০৩. রোকেয়া : অবদান ও সীমানা

রোকেয়া : অবদান ও সীমানা

ঠাকুর পরিবারের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী, পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী অথবা দৌহিত্রী সরলা দেবী কী করে শিক্ষিত এবং আধুনিক হলেন, তা খানিকটা আঁচ করা যায়। কিন্তু লেখাপড়ায় পিছিয়ে-থাকা একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের কন্যা রোকেয়া* কী করে শিক্ষিত এবং, তার চেয়েও বড়ো কথা, নারীবাদী হলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। বরং অবিশ্বাস্য এবং অসম্ভব মনে হয় একে। তিনি এমন এক পরিবারে জন্মেছিলেন, যেখানে কেবল পুরুষদের সামনে নয়, পাঁচ বছর বয়স থেকে তাকে অপরিচিত মহিলাদের সামনেও পর্দা পালন করতে হতো। সে পরিবারে মেয়েদের শিক্ষা নেওয়া, বিশেষ করে বাংলা অথবা ইংরেজি–তা-ও নিষিদ্ধ ছিলো। স্কুলে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আর, মুসলমান মেয়েদের পড়ার কোনো স্কুলও ছিলো না তখন। এই পরিবেশে বড়ো বোন করিমুন্নেসার কাছ থেকে রোকেয়া খানিকটা বাংলা শিখেছিলেন এবং বড়ো ভাই ইবরাহিম সাবের তাকে লেখাপড়া করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। বোধ হয় ইংরেজরি অআকখও শিখিয়েছিলেন। কিন্তু এ রকম শিক্ষা এবং উৎসাহ উনিশ শতকে অনেকেই পেয়েছিলেন। তারা কেউ রোকেয়া হয়নি।

রোকেয়া লিখতে আরম্ভ করেন বিশ শতকের একেবারে শুরুতে–১৯০৩ সাল থেকে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ মতিচুর। এ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩১১ সালে। দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩১৪ সালে। এই বইয়ের একাধিক প্রবন্ধে তিনি নারীমুক্তি এবং নারীদের সামাজিক উন্নতির কথা বলেন। নিজের জীবনে তিনি পর্দার নিপীড়ন এবং নারীদের নির্যাতন লক্ষ্য করেছিলেন। বহুবিবাহের কুপ্ৰথা দেখার জন্যে তাঁকে আদৌ দূরে দৃষ্টি দিতে হয়নি। তাঁর পিতা সম্ভবত চারবার বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন। এক আইরিশ নারী। সিপাহী বিপ্লবের সময়ে আশ্রয় দিয়ে ঐকে অস্থায়ী স্ত্রী করে নিয়েছিলেন। অস্থায়ী বলছি এ জন্যে যে, এ বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। সমাজের দিকে ৩াকিয়েও রোকেয়া সেখানে দেখেছিলেন। অবরোধের নিপীড়ন এবং অশিক্ষার অন্ধকার। এসব তাঁকে নারীমুক্তি সম্পর্কে সচেতন করে থাকবে। কিন্তু সেকালের অভিজাত পরিবারের অন্য নারীরাও কমবেশি একই পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন। ওঁরা রোকেয়ার মতো সচেতন অথবা সোচ্চার হননি। আমার ধারণা, তার ভেতরেই fগুলো প্রতিভার দীপ্তি। প্রতিবাদের শিখা। স্বামীর সান্নিধ্যে সেই প্রতিভা ফুটে উঠেছিলো। সেই শিখা আগুনের মতো জ্বলে উঠেছিলো। কিন্তু তাঁর বিয়েটাকে কেউই আপাতদৃষ্টিতে ঠিক আদর্শ বলে মনে করবেন না— একালে তো নয়ই, এমন কি, সেকালেও করার কথা না।

তাঁকে বিয়ে করতে হয়েছিলো দোজবর–সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনকে। রোকেয়ার যদি ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে থাকে, তা হলে তখন তার স্বামীর বয়স ছিলো চল্লিশ অথবা একচল্লিশ বছর। এই স্বামীর আগের পক্ষের এক প্ৰাপ্তবয়স্ক সন্তান ছিলো। সে সন্তান পরে বিমাতাকে যথেষ্ট জ্বলিয়েছিলেন। তা ছাড়া, স্বামীর ছিলো বহুমূত্র রোগ। স্বামী মারাও যান চাকরিজীবন শেষ করার আগেই। এই স্বামীর সঙ্গে মহা আনন্দে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন শুরু হয়েছিলো বলে মনে হয় না। কিন্তু, আমার ধারণা, এই স্বামীই রোকেয়ার চিন্তাধারাকে পাল্টে দিয়েছিলেন এবং তাঁর সুপ্ত প্রতিভাকে উস্কে দিয়েছিলেন।

মৌখিক ছাড়া সাখাওয়াত বাংলা ভাষা ভালো জানতেন না। তাই রোকেয়াকে বাংলা শিখতে তিনি সাহায্য করতে পারেননি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তার কাছ থেকেই রোকেয়া লেখাপড়া শেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন। আর ইংরেজি যে তিনি তারই যত্নে শিখেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার চিঠিপত্র থেকে দেখা যায় যে, ইংরেজি তিনি ভালোই শিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষা ছাড়া, ফেমিনিজমের কথাও তিনি যদি বিলেত-ফেরত স্বামীর কাছ থেকে শুনে থাকেন, তা হলে অবাক হবো না। শুনে থাকা কেন, আমার বিশ্বাস, এ সম্পর্কে রোকেয়া তার কাছ থেকে রীতিমতো সবক নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০-র দশকের গোড়ার দিকে কৃষি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে বিলেত যান। সম্ভবত কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন যান, সেই সময়েই গিয়েছিলেন। বিলেতে তখন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নারীকর্মীরা রীতিমতো টগবগা করছিলেন। সাখাওয়াত সেই আন্দোলন কেবল প্রত্যক্ষ করেননি। ধারণা করি, নীতিগতভাবে তাকে স্বাগতও জানিয়েছিলেন।

ইংলণ্ড বঙ্গমহিলা (১৮৮৫) গ্রন্থের লেখিকা কৃষ্ণভাবিনী দাসও তখন লন্ডনে ছিলেন। তিনিও সেই আন্দোলন কাছ থেকে লক্ষ্য করেছিলেন এবং দেশে ফিরে এসে সে সম্পর্কে লিখেছিলেন। রোকেয়ার পক্ষে, তাঁর সেই লেখা পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো: রোকেয়াকে ইংরেজি শিখিয়ে এবং ইংরেজি পড়তে উৎসাহ দিয়ে সাখাওয়াত জ্ঞানের সদর দরজাটা খুলে দিয়েছিলেন। নারীবাদী লেখিকা মেরী করেলির রচনা থেকে আরম্ভ করে ইংরেজি অনেক রচনাই রোকেয়াকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। ইংরেজির মাধ্যমেই তিনি সুলতানার স্বপ্লের ধারণা লাভ করেছিলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, তাঁর চিন্তাধারাই ছিলো মৌলিক, যুক্তিবাদী এবং আধুনিক। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবােধকে তিনি চােখ বুজে। স্বীকার করে নিতে পারেননি।

তাঁর চিন্তাধারা আধুনিক–এ কথা বললে আসলে যথেষ্ট বলা হয় না। তার কারণ তিনি যেসব কথা লিখেছেন, তা লিখেছিলেন ফেমিনিজমের একেবারে আদি যুগে। তখনও পাশ্চাত্যেই ফেমিনিজম কী–সেই ধারণা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়নি। তাই রোকেয়ার অবদানকে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, প্রকৃতপক্ষে, তার অবদান তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, ফেমিনিজম শব্দটা প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয় ১৮৩৭ সালে। আর, কয়েকজন মার্কিন মহিলা একত্রিত হয়ে প্রথমবারের মতো নারীবাদী দাবি উত্থাপন করেন ১৮৪৮ সালে, নিউ ইয়র্ক শহরে। ইংল্যান্ডে এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয় আরও পরে–১৮৬০-এর দশক থেকে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ১৮৭০-এর দশকে বছর তিনেক ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে ছিলেন। বামবোধিনী পত্রিকায় তিনি একাধিক রচনা প্ৰকাশও করেছিলেন। কিন্তু তিনি নারীবাদী আন্দোলনের কথা লেখেননি। ভারতবর্ষে এ সম্পর্কে কৃষ্ণভাবিনীই প্রথম উল্লেখ করেন। অবশ্য এখানে বলা দরকার যে, নারীরা বন্দী–এই কথা বলে কৃষ্ণভাবিনী দুঃখ করলেও, নারীদের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির কথা তিনি বলেননি। অর্থাৎ নারীদের অবস্থা উন্নতির কথা বললেও, নারীবাদী অধিকারের কথা তাঁর রচনায় নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি যে-ধরনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তার মধ্য দিয়েও তার নারীবাদী মনোভাব প্রকাশ পায় না। অপর পক্ষে, নারী আন্দােনের সেই প্রত্যুষেই রোকেয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে কেবল নারীদের উন্নতির কথা বলেননি, বরং নারীবাদের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। বস্তৃত, কৃষ্ণভাবিনীর তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক অগ্রসর এবং বলা যেতে পারে যে, বাঙালি নারীদের মধ্যে তিনিই প্ৰথম সত্যিকারের নারীবাদী।

এখানে নারীবাদের একটা ছোট্টো সংজ্ঞা দিয়ে নিই, যাতে ভুল বোঝাবুঝি নাহয়। নারীদের উন্নতির কথা বললেই নারীবাদ বোঝায় না। নারীবাদ একটা মতবাদ। নারীরা পুরুষদের হাতে নির্যাতিত একটি শ্রেণী— এই মতবাদকে এক কথায় বলা যায় নারীবাদ। যারা নারীবাদী তারা নিজেরা সেই নির্যাতিত শ্রেণীর সদস্য বলে নিজেদের শনাক্ত করেন।

নারীবাদীরা কেবল নারীদের অবস্থার যৎকিঞ্চিৎ উন্নতি চান না। তাঁরা মনে করেন নারী আর পুরুষ একেবারে সমান। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সমান। অধিকার পেতে পারেন–শিক্ষায়, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে, ঘরের কাজে, সন্তান লালনে, সামাজিক মর্যাদায়, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে, চাকরির ক্ষেত্রে, রাজনীতিতে, ধমীয় আচার-অনুষ্ঠানে। কিন্তু কেবল ভারতবর্ষে নয়, তখনকার ইংল্যান্ডেও এই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বড়ো দুটো দৃষ্টান্ত দিয়ে এটা বােঝানো যায়। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্ৰযুক্তি, সাহিত্য-সঙ্গীতে ইংল্যান্ড উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিলো। কিন্তু দৃষ্টিকটুভাবে এ উন্নতি সীমাবদ্ধ ছিলো পুরুষদের মধ্যে। ১৯২০-এর দশকের আগে পর্যন্ত অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার সাধারণ অধিকার পর্যন্ত দেয়নি। অপর পক্ষে, ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আংশিকভাবে সে অধিকার দিয়েছিলো, যদিও বাস্তবে তা সীমাবদ্ধ ছিলো গুটিকতক ব্ৰাহ্ম এবং খৃস্টানের মধ্যে। মুসলমান নারীদের পড়ার অধিকার পর্যন্ত ছিলো না। সরকারী বিদ্যালয়–বেথুন স্কুল অথবা বেথুন কলেজে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশব সেনের মতো সমাজসংস্কারকও মেয়েদের নিতান্ত সাধারণ শিক্ষা দানের পক্ষপাতী ছিলেন; উচ্চশিক্ষার নিন। তাঁরা মনে করতেন, পুরুষালি শিক্ষা, যেমন, গণিত এবং বিজ্ঞান, মেয়েদের কমনীয়তা নষ্ট করবে।

দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত চাকরির। সেকালের ইংল্যান্ডে চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্যে বৈষম্য বেশি ছিলো বললে, কিছুই বলা হয় না। বলা উচিত, তাদের চাকরি করার অধিকার সামান্যই ছিলো। তাঁদের জন্যে বরাদ্দ ছিলো কতোগুলো বিশেষ ধরনের চাকরি। যেমন, শিক্ষকতা, নার্সিং, চিকিৎসা, সেলাইয়ের কাজ ইত্যাদি। সব চাকরির জন্যে তাদের যোগ্য বলে গণ্য করা হতো না। আর, ভারতবর্ষে মেয়েদের চাকরি করার ধারণা ছিলো রীতিমতো সমাজকে অগ্রাহ্য করার মতো। এমন কি, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও যামিনী সেনের মতো যারা ডাক্তার হয়েছিলেন, অথবা কামিনী সেন ও চন্দ্ৰমুখী বসুর মতো যারা শিক্ষকতায় এগিয়ে এসেছিলেন, তারা সমাজে নিন্দিত হয়েছিলেন। তাঁদের সহজে বিয়ে হয়নি। চাকরি-করা মেয়েদের কারো কারো আবার আদৌ বিয়েই হয়নি–যেমন, রাধারানী লাহিড়ী এবং যামিনী সেনের। রাধারানী ছিলেন শিক্ষক, আর যামিনী ছিলেন ডাক্তার।

এই পরিবেশে রোকেয়া লিখেছিলেন, এমন কোনো কােজ নেই, যা মেয়েদের করা উচিত না। কেরানি থেকে ভাইসরয় পর্যন্ত সব কাজই তারা করতে পারেন। যোগ্যতা থাকলে। এমন কি, তারা ব্যবসা করতে পারেন, অথবা পারেন মাঠে গিয়ে কৃষিকাজ করতে। তিনি আরও লিখেছেন, মেয়েরা অর্থনৈতিক কাজ করে যতোই স্বাবলম্বী হবেন, পুরুষদের আধিপত্য থেকে ততোই রক্ষা পাবেন। পুরুষরা নারীদের শোষণ এবং নির্যাতন করার সুযোগ পান বেঁচে থাকার জন্যে নারীদের যেহেতু তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়।

কেবল চাকরি নয়, রোকেয়া সব ব্যাপারেই পুরুষদের সমকক্ষতা দাবি করেছেন। তিনি লিখেছেন, “… আমরা যে গোলামের জাতি নই, এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব।” অন্যত্র বলেছেন, নারীও মানুষ। “বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব। নই; বল কন্যে! জড়াউ অলঙ্কার রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ।” তিনি আরও লিখেছেন যে, নারী এবং পুরুষ দুজন সমান না-হলে সমাজ এবং সংসারের যথার্থ উন্নতি হতে পারে না। চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, গাড়ির দুচাকা সমান না-হলে সে সামনে যেতে পারে না। শিক্ষার অভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে পরিপূর্ণতা লাভ করে না–সে কথাও তিনি লিখেছেন। “স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন।” এটা সুখী অথবা আদর্শ দাম্পত্যের দৃষ্টান্ত নয়।

আধুনিক নারীবাদীরা আর-একটা বিষয়ে সচেতন হয়েছেন–সে হলো: নারীদের বন্দিত্ত্বে ধর্মের ভূমিকা। কিন্তু ১৯০৪ সালে এ কথা বাঙালি কেন, কোনো বিদেশীও লেখেননি। তা সত্ত্বেও, পর্দানশিন রোকেয়া সেই সময়ে লিখেছিলেন:

“…কোনো ভগ্নি মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্ৰঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। … এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।”

অন্যত্র লিখেছেন: “যেখানে ধৰ্মবন্ধন শিথিল, সেখানে রমণী প্ৰায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।” এই উক্তির সত্যতা সে যুগে তো দূরের কথা, এ যুগেও বুঝতে পারেন, এমন নারীপুরুষের সংখ্যা বেশি নেই। এ উক্তি সম্পর্কে আরও একটা কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে বলা উচিত: রোকেয়া এ কথা লিখে যো-সৎসাহসের পরিচয় দেন, তা তুলনাহীন। সম্ভবত এ যুগের মৌলবাদী পরিবেশে এ কথা লিখতে তিনি সাহস পেতেন না।

সুলতানার স্বপ্ন নিতান্তই কল্পনা। এতে তিনি লিখেছিলেন এক কল্পিত নারীস্থানের কথা— যে-দেশে নারী ও পুরুষের ভূমিকা উল্টে দেওয়া হয়েছে। দেশ শাসন থেকে শুরু করে বাইরের কাজগুলো করেন নারীরা। আর পুরুষরা করেন ঘরের কাজ। এই গল্পে রান্নাবান্না থেকে আরম্ভ করে যুদ্ধ করার কাজেও সৌরশক্তি ব্যবহারের কথা লিখেছেন তিনি। উভয় চিন্তাতেই তাঁর দূরদৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। সত্যিই, এখন তো নারীরা যুদ্ধ করা থেকে আরম্ভ করে সবই করছেন। পুরুষরা ঘরের কাজে অংশ নিতে শুরু করেছেন। এবং সৌরশক্তির অসাধারণ সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। কোনো পুরুষ তো সেকালে এ ধরনের কথা লেখেননি!

এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে তাঁকে সত্যি সত্যি সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর মনে হয়। মনে হয়, তিনি জন্মেছিলেন সময়ের তুলনায় অনেক আগে। সে জন্যেই একদিকে তিনি যেমন তাঁর নিজের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেননি; অন্য দিকে আবার তার বক্তব্য দিয়ে সমাজের পক্ষে যতোটা প্রভাবিত হওয়ার কথা ছিলো, তাও হয়নি। আরও আশ্চর্য লাগে যে, তিনি যেসব বৈপ্লবিক কথাবার্তা লিখেছিলেন, তা যেন কারও চোখেই পড়েনি। ভাগ্য এবং সময় তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করেছিলো। একে তিনি নারী, তার ওপর তিনি মুসলমান। তখনকার ভাবুক এবং সাহিত্যিকদের তাই তাঁর লেখা চোখে পড়েনি। শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ জানা-অজানা অনেকের লেখাই পড়তেন এবং নিজের থেকেই তাদের উৎসাহ দিতেন। কিন্তু রোকেয়া নামটি তারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। অথবা করলেও, তিনি তাঁর মতামত হয়তো সমর্থন করতেন না। রোকেয়া যখন তাঁর প্রথম গ্ৰন্থ প্রকাশ করেন, মোটামুটি সে সময়েই পীরালি পাত্ৰ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ সাড়ে দশ বছরের কন্যাকে তাঁর ইচ্ছা! যাচাই না-করেই বিয়ে দিয়েছিলেন। সে যুগে বড়ো কোনো মুসলমান সাহিত্যিক ছিলেন না। কিন্তু যারা ছিলেন, তারা কেউ রোকেয়ার লেখা পড়ে কোনো অনুকুলপ্রতিকূল মন্তব্য করেননি। প্রভাবিত হওয়া তো দূরের কথা! এমন কি, নজরুল ইসলামও “নারী’র মতো একটি বিখ্যাত কবিতা লিখলেও রোকেয়া সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখেছেন বলে শুনিনি।

রোকেয়ার আর-একটি আশ্চর্য গুণ তাঁর অসাম্প্রায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি যখন লিখেছেন, তখন ভারতবর্ষের তাবৎ নারীদের সম্পর্কেই লিখেছেন। কৃষ্ণভাবিনীর সঙ্গে এখানে তাঁর একটা পার্থক্য লক্ষ্য করি। কৃষ্ণভাবিনী বেশ কয়েক বছর ইংল্যান্ডে থেকেও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি স্বীকরণ করতে পারেননি। রোকেয়া মুসলিম সমাজের অন্তঃপুরে থেকেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধের কোথাও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ছাপ লক্ষ্য করি না। আর, পদ্মরাগী উপন্যাসে তিনি হিন্দু-মুসলমান-ধূস্টানের মিলিত যে-সংসারের চিত্র এঁকেছেন, তা তাঁর ঔদার্যেরই স্পষ্ট প্রকাশ। এমন কি, যে-যুগে মুসলমান সাহিত্যিকরা আরব-ইরানের খোয়াব দেখতেন, সেই কালে রোকেয়া লিখেছিলেন, “আমরা সর্বপ্রথমে ভারতবাসীতারপর মুসলমান, শিখ বা আর কিছু।”

রোকেয়ার পর শত শত নারী তাদের উন্নতির কথা লিখেছেন। এ যুগে তসলিমা নাসরিনের মতো অত্যাধুনিক নারীবাদীও আমরা দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা কট্টরপন্থী, যাঁরা কেবল নারীদের মুক্তি চান না, বরং অংশত পুরুষ-বিদ্বেষী। কিন্তু বাঙালি কোনো নারীবাদী এখনো পর্যন্ত রোকেয়ার মৌলিক চিন্তাকে ছাড়িয়ে গেছেন বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বিষয়ে রোকেয়ার ওপর সময়ের ছাপ দেখতে পাই। যেমন, তিনি যে-যুগে লিখেছিলেন, তখন যৌনমুক্তির কথা তাঁর পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিলো না। সন্তান গ্রহণে নারীদের সিদ্ধান্তই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত–এ কথাও তিনি লেখেননি। এমন কি, নারীবাদের একেবারে গোড়ার প্রশ্ন–দেহ এবং অবরোধমুক্তির কথাও তিনি পুরোপুরি সমর্থন করতে পারেননি। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, বোরকার পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু নারী চার দেয়াল এবং বোরকার আড়াল থেকে বেরিয়ে না-এলে কখনোই পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারেন না–এ তিনি জানলেও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারেননি। কারণ, বোরকা নাপরলে তাঁর বিদ্যালয়ে তিনি হয়তো ছাত্রী পেতেন না। নয়তো যিনি ধর্ম মানুষের তৈরি বলে এক সময়ে দাবি করেছেন, তিনি বোরকার সমর্থন করতে পারেন না। আমার ধারণা, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি ধর্মের দিকে খানিকটা ঝুকেছিলেন। তাঁর নারীবাদী লেখার সংখ্যা তখন খুব কমে এসেছিলো। এ রকমের ছোটোখাটো বিষয়ে তাঁর সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করি ঠিকই, কিন্তু বাংলায় নারীবাদী চিন্তায় তাঁর অবদান আজও অন্যদের চেয়ে বেশি।

————-

* প্ৰসঙ্গত বলা দরকার, রোকেয়া কখনোই নিজের নাম বেগম রোকেয়া লেখেননি। আমাদেরও লেখা উচিত নয়। আর, তাঁর মৃত্যু তারিখ আমাদের জানা আছে। কিন্তু জন্মতারিখ কোথাও লেখা নেই। এমন কি, তার জন্ম যে ১৮৮০ সালেই হয়েছিলো, তারও কোনো প্রমাণ নেই।

(প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *