০৩. ভবেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে

ভবেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পোস্টকার্ডে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল, তাই তাঁর দর্শন পেতে দেরি হল না। ইস্কুল মাস্টার টাইপের চেহারা, চোখে মোটা চশমা, গায়ে ফতুয়ার উপর একটা এণ্ডির চাদর, বসেছেন তক্তপোষে, সামনে ডেস্কের উপর গোটা পাঁচেক ছুঁচোল করে কাটা পেনসিল, আর একটা খোলা খেরোর খাতা।

‘লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়?’ —পোস্টকার্ডে নামটা পড়ে জিগ্যেস করলেন ভদ্রলোক। লালমোহনবাবু মাথা নাড়লেন। ‘বয়স কত হল?’ লালমোহনবাবু বয়স বললেন। ‘জন্মতারিখ?’ ‘ঊনত্রিশে শ্রাবণ।’

‘হুঁ…সিংহ রাশি। তা আপনার জিজ্ঞাস্যটা কী?’

‘আজ্ঞে আমি রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজে উপন্যাস লিখি। আমার আগামী উপন্যাসের তিনটি নাম ঠিক করা আছে। কোনটা ব্যবহার করব যদি বলে দেন।’

‘কী কী নাম?’

‘“কারাকোরামে রক্ত কার?”, “কারাকোরামের মরণ কামড়”, আর “নরকের নাম কারাকোরাম”।’

“হুঁ। দাঁড়ান।”

ভদ্রলোক নামগুলো খাতায় লিখে নিয়ে কিসব যেন হিসেব করলেন, তার মধ্যে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সবই আছে। তারপর বললেন, ‘আপনার নাম থেকে সংখ্যা পাচ্ছি একুশ, আর জন্ম-মাস এবং জন্মতারিখ মিলিয়ে পাচ্ছি ছয়। তিন সাতে একুশ, তিন দুগুণে ছয়। অর্থাৎ তিনের গুণণীয়ক না হলে ফল ভালো হবে না। আপনি তৃতীয় নামটাই ব্যবহার করুন। তিন আঠারং চুয়ান্ন। কবে বেরোচ্ছে বই?’

‘আজ্ঞে পয়লা জানুয়ারি।’

‘উঁহু! তেসরা করলে ভালো হবে, অথবা তিনের গুণণীয়ক যে-কোনো তারিখ।’

‘আর, ইয়ে—বিক্ৰীটা?’

‘বই ধরবে।’

একশোটি টাকা খামে পুরে দিয়ে আসতে হল ভদ্রলোককে। লালমোহনবাবুর তাতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। উনি ষোল আনা শিওর যে বই হিট হবেই। বললেন, ‘মনের ভার নেমে গিয়ে অনেকটা হাল্‌কা লাগছে মশাই।’

‘তার মানে এবার থেকে কি প্রত্যেক বই বেরোবার আগেই মেচেদা—?’

‘বছরে দুটি ত! সাক্সেসের গ্যারান্টি যেখানে পাচ্ছি…’

ভটচায মশাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে আমরা বৈকুণ্ঠপুর রওনা দিলাম। নবকুমারবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী পেট্রোল পাম্পে জিগ্যেস করে নিয়োগী প্যালেসে পৌঁছাতে লাগল বিশ মিনিট।

বাড়ির বয়স যে দুশো সেটা আর বলে দিতে হয় না। খানিকটা অংশ মেরামত করে রং করা হয়েছে সম্প্রতি, বাড়ির লোকজন বোধহয় সেই অংশটাতেই থাকে। দুদিকে পাম গাছের সারিওয়ালা রাস্তা পেরিয়ে বিরাট পোর্টিকোর নিচে এসে আমাদের গাড়ি থামল। নবকুমারবাবু গাড়ির আওয়াজ পেয়েই নিচে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একগাল হেসে আসুন আসুন বলে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমরা কথা রাখব কিনা এ বিষয়ে তাঁর খানিকটা সংশয় ছিল এটাও বললেন।

‘বাবাকে আপনার কথা বলেছি,’ সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে বললেন ভদ্রলোক। ‘আপনারা আসছেন শুনে উনি খুব খুশি হলেন।’

‘আর কে থাকেন এ বাড়িতে?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা।

‘সব সময় থাকার মধ্যে বাবা আর মা। মা-র জন্যেই থাকা। ওঁর শ্বাসের কষ্ট। কলকাতার ক্লাইমেট সহ্য হয় না। তাছাড়া বঙ্কিমবাবু আছেন। বাবার সেক্রেটারি ছিলেন। এখন ম্যানেজার বলতে পারেন। আর চাকর-বাকর। আমি মাঝে মধ্যে আসি। এমনিতেও আমি ফ্যামিলি নিয়ে আর ক’দিন পরেই আসতাম। এ বাড়িতে পুজো হয়, তাই প্রতিবারই আসি। এবারে একটু আগে এলাম কারণ শুনলাম বাড়িতে অতিথি আছে—আমার কাকা, চন্দ্রশেখরের ছেলে, রোম থেকে এসেছেন কদিন হল—তাই মনে হল বাবা হয়ত একা ম্যানেজ করতে পারছেন না।’

‘আপনার কাকার সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ আছে বুঝি?’

‘একেবারেই না। এই প্রথম এলেন। বোধহয় দাদুর সম্পত্তির ব্যাপারে।’

‘আপনার দাদু কি মারা গেছেন?’

‘খবরাখবর নেই বহুদিন। বোধহয় মৃত বলেই ধরে নিতে হবে।’

‘উনি রোম থেকে ফিরে এসে এখানেই থাকতেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কলকাতায় না থেকে এখানে কেন?’

‘কারণ উনি যাদের ছবি আঁকতেন তারা সারা ভারতবর্ষে ছড়ানো। নেটিভ স্টেটের রাজা-মহারাজা। কাজেই ওঁর পক্ষে কলকাতায় থাকায় কোনো বিশেষ সুবিধে ছিল না।’

নেটিভ স্টেটের রাজা-মহারাজা

‘আপনি আপনার দাদুকে দেখেছেন?’

‘উনি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যান তখন আমার বয়স ছয়। আমায় ভালবাসতেন খুব এইটুকু মনে আছে।’

বৈঠকখানায় আসবাবের চেহারা দেখে চোখ টেরিয়ে গেল। মাথার উপরে ঘরের দুদিকে দুটো ঝাড়লণ্ঠন রয়েছে যেমন আর আমি কখনো দেখিনি। একদিকের দেয়ালে প্রায় আসল মানুষের মতো বড় একটা পোর্ট্রেট রয়েছে একজন বৃদ্ধের—গায়ে জোব্বা, কোমরে তলোয়ার, মাথায় মণিমুক্তা বসানো পাগড়ি। নবকুমার বললেন ওটা ওঁর প্রপিতামহ অনন্তনাথ নিয়োগীর ছবি। চন্দ্রশেখর ইটালি থেকে ফিরে এসেই ছবিটা এঁকেছিলেন। —‘ছেলে ইটালিয়ান মেয়ে বিয়ে করেছে শুনে অনন্তনাথ বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন আর কোনদিন ছেলের মুখ দেখবেন না। কিন্তু শেষ বয়সে ওঁর মনটা অনেক নরম হয়ে যায়। দাদু বিপত্নীক অবস্থায় ফিরলে উনি দাদুকে ক্ষমা করেন, এবং উনিই দাদুর প্রথম সিটার।’

আমি একটা কথা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।

‘এস. নিয়োগী লেখা দেখছি কেন? ওঁর নাম ত ছিল চন্দ্রশেখর।’

‘রোমে গিয়ে ওঁর নাম হয় সান্‌ড্রো। সেই থেকে ওই নামই লিখতেন নিজের ছবিতে।’

পোর্ট্রেট ছাড়া ঘরে আরো ছবি ছিল এস নিয়োগীর আঁকা। আর্টের বইয়ে যে সব বিখ্যাত বিলিতি পেন্টারের ছবি দেখা যায়, তার সঙ্গে প্রায় কোনো তফাৎ নেই। বোঝাই যায় দুর্দান্ত শিল্পী ছিলেন সান্‌ড্রো নিয়োগী।

