্তুত খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধ যখন প্ৰাচ্যভারতে ধর্মপ্রচারে ব্যাপৃত ছিলেন, তখন লোকায়ত ধর্ম হিসাবে তন্ত্রধর্মেরই এখানে প্ৰচলন ছিল । এটা আগে উদ্ধত জৈনসূত্র থেকেই আমরা জানতে পারি । নারীসঙ্গমই হচ্ছে তন্ত্রধর্মের একটা প্ৰধান অঙ্গ । বুদ্ধ প্ৰথমে সঙ্ঘের মধ্যে নারীদের প্রবেশের বিরোধী ছিলেন । কিন্তু পরে তিনি তার ধর্মের প্রতি জনপ্ৰিয়তালাভের জন্য, এটা এড়াতে পারেন নি। বুদ্ধ সঙ্ঘে নারীকেও স্থান দিয়েছিলেন । তখন থেকেই ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীর সৃষ্টি হয় । বৌদ্ধ সঙ্ঘে নারীর প্রবেশ ঘটেছিল বটে, কিন্তু তান্ত্রিক বা তৎসদৃশ কোন গুহ্য সাধনপদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটে নি। এটা ঘটেছিল অনেক পরে । কি করে সেটা ঘটেছিল, সেটা জানতে হলে, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসটা সংক্ষেপে বলা দরকার । বুদ্ধের ধর্মমত বুদ্ধের জীবনকালে লিপিবদ্ধ হয় নি। এর ফলে তাঁর মৃত্যুর পর তার ধর্মমত নানাভাবে ব্যাখ্যাত হতে থাকে । বিশেষ করে ‘নির্বাণ’ ও’করুণা’- এই দুটি শব্দের অর্থ নিয়ে । এর ফলে সঙ্ঘের মধ্যে নানা শাখার উদ্ভব হয় । সম্রাট অশোকের পূর্বেই বৌদ্ধসঙ্ঘের মধ্যে আঠারটি শাখার উদ্ভব ঘটেছিল। পরে এগুলি দুই প্ৰধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়— হীনযান ও মহাযান । মহাযানীদের মধ্যে তান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডের অনুপ্ৰবেশ ঘটে । এর ফলে বজ্রযান নামে এক নূতন যানের উদ্ভব ঘটে । বজ্ৰযানের আবার বিবর্তন হয় কয়েকটি শাখাতে । তার মধ্যে সহজযান ও কালচক্রযান বিশেষ প্রভাবশালী হয় । যদিও হীনযানীদের গ্রন্থসমূহে কিছু কিছু হিন্দুদেবতার, যথা–ইন্দ্ৰ, ব্ৰহ্মা, কুবের, বসুধারা প্ৰভৃতির নাম পাওয়া যায়, তাদের কিন্তু কোন দেবতামণ্ডলী ছিল না । ভগবান বুদ্ধের ন্যায় তারা মূর্তিপূজার বিরোধী ছিল । তবে তারা বুদ্ধের ব্যবহৃত জিনিস এবং প্রতীকের, যেমন পদচিহ্ন, বোধিবৃক্ষ, ধৰ্মচক্ৰ ইত্যাদি বহুবিধ চিহ্ন পাথরে খোদাই করে, তৎপ্রতি তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করত। তারপর বুদ্ধের মূৰ্তি তৈরি করা হয়। কোথায় এবং কাদের দ্বারা বুদ্ধের মূতি প্ৰথম তৈরি হয়েছিল সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে । অনেকে বলেন যে, গ্ৰীক বৌদ্ধরাই গান্ধার ভাস্কর্ষে প্ৰথম বুদ্ধের মূতি তৈরি করেছিল । আবার অনেকে বলেন, এটা মথুরা ভাস্কর্যেই প্ৰথম আত্মপ্ৰকাশ করেছিল । গান্ধার ভাস্কর্যে শুধু বুদ্ধের নয়, জম্ভল, হারতী ও বোধিসত্ত্বদের মূর্তিও তৈরি হয়েছিল । অবশ্য মথুরা ভাস্কর্যেও এ সব মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, এবং তা ছাড়া কুবের, যক্ষ, নাগ প্ৰভৃতির মূর্তি দৃষ্টিগোচর হয় । গুপ্তযুগের আগে পর্যন্ত হীনযানের প্রভাবই খুব বেশি ছিল । মহাযানের দু-একটি বোধিসত্ত্ব ছাড়া, আর কোন দেবতার মূর্তি বড় একটা দেখা যায় না। মহাযান যখন বজ্ৰযানে বিকশিত হয় তখনই এক বিশাল বৌদ্ধ দেবতামণ্ডলীর উদ্ভব হয় । বজ্রযান ছিল বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম। এই ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল পূর্বভারতে বাঙলাদেশে, এবং নিঃসন্দেহে বাঙলার লোকায়ত তান্ত্রিক ধর্মের প্রভাবে । তারানাথের মতে তন্ত্রের উৎপত্তি বহু পূর্বেই হয়েছিল, কিন্তু উহা সুপ্ত অবস্থায় ছিল, এবং গোপনভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় লুক্কায়িত ছিল। পালরাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ও সিদ্ধাচার্যদের সক্রিয় প্রভাবে উহা জনপ্রিয় হয়ে উঠে । বাজ্রযানের চারটি কেন্দ্র বা পীঠস্থান ছিল, উড্ডীয়ান, কামাখ্যা, শ্ৰীহট্ট ও পূর্ণগিরি। এই চারটি পীঠস্থানেই একটা করে বজ্রযোগিনীর মন্দির ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে বজ্রযানের বিশেষ শ্ৰীবৃদ্ধি হয় এবং খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রবলভাবে চলে । বৌদ্ধরাই তন্ত্রের গূঢ় সাধন-পদ্ধতি লিখিতভাবে প্রথম প্ৰকাশ করে। তারা যে তন্ত্রগ্রন্থ প্রথম রচনা করে তার নাম হচ্ছে গুহ্যসমাজতন্ত্র । সম্ভবত খ্ৰীষ্ট্ৰীয় চতুর্থ শতাব্দীতে অসঙ্গ কর্তৃক এ-খানা রচিত হয়েছিল । বইখানি বরোদার গায়কোয়াড় ওরিয়েণ্টাল সিরিজে প্ৰকাশিত হয় । এই সিরিজে বজ্রযান সম্বন্ধে আরও তিনখানা বই প্ৰকাশিত হয়েছিল, যথা ‘অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ’, ‘নিষ্পন্নযোগাবলী’ ও ‘সাধনমালা’ ; কিন্তু সবগুলিই এখন দুষ্প্রাপ্য। এছাড়া আরও বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থ ছিল। যদিও বলা হয় যে, বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা ৭৪ ; তা হলেও বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে এদের সংখ্যা বহু সহস্ৰ ।

বজ্রযানকে সহজযান বা সহজিয়া ধৰ্মও বলা হত । এই ধর্মকে ‘সহজ’ বলবার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, এ সহজ পথে মানুষকে আত্মোপলদ্ধির পথে নিয়ে যেত । সহজাত মনুষ্যস্বভাবকে অতিক্রম করবার চেষ্টা না করে, স্বভাবের অনুকূল পথ অবলম্বন করে আত্মোপলব্ধি করাই সহজ পথ । সহজিয়ারা বলেন যে মন্ত্রতন্ত্র, ধ্যানধারণা হচ্ছে বৃথা, মহাসুখ স্বরূপ সহজের উপলব্ধিই হচ্ছে পরম নিৰ্বাণ । যারা সহজপথে যান, তাঁদের আর জন্মমৃত্যুর আবর্তের মধ্যে ফিরে আসতে হয় না । এই বৌদ্ধ চিন্তাধারাই আমরা চর্যাপদসমূহের মধ্যে লক্ষ্য করি । সহজপথে নির্বাণ লাভ করা যায়, গুরু উপদেশে ও সহজপথে সাধনার দ্বারা । দেহই হচ্ছে এ সাধনার অবলম্বন। ‘দেহভাণ্ডই হচ্ছে ক্ষুদ্রাকৃতি ব্ৰহ্মাও । মহাসুখের মধ্যে চিত্তের নিঃশেষ নিমজনই হল পরম নির্বাণ ।

।। পাঁচ ।।

বজ্রযানের দেবতামণ্ডলী ও সাধনা সম্বন্ধে কিছু বলব। বজ্রযানীদের কল্পনায় আদি-বুদ্ধই হচ্ছেন সৃষ্টির কারণ। তিনি সর্বব্যাপী। সৃষ্টির প্রত্যেক অণুপরমাণুতে তিনি বিদ্যমান। সেজন্য সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই স্বভাবসিদ্ধ শূন্যরূপ নিঃস্বভাব ও বুদ্ধদস্বরূপ । কেবল শূন্যই নিত্য । আদি-বুদ্ধই হচ্ছেন এই শূন্যের রূপকল্পনা । এই শূন্যই হচ্ছে ‘বজ্র’ । সেজন্য দেবতা হিসাবে আদি-বুদ্ধকে বজ্রাধর বলা হয়। তাঁর শক্তি প্ৰজ্ঞাপারমিত । কোন মূর্তিতে তাকে প্রজ্ঞাপারমিতার সঙ্গে যুগনদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় । তবে একক মৃতিও পাওয়া যায়। একক অবস্থায় তিনি শূন্য, আর যুগনদ্ধ অবস্থায় তিনি বোধিচিত্ত । একটি শূন্যতা অপরটি করুণা বজ্রযানীদের সাধনার লক্ষ্য হচ্ছে বোধিচিত্ত লাভ করা । বোধিচিত্তে কেবল মহাসুখের অনুভূতি ছাড়া আর কোন অনুভূতি থাকে না । এই মহাসুখের মধ্যে চিত্তের নিমজ্জনই হচ্ছে পরম নির্বাণ । দেহই হচ্ছে। এ সাধনার অবলম্বন । বোধিচিত্তের উৎপাদনে মণিমূলই আনন্দের উৎপত্তিস্থল। সে আনন্দ সর্বপ্রকার প্ৰকৃতিদোষমুক্ত ! সে আনন্দের উর্ধায়নই হচ্ছে বোধিচিত্ত বা পরমার্থ লাভ । তখন সাধকের দেবতার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে । এ সাধনায় পাঁচটি পর্যায় আছে : প্ৰথম মরীচিকা দর্শন, দ্বিতীয় ধূম দর্শন, তৃতীয় আলোক-বিন্দুর দর্শন, চতুর্থ দীপালোক দৰ্শন ও পঞ্চম পর্যায়ে সতত আলোক দর্শন, তবে সে আলোক হচ্ছে মেঘশূন্য আকাশের ন্যায় । তখনই দেবতা দর্শন হয়, তবে সেটা আধ্যাত্মিক সাধনার ব্যাপার ।

বৌদ্ধ দেবতামণ্ডলীতে অসংখ্য দেবতা আছেন । নানাপ্রকার বোধিচিত্ত থেকেই এ সব দেবতার উৎপত্তি । বৌদ্ধ দেবতাদের মধ্যে আছেন আদি-বুদ্ধ’ পাঁচটি ধ্যানীবুদ্ধ ও তাঁদের শক্তি, যথা অক্ষোভ্য ( শক্তি মামকী), অমিতাভ ( শক্তি পাণ্ডরা ), অমোঘসিদ্ধি ( শক্তি তারা), বৈরোচন (শক্তি লোচনা ), রত্নসম্ভব ( শক্তি বজ্রধাত্বীশ্বরী ) ও বজ্রসত্বা ( শক্তি বজ্রসত্বাত্মিকা ) । এদের হয় শক্তিদ্বারা আলিঙ্গিত ও যুগনদ্ধ অবস্থায় আর তা নয়তো তাদের মূতির বাম পার্শ্বে শক্তির প্রতীকরূপ একটি ত্রিকোণাকৃতি যন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। তার পরের পর্যায়ের দেবতাগণ হচ্ছেন সাতটি মানুষী বুদ্ধ ও তাঁদের শক্তি, বোধিসত্ত্বগণ ও তাদের শক্তিদেবীসমূহ অমিতাভকুলে দেবদেবীসমূহ অক্ষোভ্য কুলের দেবদেবীগণ, বৈরোচনকুলের দেবদেবীগণ, রত্নসম্ভবকূলের দেবদেবীগণ, অমোঘকুলের দেবদেবীগণ, দশদিগদেবতা, ছয় দিগদেবী, আটটি উষ্ণীষ দেবতা, পঞ্চরক্ষাদেবী, চার লাস্যাদি দেবী, চার দ্বারদেবী, চার রশ্মিদেবী, চার পশুমুখী দেবী, চার ডাকিনী, দ্বাদশ পারমিতা, দ্বাদশ বশিতা, দ্বাদশ ভূমি দেবী, দ্বাদশধারিণী ইত্যাদি । ( যাঁরা বৌদ্ধ দেবদেবী সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ জানতে চান তাঁরা বিনয়তোষ ভট্টাচাৰ্য মহাশয়ের বৌদ্ধ মূর্তিতত্ত্ব সম্বন্ধে বই পড়ে নিতে পারেন )।

।। ছয় ।।

বৌদ্ধর যখন তন্ত্রের গুহ্যসাধনপদ্ধতি প্রকাশ করে দিলেন, তখন হিন্দুরা আর চুপ করে বসে রইল না । তারাও এই লোকায়ত গুহাসাধনা সম্বন্ধে গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হল । তারা প্রথমে যে ধর্ম প্রচার করল, সেটা হচ্ছে নাথধৰ্ম । সমস্ত তান্ত্রিক সাধনাই হচ্ছে গুরুত্ববাদী ধৰ্ম । যেহেতু তারা যোগমার্গে সিদ্ধ ছিল, সেজন্য নাথধর্মাবলম্বীদের যোগী বলা হত । নাথপন্থ বা নাথধর্ম শৈবধর্মেরই একটা শাখা বিশেষ । এর ওপর বৌদ্ধ ও তন্ত্রধর্মের প্রভাব ছিল । কথিত আছে, শিব যখন দুৰ্গাকে গুহ্যতত্ত্বের উপদেশ দিচ্ছিলেন, তখন নাথধর্মাবলম্বীদের আদিপুরুষ মীননাথ গোপনে তা শুনেছিলেন । শিবই নাথদের আরাধ্য দেবতা এবং ‘কায়া’-সাধনই নাথদের চরম লক্ষ্য । নাথধর্ম প্ৰধানতঃ বাঙলার নিম্নকোটির লোকদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল । তবে এই ধর্মকে অবলম্বন করে যে সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, তা থেকে আমরা মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ, গোরক্ষনাথের শিষ্য রানী ময়নামতী, রানী ময়নামতীর পুত্ৰ গোপীচন্দ্র ও তঁদের নানারূপ অলৌকিক শক্তির কথা জানতে পারি। ধর্মটি এক সময় সুদূর পেশওয়ার থেকে ওড়িশা পর্যন্ত প্ৰচলিত ছিল ।

নাথধর্মকে অবলম্বন করে যেমন একটা সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, হিন্দু-তন্ত্রধর্মকে অবলম্বন করেও এক বিরাট সাহিত্য গড়ে উঠেছিল । তার আগে তন্ত্রের সাধনপদ্ধতির গোপন ব্যাখ্যা হত । বলা হত।– “কূলবর্ত্ম গোপনীয়ম্‌” । আগমতন্ত্ৰবিলাস অনুযায়ী হিন্দুতন্ত্রের সংখ্যা হচ্ছে ১৪৭ ৷ এ ছাড়া বরাহতন্ত্রে আরও ৫৪ খানি হিন্দুতন্ত্রের নাম আছে। হিন্দুতন্ত্রগুলি অধিকাংশই মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল। সপ্তদশঅষ্টাদশ শতাব্দীর একখানা প্ৰসিদ্ধ ও জনপ্রিয় তন্ত্র হচ্ছে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত ‘তন্ত্রসার’ ।

তন্ত্রগ্রন্থসমূহ সব একই পন্থাবলম্বী নয়। বলা যেতে পারে যে, যত গ্ৰন্থ তত পন্থ । মোট কথা, সব তন্ত্রের উপাস্য দেবতা ও উপাসনাপদ্ধতি এক নয়। কারুর উপাস্য দেবতা শিব, কারুর শক্তি, কারুর বিষ্ণু, কারুর সূর্য, আবার কারুর গণপতি । এই উপাস্য দেবতার বিভেদ অনুযায়ী উপাসকদের শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর ও গাণপত্য নামে অভিহিত করা হয়। তবে এদের মধ্যে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণবরাই সংখ্যায় অধিক । এই সব মূল সম্প্রদায় ছাড়া. আবার বহু উপসম্প্রদায় আছে । নানা শাখা-উপশাখায় বিভক্ত হওয়ার দরুন, তন্ত্র সম্বন্ধে কোন সঠিক ধারণা করা খুব কঠিন । বস্তুত তল্পের জগৎ অতি জটিল জগৎ । তবে তন্ত্রের উপাসনা পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এই সব বৈশিষ্ট্যের অন্তৰ্ভুক্ত হচ্ছে-মূলমন্ত্র, বীজমন্ত্র, মুদ্রা, আসন, ন্যাস, দেবতার প্রতীক স্বরূপ বর্ণরেখাত্মক যন্ত্র, সাধনার সময় মৎস, মাংস্য, মদ্য, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চ-মকারের ব্যবহার, উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য মারণ, উচ্চাটন, বশীকরণ প্রভৃতি যট্‌কর্মের আশ্রয় গ্রহণ ও যোগানুষ্ঠান। তবে সব সম্প্রদায়ের উপাসনার মধ্যেই যে এ সব বৈশিষ্ট্য আছে তা নয়। যথা, যারা বামাচারী তান্ত্রিক সাধক তারাই মৎস্য, মাংস, মদ্য, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চ-মকারের আশ্রয় গ্ৰহণ করে । নারীসঙ্গমই এই উপাসনার ভিত্তি । এই সাধনায় নারীসঙ্গমের ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁরা যে ব্যাখ্যা করেন, তার সমস্তটাই হচ্ছে রহস্যময়, গূঢ় ও গুহ্য । তন্ত্রমতে নারীর দুই স্বরূপ-কামিনী ও জননী-একই । যাদের পক্ষে নৈতিক হিসাবের স্ত্রী ও জননী পৃথক সংস্কার, তাদের পক্ষে এ ধারণা করা খুবই কঠিন। একজন ভৈরবের ভাষায় বলি-মাতৃভাবই বল, আর কামিনী ভােবই বল, দুই তো আরোপিত ভাব, আসলে তো সে একই কামিনীর দুটি রূপ বা ভাব । গোড়াতেই তো প্ৰকৃতি কামিনী, সৃষ্টিতে সম্ভোগার্থেই তো তার সার্থকতা । তারপর যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, সেই সৃষ্টজীবের অসহায় ও দুর্বল অবস্থায় তার লালন পালন ও বৃদ্ধির জন্যই তো জননী ভাবটি । নারীমাত্রেই পরমাপ্রকৃতি আদ্যশক্তির অংশ । মানুষ সমাজের একটা নৈতিক সংস্কারকে সনাতন সত্য বলে মেনে নিলে তত্ত্বের দিক থেকে সত্য উদ্ধার অসম্ভব হবে । প্ৰকৃতির আসল ভাব অতি গুহ্য, অনির্বচনীয় । কেবলানন্দময়ী ভাব । তার বর্ণনা নেই। এই জন্যই পরমহংসদেব এক সময় মা ঠাকরুণকে ‘আমি’ তোমার কে ?’–এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন–’তুমি আমার আনন্দময়ী গো ।’

তান্ত্রিক সাধনায় তিনটি অধিকারভেদ আছে। উত্তম, মধ্যম ও অধম অধিকারভেদে দিব্যাচার, বীরাচার ও পশ্বাচার। ভোগ না হলে, ত্যাগ আসে না, সেজন্যই তান্ত্রিক সাধনার প্রথম ধাপ পশ্বাচার। এই ধাপে সাধক কামকে সম্পূর্ণভাবে জয় করেন। পশ্বাচারের পর সাধক বীরাচারে প্রবৃত্ত হয় । এই সাধনায় ভয়ের ভাব মন থেকে দূর হয়ে যায়। অমাবস্যার নিশায় শবের ওপরে বসে সাধনায় প্ৰবৃত্ত হয় । পাশমুক্ত হওয়াই এই সাধনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। যখন সকল পাশগুলিকে সাধক মন থেকে সমূলে উৎপাটিত করে, তখন সে দিব্যাচারে প্রবৃত্ত হয়। তখনই সে প্ৰকৃত শক্তির অধিকারী হয় । তান্ত্রিক সাধনায় মৈথুন কামমার্গ নয়। মৈথুন সম্বন্ধে শিবের মুখ দিয়ে তন্ত্রে বলা হয়েছে :

‘মৈথুনং পরমং তত্ত্বং সৃষ্টিস্থিত্যন্তকারণম ।
মৈথুনাজায়তে সিদ্ধি ব্ৰহ্মজ্ঞানং সুদুর্লভম্‌ ৷।
রেফন্তু কুণ্ডমাভাস: কুণ্ডমধ্যে ব্যবস্থিতঃ ।
মকারাশ্চ বিন্দুরূপে মহাযোগৌ স্থিতঃ প্রিয়ে ৷।
আকারহংসমারুহ্য একতা চ যদঃ ভবেৎ ।
তদা জাতং মহানন্দং ব্ৰহ্মজ্ঞানং সুদৰ্লভম ।।

বস্তুতঃ তন্ত্রগ্রন্থসমূহে বলা হয়েছে যে ‘মৈথুন’ ছাড়া কুলপূজা হয় না । যেমন গুপ্তসংহিতায় বলা হয়েছে-“কুলশক্তিম বিনা দেবী যো জপেত স তু পামর ।” আবার বলা হয়েছে যে, সে নারী নিজের স্ত্রী হলে চলবে না । এ সম্বন্ধে নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে ‘বিবাহিতা পতিত্যাগে দুষণমন কুলার্চনে।’ তার মানে কুলপূজার জন্য সধবা স্ত্রীলোক যদি তার পতিত্যাগ করে, তবে তার কোন দোষ হয় না । মাত্ৰ সধবা হলেই চলবে না । সে ষোড়শী, সুন্দরী, কামবর্জিতা ও বিপরীতরমণদক্ষ হওয়া চাই । ( ‘বিপরীতরতা সা তু ভাবিত হৃদয়োপরি’ ) । এরূপ কুলপূজায়রত নারীকে কুলনায়িকা বলা হয়। কুমারীতন্ত্রে বলা হয়েছে যে নটী, কাপালিকা, বেশ্য, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, মালাকার কন্যা, নাপিত স্ত্রী, রাজকী ও গোপালকন্যা, এই নববিধ কন্যাই এই কার্যে প্ৰশস্ত । বিকলাঙ্গী, বিকৃতাঙ্গা, সন্দিগ্ধচিত্তা, বৃদ্ধা, পাপযুক্ত, হুঙ্কারকারিণী, অর্থলুব্ধ, অভক্তিচিত্তা এবং কাতরা রমণীকে এই কার্যে ত্যাগ করবে। কুলচুড়ামণিতন্ত্রে বলা হয়েছে বিশেষভাবে লীলাচাতুর্য থাকলে যাবতীয় কুলাঞ্জনাই শক্তিরূপে গৃহীত হতে পারে। ( বিশেষবৈদদ্ধ যুতঃ সৰ্ব্ব এব কুলাঙ্গনা ) । কুলচূড়ামণিতন্ত্রে আরও বলা হয়েছে যে, অন্য রমণী যদি না আসে তা হলে নিজের কন্যা, নিজের কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠা ভগিনী, মাতুলানী, মাতা বা বিমাতাকে নিয়ে কুলপূজা করবে । ( অন্যা যদি ন গচ্ছেত্তু, নিজকন্যা নিজানুজা । অগ্ৰজা মাতুলানী বা মাত৷ বা তৎ সপত্নিকা ৷ পূৰ্বাভাবে পরা পূজ্যা মদংশা যোযিতো মতাঃ। এক চেৎ কুলশাস্ত্রজ্ঞ পূজার্হা তত্ৰ ভৈরব ।।’

কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করাই তান্ত্রিক সাধনার উদ্দেশ্য। এই শক্তি মূলাধারস্থ পদ্মমৃণালে (যোনিমূলে ) কুণ্ডলাকারে সর্পবৎ সুপ্ত অবস্থায় নিহিত থাকে । জাগ্রত করলে ইহা দেহস্থ সূক্ষ্মতন্তুবৎ ও সুষুম্না নাড়ীর ( মেরুদণ্ড ) মধ্য দিয়ে ছয়টি পদ্ম বা চক্রের পথে প্রবাহিত হয়, ও একে জাগরিত করে । (‘আদৌ পু্রকযোগেন স্বাধারে যোজয়েন্মনঃ। গূদমেঢ্রান্তরে শক্তিং তামাকুঞ্চ্য প্ৰবোধয়েৎ’ ।। ) শ্ৰীশ্ৰীরামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গে বিবৃত হয়েছে — “ইহজন্মে এবং পূর্বপুর্ব জন্মান্তরে যত মানসিক পরিবর্তন বা ভাবজীবের উপস্থিত হইতেছে ও হইয়াছিল তৎসমূহের সূক্ষ্ম শারীরিক প্ৰতিকৃতি অবলম্বনে অবস্থিত মহা ওজস্বিনা প্রেরণাশক্তিকেই পতঞ্জলি প্রমুখ ঋষিগণ ঐ আখ্যা প্ৰদান করিয়াছেন । যোগী বলেন উহা বদ্ধ জীবে প্ৰায় সম্পূর্ণ সুপ্ত বা অপ্ৰকাশিত অবস্থায় থাকে । উহার ঐরূপ সুপ্তাবস্থাতেই জীবের স্মৃতি কল্পনা ইত্যাদি বৃত্তির উদয় । উহা যদি কোনরূপে সম্পূৰ্ণ জাগরিত বা প্রকাশ্যাবস্থা প্ৰাপ্ত হয় তবেই জীবকে পূর্ণজ্ঞান লাভে প্রেরণ করিয়া শ্ৰীভগবানের সাক্ষাৎ করাইয়া দেয় ।”

রাত্রিকালে সাধক ‘আমি শিব’ ( ধ্যাত্বা শিবোহমতি’ ) এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে নগ্ন অবস্থায় নগ্ন রমণী রমণ করত ( “ততে নগ্নাং স্ক্রিয়ং নগ্নং রমণ ক্লেদযুতোহপি বা” ) রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত নিজ সাধন কার্যে লিপ্ত থাকবে । কুলাৰ্ণবতন্ত্র অনুযায়ী এই সাধন-প্রক্রিয়া কি, তা আমি আর বাংলায় অনুবাদ করব না । মূল সংস্কৃত শ্লোকই এখানে উদ্ধৃত করছি—

“আলিঙ্গনং চুম্বনঞ্চ স্তনয়োর্মদনস্তথা ।
দর্শনং স্পৰ্শণং যোনেৰ্বিকাশে লিঙ্গঘর্ষনম্‌ ।।
প্ৰবেশ স্থাপনং শক্তের্ণব পুষ্পানিপূজনে” ।

সাধারণ পাঠককে তন্ত্রের গুহ্য রহস্যময় জগতে আর নিয়ে যেতে চাই না । সেজন্য এ সম্বন্ধে এখানেই থেমে যাচ্ছি ।

।| সাত ।।

বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবতামণ্ডলীর ন্যায়, হিন্দু তান্ত্রিক দেবতামণ্ডলীতেও অসংখ্য দেবদেবী আছেন । তবে তাঁদের মধ্যে দশমহাবিদ্যাই হচ্ছেন প্ৰধান । এই দশমহাবিদ্যা হচ্ছেন- “কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী । ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা । বগল সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা । এতা দশমহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্ৰকীৰ্ত্তিতাঃ।” এই সকল দেবতার ধ্যানমন্ত্র থেকে আমরা তাদের আকৃতির পরিচয় পাই। কালী উলঙ্গিনী, সহস্যবদনা, চতুর্ভূজা, কৃষ্ণবর্ণা, দিব্যরূপিণী, গলদেশে নরমুণ্ডমালা, বামভাগের নীচের হাতে অভয়মুদ্রা ও ওপর হাতে বরমুদ্রা । তিনি শিবরূপ শবের ওপর দণ্ডয়ামান । তারা ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা খর্ব, লম্বোদরী, ভয়ঙ্করাকৃতি, গলদেশে নরমুণ্ডরচিত মালা, চতুর্ভূজা ও নবযুবতীরূপা । শবহৃদয়ে তাঁর বাম পদ বিন্যস্ত। ষোড়শী ‘বালাকমণ্ডলাভাসাং চতুর্বাহুংত্ৰিলোচনাম্‌। পাশাংকুশ শরাংশ্চাপান্‌ ধারয়ন্তীং শিবং ভজে”। ভুবনেশ্বরীর উদিত সূর্যের ন্যায় দেহকান্তি, কপালে অর্ধচন্দ্র, মস্তকে মুকুট, পীনোন্নত পয়োধরা, ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সহাস্যবদন । ভৈরবীর উদয়কালীন সূর্যের ন্যায়৷ দেহকান্তি, কপালে অর্ধচন্দ্র, রক্তবর্ণা, ক্ষৌমবস্ত্ৰপরিহিতা, গলায় মুণ্ডমালা, রক্ত অনুলিপ্তস্তনা, মাথায় মুকুট ও চতুর্ভূজা। তাঁর হাতে যথাক্রমে জপমালা, পুস্তক, অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা আছে। ছিন্নমস্তার সদা ষোড়শবর্ষীয়া যুবতীর ন্যায় আকৃতি, স্তনদ্বয় স্থূল ও উন্নত, আলুলায়িত কেশ, বিবসনা ও ভয়ঙ্করী। তিনি বাম করে আপনি ছিন্নমস্তক ধারণ করেন ও নিজকণ্ঠোত্থিত রক্ত পানে রত। ধূমাবতী ‘বিবর্ণা চঞ্চলা রুষ্টা দীর্ঘা চ মলিনাম্বরা । বিবর্ণকুন্তলা রক্ষা বিধবা বিরলাদ্বিজা ৷’’ ইনি কাকধ্বজ রথে আরোহণ করে থাকেন । বগলা সুধাসাগর মধ্যে মণিময়মণ্ডপো রত্ননির্মিত বেদীর ওপর সিংহাসনে উপবিষ্টা, পীতবর্ণা, মাল্য বিভূষিতা দ্বিভূজা ও পীতবর্ণ বস্ত্ৰ পরিহিতা । মাতঙ্গী শ্যামবর্ণা, অর্ধচন্দ্ৰদ্ধারিণী ও ত্রিনয়না। ইনিও রত্ননির্মিত সিংহাসনে উপবিষ্টা । কমলার দেহকান্তি কাঞ্চনের ন্যায়। তিনি চতুর্ভূজা, তাঁর মস্তক রত্নমুকুটে বিভূষিতা । তাঁর করে পঞ্চবস্তু ও তিনি পদ্মের ওপর উপবিষ্টা ।

তান্ত্রিক সাধকরা তাদের সাধনা করেন বীজমন্ত্র ও যন্ত্রের সাহায্যে । কয়েকটি যন্ত্রের নাম যথা, নবদুর্গা যন্ত্র, ত্রিপুরা যন্ত্র, বিন্ধ্যবাসিনী যন্ত্র, কালী যন্ত্রম্‌, শিব যন্ত্রম্‌ ইত্যাদি। এ সকল যন্ত্রের অর্থ যেমন গূঢ়, বীজমন্ত্রসমূহও তাই । যেমন কালীর বীজমন্ত্র হচ্ছে–“ক্রাং ওঁ ক্ৰীং কালিকায়ৈ স্বাহা ।” তারার বীজমন্ত্ৰ—“ওঁ হ্রং স্ত্রীং হুং ফট।” এ সকল বীজমন্ত্রের ভাষা সহজে বোধগম্য নয়। ভাষা বোধ হয় আদিম কালের হবে ।

।। আট ।।

তন্ত্রের ধর্ম যে মাত্র বৌদ্ধদের প্রভাবান্বিত করেছিল তা নয় । সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব ধর্মকেও প্রভাবান্বিত করে বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছিল । শ্ৰীচৈতন্য প্রেমের ধর্ম প্রচার করেছিলেন । সে ধর্ম স্বমহিমার ধর্ম । তিনি নিজের মধ্যেই কৃষ্ণ ও রাধা- এই উভয়ের সত্তা অনুভব করেছিলেন । ‘কৃষ্ণের যতেক খেলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবাপু তাঁহার স্বরূপ।’ কিন্তু চৈতন্যোত্তরকালে বৈষ্ণবরা প্রেমের সঙ্গে কামের সমীকরণ করে ফেলেন। তাঁরা নররূপ স্বরূপকে কৃষ্ণ ও নারীরূপ স্বরূপকে রাধা বলে উঠলেন । রূপের মিলনে যখন স্বরূপের মিলন সংঘটিত হবে, তখনই আসবে অনাবিল সাম্যরসের অনুভূতি । এর ফলে সমাজে ব্যভিচারের প্লাবন ঘটে। ব্যভিচারের স্রোত তো আগে থেকেই এসেছিল যখন কপট হিন্দু তান্ত্রিকরা সাধক সেজে তন্ত্রবচনের দোহাই দিয়ে নারীকে প্ৰলুব্ধ করত সাধিকা হতে । এই ব্যভিচারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে দক্ষিণাচারীরা । এরা তন্ত্রের অপর এক সাধক-সম্প্রদায় । এরা বামাচারীদের মত পঞ্চমকারের সাহায্যে সাধনা করেন না । এরা নিজের স্বরূপে মধ্যেই শক্তির স্বরূপ উপলব্ধি করেন। শিবগমে বলা হয়েছে—’শক্তি শিবঃ শিব শক্তিঃ শক্তি ব্ৰহ্মা জনাৰ্দন । শক্তিরিদ্রো রবিঃ শক্তিং শক্তিশ্চন্দ্রো গ্ৰহা ধ্রুবম্‌। শক্তিজপং জগৎ সর্বম্‌ যে ন জানাতি নারকী ।” তার মানে–‘শক্তিই শিব, শিবই শক্তি, ব্ৰহ্মা শক্তি, জনাৰ্দন শক্তি, ইন্দ্ৰ শক্তি, সূর্য শক্তি, চন্দ্ৰ শক্তি, গ্ৰহগণ শক্তি স্বরূপ, অধিক কি, এই নিখিল জগৎকেই যে শক্তিরূপে বুঝিতে পারে না, সে নরকগামী ।’

তন্ত্রধর্ম ও আমাদের সমাজজীবন, সাহিত্যসাধনা, স্বদেশপ্ৰেম পঞ্চমকার প্রভৃতির ওপর যে ধর্মের প্রভাব সে সম্বন্ধে অনেক কিছু বলবার আছে, কিন্তু তা এই স্বল্প পরিসরের মধ্যে বলা সম্ভবপর নয় । সেজন্য এখানেই আমি ক্ষান্ত হচ্ছি ।

2 Comments
Collapse Comments

আর্যরা প্রথমে কৃষিকাজ জানতোনা সেটা স্বাভাবিক কিন্তু অনার্যরা যে প্রথমে কৃষিকাজ শিখেছে ও পরে শিকার শিখেছে বলছেন (স্বতসিদ্ধ) কোন যুক্তিতে?

কৃষিকাজ বোরিং লাগছিল বোধহয়, তাই একটু মৃগয়া টাইপের আরকি!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *