০৭. আমাদের রিপোর্ট

॥ ৭ ॥

ফেলুদা খুব মন দিয়ে আমাদের রিপোর্ট শুনল। তারপর বলল, ‘আমার অ্যাবসেন্সে ত তোরা বেশ চালিয়ে নিতে পারছিস।’

লালমোহনবাবু বললেন, ‘প্রশ্ন করাটাতে খুব একটা বুদ্ধি লাগে না, আসল কথা হচ্ছে উত্তরগুলো থেকে কী বোঝা গেল। আমি ত মশাই এখনো যেই তিমিরে সেই তিমিরে। আর গুণ্ডা যদি মেরে থাকে লাহিড়ীকে তাহলে ত পুলিশ তার কিনারা করবেই।’

‘গুণ্ডারা হুম্‌কি চিঠি দিয়ে খুন করে না।’

‘তা বটে। তা আপনার কি মনে হয় নেপাল লাহিড়ী আর মহীতোষ রায়কে একজন লোকই খুন করেছে?’

‘একজন বা একই দল। সেটাই ত স্বাভাবিক।’

‘কিন্তু মোটিভটা—?’

‘ধরুন যদি অন্য থিয়েটারের লোক খুনটা করে থাকে, সেখানে ত স্পষ্ট মোটিভ রয়েছে। অপ্সরা থিয়েটারে এখন টপ দুজন অভিনেতাই চলে গেল। ওদের আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে কি কম সময় লাগবে?’

ফেলুদার পায়ে এখনো বেশ ব্যথা। বোধহয় এক্স-রে করাতে হবে। ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা পা কফি টেবিলের উপর তুলে ও সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিল। বলল, ‘তোরা ত অনেক কাজ করলি, এবার আমায় একটু নিরিবিলি কাজ করতে দে!’

‘কী কাজ করবে তুমি?’

‘চিন্তা করব। একটা আলোর আভাস দেখতে পাচ্ছি অন্ধকারের মধ্যে। সেইটে আরো উজ্জ্বল হওয়া দরকার।’

লালমোহনবাবু বললেন, ‘আপনি ভাবুন; আমি আপনাকে কোনোরকম ডিসটার্ব না করে এক কাপ চা খাব। তপেশ ভাই, ভেতরে একটু বলে দিয়ে এস না!’

ফেলুদা দেখলাম ভ্রূকুটি করে চোখ বুজে ফেলেছে। শেষটায় কি ও ঘরে বসেই রহস্যের সমাধান করে ফেলবে নাকি?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও একটা প্রশ্ন করল।

‘এইসব অভিনেতাদের সঙ্গে যে কথা বললি, এদের কারুর মধ্যে কোনো বাতিক লক্ষ করলি?’

আমি বললাম, ‘ভুজঙ্গ রায় নস্যি নেন; ধরণী সান্যাল বিড়ি খান আর সুধেন্দু চক্রবর্তী মশলা খান।’

‘গুড।’

আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। ইতিমধ্যে শ্রীনাথ লালমোহনবাবুকে চা এনে দিয়েছে, ভদ্রলোক বেশ তৃপ্তিসহকারে পান করছেন। আমি একটা পত্রিকার পাতা উল্টে যেতে লাগলাম। ফেলুদার কাছে নানারকম পত্রিকা আসে, তার বেশির ভাগই অবিশ্যি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে চলে যায়।

মিনিট পাঁচেক নিস্তব্ধতার পর ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি ও চোখ খুলেছে, আর সেই চোখ জ্বলজ্বল করছে।

‘লালমোহনবাবু’, চাপা স্বরে বলল ফেলুদা।

‘আজ্ঞে?’

‘এই যে সুধেন্দু চক্রবর্তী—ইনি কি মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক?’

‘হ্যাঁ।’

‘ফরসা রং?’

‘বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বয়স?’

‘হ্যাঁ—কিন্তু আপনি এঁকে চেনেন নাকি?’

‘শুধু আমি নয়, আপনারাও চেনেন’।

‘বলেন কি?’

‘এবার বোধহয় ঘরে বসেই রহস্যোদ্ঘাটন হয়ে গেল।’

‘অ্যাঁ!’

‘দাঁড়ান, আগে ইন্‌সপেক্টর ভৌমিককে একটা ফোন করি।’

আমি ফেলুদার হয়ে নম্বরটা ডায়াল করে ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ফেলুদা বলল, ‘কে, হরিদাসবাবু? আমি প্রদোষ মিত্র কথা বলছি!—শুনুন, ওই অপ্সরা থিয়েটারের মামলাটা—আমার মনে হয় গুণ্ডাদের পিছনে সময় নষ্ট না করাই ভালো, কারণ আমি জেনে গেছি কে খুনটা করেছে। আমি ত চলৎশক্তিরহিত কাজেই আপনাকেই আসতে হবে আমার কাছে। আমি নাইনটি নাইন পার্সেন্ট সিওর…ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এলেই হবে।’

ফেলুদা ফোন রেখে দিল। আমরা ওর মুখের দিকে চেয়ে রয়েছি। ‘খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না ঠিক আছে তোদের আর সাসপেন্সে রাখব না। ব্যাপারটা জলের মতো সোজা, অথচ জিলিপির মতো প্যাঁচালো! একটা কথা বলতেই হবে—হ্যাট্‌স অফ্‌ টু দ্য মার্ডারার। আশ্চর্য ফন্দি এঁটেছিল। ফেলু মিত্তিরের পর্যন্ত ধোঁকা লেগে গিয়েছিল। আসলে এটা স্রেফ ঈর্ষার ব্যাপার। নেপাল লাহিড়ীকে সরিয়ে প্রধান অভিনেতার স্থান দখল করার চেষ্টা; তার জন্যেই খুন।’

‘কিন্তু মহীতোষ রায়?’

‘তিনি খুন হননি।’

‘অ্যাঁ!’

‘না। তিনি এমনভাবে ঘটনাটাকে সাজিয়েছিলেন—হুম্‌কি চিঠি থেকে আরম্ভ করে—যাতে মনে হয় তিনি খুন হয়েছেন। আসলে তিনি এখনো জীবিত এবং বহাল তবিয়তে রয়েছেন ছদ্মবেশে এবং নতুন ঠিকানায়। লেকে গিয়েছিলেন তিনি শুধু মশলার কৌটোটা ফেলে আসতে। তারপর গা ঢাকা দিলেই লোকের সন্দেহ হবে যে তিনি খুন হয়েছেন এবং তাঁর মৃতদেহ লেকের জলে ডুবে রয়েছে।’

‘আশ্চর্য মাথা বটে লোকটার।’

‘তারপর তিন মাসে দাড়ি গোঁফ গজিয়ে অপ্সরা থিয়েটারে আগমন। দাড়ি গোঁফে মানুষের চেহারা একদম বদলে যায়। তাই আপনারা চিনতে পারেননি। অপ্সরাতে অভিনেতা দরকার—সুতরাং ওঁকে না নেওয়ার কোনো কারণ নেই, বিশেষত যখন সুপুরুষ চেহারা আর কণ্ঠস্বর ভালো।’

‘সুধেন্দু চক্রবর্তী!’

‘ইয়েস স্যার। মশলার অভ্যাস এখনো যায়নি—যদিও আপনাদের সামনে খেয়ে লোকটা কাঁচা কাজ করেছে। যাই হোক, তাঁর প্ল্যান একেবারে ষোল আনা সফল হত, যদি না আপনারা আমাকে সাহায্য করতেন। লোকটা একটা পাকা খুনী বনে গিয়েছিল স্রেফ উচ্চাভিলাষের বশে। আংটি চুরিটা অবশ্য স্রেফ ভাঁওতা। কিন্তু ফেলু মিত্তিরকে ত সে চেনে না। আমার কাছে এসে যে কত বড় ভুল করেছে এবার সে বুঝতে পারবে।’

ফেলুদা যে ব্যাপারটা ঠিকই ধরেছিল সেটা অবিশ্যি পরদিনই ইন্‌সপেক্টর ভৌমিকের টেলিফোনে জানা গেল।

লালমোহনবাবু আমাকে আলাদা পেয়ে বললেন, ‘তোমার দাদার সঙ্গে আমাদের তফাতটা কোথায় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।’

‘কোথায় তফাত?’

লালমোহনবাবু তাঁর টাকের উপর ডান হাতের তর্জনীর ডগা দিয়ে টোকা মেরে বললেন—‘মাথায়!’