একজন চাকর সরবৎ নিয়ে এল। ট্রে থেকে একটা গেলাস তুলে নিয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘ওই প্রবন্ধটাতে ভদ্রলোক লিখেছেন চন্দ্রশেখরের ব্যক্তিগত সংগ্রহে নাকি কোনো বিখ্যাত বিদেশী শিল্পীর আঁকা একটি পেণ্টিং ছিল। অবিশ্যি ভদ্রলোক শিল্পীর নাম বলেননি, কারণ চন্দ্রশেখরই নাকি ওঁকে বলতে বারণ করেছিলেন— বলেছিলেন “বললে কেউ বিশ্বাস করবে না”। আপনি কিছু জানেন এই পেন্টিং সম্বন্ধে?’

নবকুমারবাবু বললেন, ‘দেখুন, মিস্টার মিত্র—পেন্টিং একটা আছে এটা আমাদের পরিবারের সকলেই জানে। বেশি বড় না। এক হাত বাই দেড় হাত হবে। একটা ক্রাইস্টের ছবি। সেটা কোনো বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা কিনা বলতে পারব না। ছবিটা দাদু নিজের স্টুডিওর দেয়ালেই টাঙিয়ে রাখতেন, অন্য কোনো ঘরে টাঙানো দেখিনি কখনো।’

‘অবিশ্যি যিনি প্রবন্ধটা লিখেছেন তিনি জানেন নিশ্চয়ই।’

‘তা তো জানবেনই, কারণ ভগওয়ানগড়ের এই রাজার সঙ্গে দাদুর খুবই বন্ধুত্ব ছিল।’

‘আপনার কাকা জানতেন না? যিনি এসেছেন?’

নবকুমার মাথা নাড়লেন।

‘আমার বিশ্বাস বাপ আর ছেলের মধ্যে বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। তাছাড়া কাকা বোধহয় আর্টের দিকে যাননি।’

‘তার মানে ওই ছবির সঠিক মূল্যায়ন এ বাড়ির কেউ করতে পারবে না?’

‘কাকা না পারলে আর কে পারবে বলুন। বাবা হলেন গানবাজনার লোক। রাতদিন ওই নিয়েই পড়ে থাকতেন। আর্টের ব্যাপারে আমার যা জ্ঞান, ওঁরও সেই জ্ঞান। আর আমার ছোটভাই নন্দকুমার সম্বন্ধেও ওই একই কথা।’

‘তিনিও গানবাজনা নিয়ে থাকেন বুঝি?’

‘না। ওর হল অ্যাকটিং-এর নেশা। আমাদের একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি আছে কলকাতায়। বাবাই করেছিলেন, আমরা দুজনেই পার্টনার ছিলাম তাতে। নন্দ সেভেন্টি-ফাইভে হঠাৎ সব ছেড়ে ছুড়ে বম্বে চলে যায়। ওর এক চেনা লোক ছিল ওখানকার ফিল্ম লাইনে। তাকে ধরে হিন্দি ছবিতে একটা অভিনয়ের সুযোগ করে নেয়। তারপর থেকে ওখানেই আছে।’

‘সাকসেসফুল?’

‘মনে ত হয় না। ফিল্ম পত্রিকায় গোড়ার দিকের পরে ত আর বিশেষ ছবিটবি দেখিনি ওর।’

‘আপনার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?’

‘মোটেই না। শুধু জানি নেপিয়ান সী রোডে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বাড়ির নাম বোধহয় সী-ভিউ। মাঝে মাঝে ওর নামে চিঠি আসে। সেগুলো রিডাইরেক্ট করতে হয়। ব্যস্‌।’

সরবৎ শেষ করে আমরা নবকুমারবাবুর বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।

দক্ষিণের একটা চওড়া বারান্দায় একটা ইংরিজি পেপারব্যাক চোখের খুব কাছে নিয়ে আরাম কেদারায় বসে আছেন ভদ্রলোক।

আমাদের সঙ্গে পরিচয়ের পর ভদ্রলোক ছেলেকে বললেন, ‘ঠুমরীর কথা বলেছিস এঁকে?’

নবকুমারবাবু একটু অপ্রস্তুত ভাব করে বললেন, ‘তা বলেছি। তবে ইনি এমনি বেড়াতে এসেছেন, বাবা।’

ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল।

‘কুকুর বলে তোরা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না, এটা আমার মোটে ভালো লাগছে না। একটা অবোলা জীবকে যে-লোক এভাবে হত্যা করে তার কি শাস্তি হওয়া উচিত নয়? শুধু কুকুরকে মেরেছে তা নয়, আমার চাকরকে শাসিয়েছে। তাকে মোটা ঘুষ দিয়েছে, নইলে সে পালাত না। ব্যাপারটা অনেক গণ্ডগোল। আমার ত মনে হয় যে-কোনো ডিটেকটিভের পক্ষে এটা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। মিস্টার মিত্তির কী মনে করেন জানি না।’

‘আমি আপনার সঙ্গে একমত,’ বলল ফেলুদা।

‘যাক। আমি শুনে খুশি হলুম। এবং সে লোককে যদি ধরতে পারেন ত আরো খুশি হব। ভালো কথা—’ সৌম্যশেখরবাবু ছেলের দিকে ফিরলেন— ‘তোর সঙ্গে রবীনবাবুর দেখা হয়েছে?’

‘রবীনবাবু?’ নবকুমারবাবু বেশ অবাক। ‘তিনি আবার কে?’

‘একটি জার্নালিস্ট ভদ্রলোক। বয়স বেশি না। আমায় লিখেছিল আসবে বলে। চন্দ্রশেখরের জীবনী লিখবে। একটা ফেলোশিপ না গ্রান্ট কী জানি পেয়েছে। সে দুদিন হল এসে রয়েছে। অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছে। ইটালিও যাবে বলে বলছে। বেশ চৌকস ছেলে। আমার সঙ্গে কথা বলে সকালে ঘণ্টা-খানেক ধরে। টেপ করে নেয়।’

‘তিনি কোথায় এখন?’

‘বোধহয় তার ঘরেই আছে। এক তলায় উত্তরের বেডরুমটায় রয়েছে। আরো দিন দশেক থাকবে। রাতদিন কাজ করে।’

‘তার মানে তোমাকে দুজন অতিথি সামলাতে হচ্ছে?’

‘সামলানোর আর কী আছে। রোম থেকে আসা খুড়তুতো ভাইটিকে ত সারাদিনে প্রায় চোখেই দেখি না। আর যখন দেখিও, দু’চারটের বেশি কথা হয় না। এমন মুখচোরা লোক দুটি দেখিনি।’

‘যখন কথা বলেন কী ভাষায় বলেন?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘ইংরিজি বাংলা মেশানো। বললে চন্দ্রশেখর নাকি ওর সঙ্গে বাংলাই বলত। তবে সেও ত আজ প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। চন্দ্রশেখর যখন দেশে ফেরে তখন ছেলের বয়স আঠারো-উনিশ। বাপের সঙ্গে বোধহয় বিশেষ বনত না। পাছে কিছু জিগ্যেস-টিগ্যেস করি তাই বোধহয় কথা বলাটা অ্যাভয়েড করে। ভেবে দেখুন—আমার নিজের খুড়তুতো ভাই, তাকে পাসপোর্ট দেখিয়ে বোঝাতে হল সে কে!’

‘ইণ্ডিয়ান পাস্‌পোর্ট কি?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘তাইত দেখলাম।’

নবকুমার বললেন, ‘তুমি ভালো করে দেখেছিলে ত?’

‘ভালো করে দেখার দরকার হয় না। সে যে নিয়োগী পরিবারের ছেলে সে আর বলে দিতে হয় না।’

‘উনি সম্পত্তির ব্যাপারেই এসেছেন ত?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা।

‘হ্যাঁ। এবং পেয়েও যাবে। সে নিজে তার বাবার কোনো খবরই জানত না। তাই রোম থেকে চিঠি লিখেছিল আমায়। আমিই তাকে জানাই যে দশ বছর হল তার বাপের কোনো খোঁজ নেই। তার পরেই সে এসে উপস্থিত হয়।’

ফেলুদা বলল, ‘চন্দ্রশেখরের সংগ্রহে যে বিখ্যাত পেন্টিংটা আছে সেটা সম্বন্ধে উনি কিছু জানেন? কিছু বলেছেন?’

‘না। ইনি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর লোক। আর্টে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। …তবে ছবিটার খোঁজ করতে লোক এসেছিল।’

‘কে?’ জিগ্যেস করলেন নবকুমারবাবু।

‘সোমানি না কী যেন নাম। বঙ্কিমের কাছে তার নাম ঠিকানা আছে। বললে এক সাহেব কালেকটর নাকি ইনটারেস্টেড। এক লাখ টাকা অফার করলে। প্রথমে পঁচিশ হাজার দেবে, তারপর সাহেব দেখে জেনুইন বললে বাকি টাকা। দিন পনের আগের ঘটনা। তখনও রুদ্রশেখর আসেনি, তবে আসবে বলে লিখেছে। সোমানিকে বললাম এ হল আর্টিস্টের ছেলের প্রপার্টি। সে ছেলে আসছে। যদি বিক্রী করে ত সেই করবে। আমার কোনো অধিকার নেই।’

‘সে লোক কি আর এসেছিল?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘এসেছিল বৈকি। সে নাছোড়বান্দা। এবার রুদ্রশেখরের সঙ্গে কথা বলেছে।’

‘কী কথা হয়েছিল জানেন?’

‘না। আর রুদ্র যদি বিক্রীও করতে চায়, আমাদের ত কিছু বলার নেই। তার নিজের ছবি সে যা ইচ্ছে করতে পারে।’

‘কিন্তু সেটা সম্পত্তি পাবার আগে ত নয়’, বলল ফেলুদা।

‘না, তা তো নয়ই।’

খাবার সময় দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গেই দেখা হল। রবীনবাবু সাংবাদিককে দেখে হঠাৎ কেন জানি চেনা-চেনা মনে হয়েছিল। হয়তো কোনো কাগজে ছবি-টবি বেরিয়েছে কখনো। দাড়ি-গোঁফ কামানো, মাঝারি রং, চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল৷ বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি না। বললেন অদ্ভুত সব তথ্য বার করেছেন চন্দ্রশেখর নিয়োগী সম্বন্ধে। স্টুডিয়োতে একটা কাঠের বাক্সে নাকি অনেক মূল্যবান কাগজপত্র আছে।

‘রুদ্রশেখরবাবু থাকাতে আপনার খুব সুবিধে হয়েছে বোধহয়?’ বলল ফেলুদা, ‘ইটালির অনেক খবর ত আপনি এঁর কাছেই পাবেন।’

‘ওঁকে আমি এখনো বিরক্ত করিনি,’ বললেন রবীনবাবু ‘উনি নিজে ব্যস্ত রয়েছেন। আপাতত আমি চন্দ্রশেখরের ভারতবর্ষে ফিরে আসার পরের অংশটা নিয়ে রিসার্চ করছি।’

রুদ্রশেখরের মুখ দিয়ে একটা হুঁ ছাড়া আর কোনো শব্দ বেরোল না।

বিকেলে নবকুমারবাবুর সঙ্গে একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, কাছেই পোড়া ইঁটের কাজ করা দুটো প্রাচীন মন্দির আছে সেগুলো নাকি খুবই সুন্দর। ফটক দিয়ে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় পড়তেই একটা কাণ্ড হল। পশ্চিম দিক থেকে ঘন কালো মেঘ এসে আকাশ ছেয়ে ফেলল, আর দশ মিনিটের মধ্যেই বজ্রপাতের সঙ্গে নামল তুমুল বৃষ্টি। লালমোহনবাবু বললেন এরকম ড্রামাটিক বৃষ্টি তিনি কখনো দেখেননি। সেটার একটা কারণ অবশ্য এই যে এ রকম খোলা প্রান্তরে বৃষ্টি দেখার সুযোগ শহরবাসীদের হয় না।

দৌড় দেওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টির ফোঁটা এড়ান গেল না। তারপর বুঝতে পারলাম যে এ বৃষ্টি সহজে ধরার নয়। আর আমাদের পক্ষে এই দুর্যোগের সন্ধ্যায় কলকাতায় ফেরাও সম্ভব নয়।

নবকুমারবাবু অবিশ্যি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বললেন বাড়তি শোবার ঘর কম করে দশখানা আছে এ বাড়িতে। খাট বালিশ তোষক চাদর মশারি সবই আছে; কাজেই রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা করতে কোনোই হাঙ্গাম নেই। পরার জন্য লুঙ্গী দিয়ে দেবেন উনি, এমন কি গায়ের আলোয়ান, ধোপে কাচা পাঞ্জাবী, সবই আছে। —‘আমাকে এখানে মাঝে মাঝে আসতে হয় বলে কয়েক সেট কাপড় রাখাই থাকে। আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না।’

উত্তরের দিকে পাশাপাশি দুটো পেল্লায় ঘরে আমাদের বন্দোবস্ত হল। লালমোহনবাবু একা একটি জাঁদরেল খাট পেয়েছেন, বললেন, ‘একদিন-কা সুলতানের গল্পের কথা মনে পড়ছে মশাই।’

তা খুব ভুল বলেননি। দুপুরে শ্বেত পাথরের থালাবাটি গেলাসে খাবার সময় আমারও সে কথা মনে হয়েছিল। রাত্তিরে দেখি সেই সব জিনিসই রূপোর হয়ে গেছে।

‘আপনার দাদুর স্টুডিওটা কিন্তু দেখা হল না,’ খেতে খেতে বলল ফেলুদা।

‘সেটা কাল সকালে দেখাব,’ বললেন নবকুমারবাবু। ‘আপনারা যে দুটো ঘরে শুচ্ছেন, ওটা ঠিক তারই উপরে।’

যখন শোবার বন্দোবস্ত করছি, তখন বৃষ্টিটা ধরে গেল। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম ধ্রুবতারা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। রাজবাড়ির পিছনে বাগান, সামনে মাঠ। আমাদের ঘর থেকে বাগানটাই দেখা যাচ্ছে, তার গাছে গাছে জোনাকি জ্বলছে। অন্য কোনো বাড়ির শব্দ এখানে পৌঁছায় না, যদিও পূবে বাজারের দিক থেকে ট্রানজিস্টারের গানের একটা ক্ষীণ শব্দ পাচ্ছি।

সাড়ে দশটা নাগাদ লালমোহনবাবু গুডনাইট করে তাঁর নিজের ঘরে চলে গেলেন। দুই ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। ভদ্রলোক বললেন সেটা বেশ কনভিনিয়েন্ট।

এই দরজা দিয়েই ভদ্রলোক মাঝরাত্তিরে ঢুকে এসে চাপা গলায় ডাক দিয়ে ফেলুদার ঘুম ভাঙালেন। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্যি আমারও ঘুম ভেঙে গেল।

‘কী ব্যাপার মশাই? এত রাত্তিরে?’

‘শ্‌ শ্‌ শ্‌ শ্‌! কান পেতে শুনুন।’

কান পাতলাম। আর শুনলাম।

খচ্‌ খচ্‌ খচ্‌ খচ্‌…

মাথার উপর থেকে শব্দটা আসছে। একবার একটা খুট্‌ শব্দও পেলাম। কেউ হাঁটাচলা করছে।

মিনিট তিনেক পরে শব্দ থেমে গেল।

উপরেই সান্‌ড্রো নিয়োগীর স্টুডিও।

ফেলুদা ফিস্‌ফিস্‌ করে বলল, ‘তোরা থাক্‌, আমি একটু ঘুরে আসছি।’

ফেলুদা খালি পায়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

লালমোহনবাবু আর আমি আমাদের খাটে বসে রইলাম। প্রচণ্ড সাসপেন্স, ফেলুদা না-আসা পর্যন্ত হৃৎপিণ্ডটা ঠিক আলজিভের পিছনে আটকে রইল। প্রাসাদের কোথায় যেন ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল। তারপর আরো দুটো ঘড়িতে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবার ঠিক তেমনি নিঃশব্দে এসে ঘরে ঢুকল ফেলুদা।

‘দেখলেন কাউকে?’ চাপা গলায় ঘড়ঘড়ে গলায় লালমোহনবাবুর প্রশ্ন।

‘ইয়েস।’

‘কাকে?’

‘সিঁড়ি দিয়ে এক তলায় নেমে গেল।’

‘কে?’

‘সাংবাদিক রবীন চৌধুরী।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *