০৩. কৃষি ও কৃষিজাত দ্রব্যাদি

কৃষি ও কৃষিজাত দ্রব্যাদি

প্রথম কৃষি ও ভূমিজাত দ্রব্যাদির কথাই বলি। প্রাচীন বাঙলার কৃষি যে ধনোৎপাদনের এক প্ৰধান ও প্রথম উপায় ছিল তাহার প্রমাণ লেখমালায় ইতস্তত রিক্ষিপ্ত। অষ্টম হইতে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত লেখমালাগুলিতে ‘ক্ষেত্রকরণ্‌, ‘কর্ষকান্‌’, ‘কৃষকান্‌’, ইত্যাদি কথার তো বারংবার উল্লেখ আছেই। জনসাধারণ যে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল তাঁহাদের মধ্যে ক্ষেত্রকর বা কৃষকেরাও ছিল বিশেষ একটি শ্রেণী, এবং কোনও স্থানে ভূমি দান-বিক্রয় করিতে হইলে রাজপাদাপোজীবীদের, ব্ৰাহ্মণদের, এবং গ্রামের ও গোষ্ঠীর অন্যান্য মহত্তর ও ক্ষুদ্রতর ব্যক্তিদিগের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেত্রকর বা কৃষকদেরও দান বিক্রয়ের ব্যাপারে বিজ্ঞাপিত করিতে হইত। উদাহরণ স্বরূপ খালিমপুরে প্রাপ্ত ধর্মপালের লিপি (অষ্টম শতকের চতুর্থ পাদ, আনুমানিক) হইতে এই বিজ্ঞপ্তিসূত্রটি উদ্ধার করিতেছি। :

“এযু চতুর্ষ গ্রামেষু সমুপগতান সর্বানেব রাজ- রাজনক- রাজপুত্র- রাজামাত্য-সেনাপতি- বিষয়পতি- ভোগপতি- ষষ্ঠাধিকৃত- দণ্ডশক্তি- দণ্ডপাশিক- চৌরোদ্ধরণিকদৌসসাধসাধনিক- দূত— খেল- গামাগামিকা ভিত্বরমাণ- হস্তাশ্ব- গোমহিষাজীবিকাধ্যক্ষনাকাধ্যক্ষ-বিলাধ্যক্ষ- তরিক- শৌন্ধিক- গৌল্মিক- তদায়ুক্তক- বিনিযুক্তকাদি- রাজপাদপোজীবী- নোহন্যাংশ্চা— কীর্তিতান- চাটভাট-জাতীয়ান- যথাকলধ্যাসিনো- জ্যেষ্ঠকায়স্থমহামহত্তর- মহত্তর- দাশগ্রামিকাদি- বিষয়- ব্যবহারিণঃ- সকরণান- প্রতিবাসিনঃক্ষেত্ৰকারাংশচ- ব্রাহ্মণ- মাননাপূর্বকং যথাৰ্থং মািনয়তি বোধয়তি সমাজ্ঞাপয়তি চ।।”

এই ধরনের উল্লেখ প্রায় প্রত্যেক তাম্র-পট্টোলীতেই আছে। কিন্তু সর্বাপেক্ষা ভালো প্রমাণ, লোকের ভূমির চাহিদা। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত যত ভূমি দান বিক্রয়ের তাম্র-পট্টোলী দেখিতেছি, সর্বত্রই দেখি ভূমি-যাচক বাস্তুক্ষেত্রপেক্ষা খিলক্ষেত্রই চাহিতেছেন বেশি পরিমাণে; তাহার উদ্দেশ্য যে কৃষিকর্ম তাহা সহজেই অনুমেয়। যো-জমি কৰ্ষিত হয় নাই সেই জমির চাহিদাই বেশি; উদ্দেশ্য কর্ষণ, তাহাতে আর সন্দেহ কি? ধনাইদহ পট্টোলী (৪৩২-৩৩ খ্ৰী), দামোদরপুরের প্রাপ্ত প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম পট্টোলী (৪৪৩-৪৪ খ্রী; ৪৮২-৮৩ খ্রী; ৫৪৩-৪৪ খ্ৰী), ধর্মাদিত্যের প্রথম ও দ্বিতীয় পট্টোলী (সপ্তম শতক), গোপচন্দ্রের পট্টোলী (সপ্তম শতক), সমাচার দেবের ঘুগ্রহাটি পট্টোলী (সপ্তম শতক) প্রভৃতিতে শুধু খিলক্ষেত্র প্রার্থনারই উল্লেখ আছে। অন্যত্র, যেখানে খিল ও বাস্তুক্ষেত্র উভয়ই প্রার্থনা করা হইতেছে, যেমন, বৈগ্রাম পট্টোলীতে (৪৪৭-৪৮ খ্ৰী:); সেখানেও খিলক্ষেত্রর পরিমাণ বাস্তুক্ষেত্রের প্রায় বারো গুণ। পরবর্তী কালের পট্টোলীগুলিতে ভূমির পরিমাণ সমগ্রভাবে পাওয়া যাইতেছে, কিন্তু সে-ভূমির কতটুকু খিল, কতটুকু বাস্তু তাহা পরিষ্কার করিয়া কিছু বলা নাই। তবু দত্ত ও ক্রীত ভূমির যে বিবরণ আমরা এই লিপিগুলিতে দেখি, তাহাতে মনে হয়, খিলভূমির কথাই বলা হইতেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাহা ছাড়া, কৃষির প্রাধান্য সম্বন্ধে অন্য একটি অনুমানও উল্লেখ করা যাইতে পারে। ভূমির পরিমাণ সর্বত্রই ইঙ্গিত করা হইতেছে এমন মানদণ্ডে যাহা কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। কুল্যবাপ, দ্রোণবাপ, আঢ়িবাপ বা আঢ়কবাপ, উন্মান (উয়ান) এই সমস্ত মানই শস্য-সম্পর্কিত। এক কুল্য, এক দ্রোণ বা এক আচক (বাঙলা, আঢ়া; পূর্ব-বাঙলার অনেক স্থানে দুন এবং আঢ়া শস্যমান এখনও প্রচলিত) বীজ বপনের জন্য যতটুকু জমির প্রয়োজন তাহার পরিমাণই এক কুল্যবাপ, দ্রোণবাপ অথবা আঢ়বাপ ভূমি এবং এই মানানুযায়ীই পঞ্চম হইতে মোটামুটি অষ্টম শতক পর্যন্ত সমস্ত ভূমির পরিমাপ উল্লেখ করা হইয়াছে। শ্ৰীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবের তাম্র-পট্টোলী (একাদশ শতক) কিংবা শ্ৰীচন্দ্রের ধুল্লা তাম্র পট্টোলীতে (দশম শতক) ভূমি-পরিমাপের মান হইতেছে। হল, এবং হলই হইতেছে প্রধান কৃষি যন্ত্র। অবশ্য এ কথা সত্য যে আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি। অর্থাৎ খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম হইতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ভূমি সর্বত্রই ঠিক এই কুল্যবাপ, দ্রোণবাপ, উন্মান, হল ইত্যাদি মানদণ্ডে মাপা হইত না; তাহার জন্য অন্য মানদণ্ডের নির্দেশও পাইতেছি। নল-মানদণ্ডের নির্দেশ আছে (অষ্টকনবকনল্যাভ্যাম, ৮×৯ নল) পঞ্চম শতকেই, দামোদরপুরের তৃতীয় পট্টোলীতে (৪৮২-৮৩ খ্ৰী)। এই শস্যমান অথবা কৃষি-যন্ত্রমানের সাহায্যে ভূমির পরিমাণের উল্লেখ ইহার মধ্যে কৃষিপ্রধান সমাজের স্মৃতি যে জড়িত তাহা অনুমান করা অসংগত নয়।

ডাক ও খনার বচনগুলিও প্রাচীন বাঙলার কৃষিপ্রধান সমাজের অন্যতম প্রমাণ। যে ভাষায় এখন আমরা এই বচনগুলি পাই তাহা অর্বাচীন, সন্দেহ নাই। এগুলি ছিল জনসাধারণের মুখে মুখে বংশপরম্পরায়। ভাষার অদলবদল হইয়া বর্তমানে তাহা যে রূপ লইয়াছে তাহা মধ্যযুগীয়। তবু, এই বচনগুলি যে খুব প্রাচীন স্মৃতি বহন করে তাহাতে সন্দেহ নাই। কোন কোন ঋতুতে কী। শস্য বুনিতে হইবে, কোন শস্যের জন্য কী প্রকার ভূমি, কী পরিমাণের বারিপাত প্রয়োজন, বারিপাত ও খরাতপ নির্দেশ, বিভিন্ন শস্যের নাম ও রূপ, আবহাওয়া-তত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, কৃষিপ্রধান সমাজের বিচিত্র ছবি, ইত্যাদি নানা খবর এই বচনগুলিতে পাওয়া যায়।

বাঙলাদেশ নদীমাতৃক; ইহার ভূমি সাধারণত নিম্ন এবং বারিপাত কৃষির পক্ষে অনুকূল। এ। দেশের ভৌগোলিক সংস্থান সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা অন্যত্র করা হইয়াছে; ইহার ভূমির উর্বরতা। সম্বন্ধে চীন-পরিব্রাজক যুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্যও সেই সম্পর্কে উল্লেখ করিয়াছি। সাধারণ ভাবে। এ দেশের শস্যভাণ্ডার সম্বন্ধেও এই চীন-পরিব্রাজকের দু’চার কথা বলিবার আছে। পূর্ব ভারতের } যে কয়টি দেশে তিনি পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন তাহার মধ্যে অন্তত চারিটি বর্তমান। বাঙলা-ভাষাভাষী জনপদের সীমার ভিতরে অবস্থিত—পুন-ন-ফ-টন-ন (পুণ্ড্রবর্ধন), / সন-মো-ত-ট’ (সমতট), তিন-মো-লিহ-তি (তাম্রলিপ্তি) এবং কি-লো-ন-সু-ফ-ল-ন (কর্ণসুবর্ণ)। তাহা ছাড়া আর একটি দেশও তিনি গিয়াছিলেন, তাহার নাম কি-চু-ওয়েন-কি-লো; ইহার ভারতীয় রূপ হইতেছে কযঙ্গল, কাজঙ্গল অথবা কজাঙ্গল। কানিংহাম সাহেব এই কাজঙ্গলকে কাকজোল বা রাজমহলের সঙ্গে অভিন্ন মনে করিয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতে’ এক কযঙ্গল রাজার উল্লেখ আছে; কোনও কোনও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থেও কাজঙ্গলের উল্লেখ পাওয়া যায়। “ভবিষ্যপুরাণের ব্রহ্মখণ্ড পুঁথিতে রাঢ়ীখণ্ডজাঙ্গল নামে এক দেশের উল্লেখ আছে। এই দেশ ভাগীরথীর পশ্চিমে, কীকটি অর্থাৎ মগধ দেশের নিকটে; এই দেশের ভিতরেই বৈদ্যনাথ, বক্ৰেশ্বর ও বীরভূমি (বীরভূম) অজয় ও অন্যান্য নদী; ইহার তিন ভাগ জঙ্গল, এক ভাগ গ্রাম ও জনপদ, ইহার অধিকাংশ ভূমি উষর, স্বল্প ভূমি মাত্র উর্বর। এই যে জঙ্গল ও জঙ্গল প্রদেশ ইহাই তো য়ুয়ান-চোয়াঙের কজঙ্গল বা কজাঙ্গল বলিয়া মনে হয়— রাঢ়দেশের উত্তর খণ্ডের জাঙ্গলময় উষর ভূভাগ যাহা রাজমহল ও সাঁওতালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই হিসাবে এই কযঙ্গল-কজঙ্গল-কজাঙ্গল বর্তমানে বাঙলাদেশেরই অন্তর্গত বলিয়া ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে। আমার এই মন্তব্যের সমর্থন পাইতেছি। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর লিপিতে (একাদশ শতক)। ভবদেবী উষার (অজলা) ও জাঙ্গলময় রাঢ়দেশের কোনও গ্রামোপকণ্ঠে একটি জলাশয় খনন করাইয়া দিয়াছিলেন। এখানেও রাঢ়দেশের যে অংশের বিবরণ পাইতেছি। তাহা অজলা, অনুর্বর এবং জাঙ্গলময়। এখন দেখা যাক য়ুয়ান-চোয়াঙ এই পাঁচটি দেশের শস্যসম্ভার সম্বন্ধে সাধারণভাবে কী বলিতেছেন।

কজঙ্গল সম্বন্ধে তিনি বলেন, এ দেশের শস্যসম্ভার ভালো। পুণ্ড্রবর্ধনের বর্ধিষ্ণু জনসমষ্টি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল, এবং এ দেশের শস্যসম্ভার ফলফুল যে সুপ্রচুর তাহাও তিনি লক্ষ করিয়াছিলেন। সমতট ছিল সমুদ্রতীরবর্তী দেশ; এ দেশের উৎপাদিত শস্য সম্বন্ধে তিনি কিছুই বলেন নাই। তাম্রলিপ্ত ছিল সমুদ্রের এক খাড়ির উপরেই; এখানকার কৃষিকর্ম ভালো ছিল, ফলফুল ছিল প্রচুর। স্থলপথ ও জলপথ। এখানে কেন্দ্রীভূত হইয়াছিল বলিয়া নানা দুপ্তপ্রাপ্য দ্রব্যাদি এখানে মজুত হইত এবং এখানকার অধিবাসীরা সেই হেতু প্রায় সকলেই বেশ সম্পন্ন ও বর্ধিষ্ণু ছিল। কর্ণসুবর্ণের লোকেরাও ছিল খুব ধনী, এবং জনসংখ্যাও ছিল প্রচুর; কৃষিকর্ম ছিল নিয়মিত ঋতু অনুযায়ী, ফলফুল-সম্ভার ছিল সুপ্রচুর। দেখা যাইতেছে, য়ুয়ান-চোয়াঙের দৃষ্টিও দেশের কৃষিপ্রাধান্যের দিকেই আকৃষ্ট হইয়াছিল, এবং সর্বত্রই তিনি উৎপন্ন শস্য-সম্ভারের উল্লেখ করিয়াছিলেন, এক সমতট ছাড়া। সমুদ্রতীরবর্তী এই দেশে স্বভাবতই কৃষিকর্মের অবস্থা হয়তো ভালো ছিল না। তাম্রলিপ্তির সমৃদ্ধির হেতু যে শুধু কৃষিকৰ্মই নয়, তাহাও তিনি লক্ষ কুরিয়ািছলেন, এবং সেই জন্যই এই দেশের অর্জবাণিজ্য ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছিলেন।

এইবার কৃষিজাত কী কী শস্য ও অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যাদির খবর আমরা জানি একে একে তাহার আলোচনা করা যাইতে পারে।

 

ধান্য

প্রথমেই প্রধান শস্য ধানের সহিত আমাদের পরিচয়। এই পরিচয়, আগেই বলিয়াছি, আমরা পাই খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয় হইতে দ্বিতীয় শতকের মধ্যে উৎকীর্ণ, প্রাচীন করতোয়া-তীরবর্তী মহাস্থানের শিলালিপিখণ্ডটি হইতে। ইহা একটি রাজকীয় আদেশ; রাজা অজ্ঞাত, এবং যে স্থান হইতে এই আদেশ দেওয়া হইতেছে, তাহার নাম অজ্ঞাত। তবে, অক্ষর দেখিয়া শ্ৰীযুক্ত দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর মহাশয় অনুমান করেন, এবং তঁাহার অনুমান সত্য বলিয়াই মনে হয় যে, আদেশটি দিয়াছিলেন কোনও মৌর্য সম্রাট। আদেশটি দেওয়া হইতেছে পুন্দনাগলের (পুণ্ড্রনগরের) মহামাত্ৰকে, এবং তঁাহাকে শাসনোল্লিখিত আদেশটি পালন করিতে বলা হইয়াছে। পুণ্ড্রনগরে ও পার্শ্ববর্তী স্থানে সংবঙ্গীয়দের মধ্যে (অন্য মতে, ছবিগীয়—ষড়বগীয় ভিক্ষুদের মধ্যে) কোনও দৈবদুর্বিপাকবশত নিদারুণ দুৰ্গতি দেখা দিয়াছিল। এই দৈবদুর্বিপাক যে কী তাহা উল্লেখ করা নাই। এই দুৰ্গতি হইতে ত্ৰাণের উদ্দেশ্যে দুইটি উপায় অবলম্বন করা হইয়াছিল। প্রথমটি কী, তাহা হইতে হয়তো শিলাখণ্ডটির প্রথম লাইনে লেখা ছিল, কিন্তু ভাঙিয়া যাওয়াতে তাহা জানিবার উপায় নাই। তবে, অনুমান করা হইয়াছে যে, গণ্ডক মুদ্রায় কিছু অর্থ সংবঙ্গীয়দের (ছবিগগীয়দের?) নেতা (?) গলদনের হাতে দেওয়া হইয়াছিল, ঋণ হিসাবে। দ্বিতীয় উপায়ে রাজকীয় শস্যভাণ্ডার হইতে দুঃস্থ জনসাধারণকে ধান্য দেওয়া হইয়াছিল—খাইয়া বাচিবার জন্য, না বীজ হিসাবে, তাহা উল্লেখ করা হয় নাই, কিন্তু এই ধান্য-বিতরণও ঋণ হিসাবে। কারণ, এই আশার উল্লেখ লিপিখণ্ডটিতে আছে যে, রাজকীয় এই আদেশের ফলে সংবঙ্গীয়ের অথবা ছবিগগীয় ভিক্ষুরা বিপদ কাটাইয়া উঠিতে পরিবে, এবং জনসাধারণের মধ্যে আবার শস্যসমৃদ্ধি ফিরিয়া আসিবে। তখন গণ্ডক মুদ্রাদ্ধারা রাজকোষ এবং ধান্যদ্বারা রাজকোঠাগার ভরিয়া দিতে হইবে। এই শিলাখণ্ড হইতে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, জনসাধারণের প্রধান উপজীব্যই ছিল ধান্য; দুৰ্গতি—দুর্ভিক্ষের সময়ও এই ধান্য ঋণ গ্রহণই ছিল জীবনধারণের উপায়। রাজাও সেই উপায়ই অবলম্বন করিয়াছিলেন; রাজকোঠাগারে দৈবদুর্বিপাক কাটাইবার জন্য ধন্যই সংগ্ৰহ করিয়া রাখা হইত। এই বিপদে রাজা ধান বিনামূল্যে বিতরণ করেন নাই, ঋণ-স্বরূপই দিয়াছিলেন-; অর্থও ঋণস্বরূপই দিয়াছিলেন, ইহা লক্ষণীয়।

পরবর্তীকালের অসংখ্য লিপিতে এই ধান্যশস্যের উল্লেখ সর্বত্র নাই; কিন্তু তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। ধন্যই ছিল একমাত্র উপজীব্য এই দেশের, এবং শস্য বলিতে ধান্যই বুঝাইত সর্বাগ্রে; তাহার নাম করিবার প্রয়োজন হইত না। এই ধান্য একান্তভাবে বারিনির্ভর; সেইজন্য অগণিত নদনদী-খালবিল থাকা সত্ত্বেও এ দেশের ছড়ায়, গানে, পল্লীবচনে নানা লোকায়ত ব্ৰত ও পূজানুষ্ঠানে মেঘ ও আকাশের কাছে বারিপ্রার্থনার বিরাম নাই; অতীতে ছিল না, আজও নাই। লক্ষণসেনের আনুলিয়া, তৰ্পণদীঘি, গোবিন্দপুর ও শক্তিপুর এই চারিটি তাম্রশাসনে একটি মঙ্গলাচরণ শ্লোক আছে; এই শ্লোকটিতে ধানোপজীবী বাঙালীর আন্তরিক আকুতি ধ্বনিত হইয়াছে মনে করিলে অনৈতিহাসিক উক্তি কিছু করা হয় না।

বিদ্যুদযাত্ৰ মণিদ্যুতিঃ ফণিপতেৰ্বালেন্দুরিন্দ্রায়ুধং
বারি স্বৰ্গতিরঙ্গিণী সিতশিরোমালা বলাকবলিঃ।
ধ্যানাভ্যাসমীরণোপনিহিতঃ শ্রেয়োহঙ্কুরোদ্ভূতয়ে
ভূয়াদ বঃ সা ভবার্তিতাপভিদুরঃ শম্ভোঃ কপৰ্দাম্বুদঃ।

ফণিপতির মণিদ্যুতি যাহাতে বিদ্যুৎস্বরূপ, বালেন্দু ইন্দ্ৰধনুশ্বস্বরূপ, স্বৰ্গতিরঙ্গিণী বারিস্বরূপ, শ্বেতকপালমালা বলাকস্বরূপ, যাহা ধ্যানাভ্যাসরূপ সমীরণের দ্বারা চালিত এবং যাহা ভবার্তিতপভেদকারী, শম্ভুর এমন কদৰ্পরূপ অম্বুদ তোমাদের শ্রেয়শস্যের অন্ধুরোদগমের কারণ হউক।

লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া-শাসনে ব্ৰাহ্মণদের অনেক গ্রামদানের উল্লেখ আছে; এইসব গ্রাম ছিল নানা শস্যক্ষেত্র এবং উপবন শোভায় অলংকৃত, এবং শস্যক্ষেত্রে শালিধান্য জন্মাইত প্রচুর। কেশবসেনের ইদিলপুর-শাসনেও দেখা যাইতেছে, রাজা অনেক ব্ৰাহ্মণকে বহু গ্ৰাম দান করিয়াছিলেন; এইসব গ্রামে সুন্দর সমতল সুবিস্তীর্ণ ক্ষেত্র ছিল এবং সেইসব ক্ষেত্রে চমৎকার ধান উৎপন্ন হইত। ধান এবং ধান চাষ ইত্যাদি সম্বন্ধে আরও খবর জানা যায়; দু একটি উল্লেখ করিতেছি। রঘুবংশ’-কাব্যে রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বঙ্গাভিযানের উল্লেখ আছে; কালিদাস বলিতেছেন, ধানের চারাগাছ যেমন করিয়া একবার উৎপাটন করিয়া আবার রোপণ করা হয় রঘু তেমনই করিয়া বঙ্গজনদের একবার উৎখাত করিয়া আবার প্রতিরোপিত (উৎখাত-প্রতিরোপিতঃ) করিয়াছিলেন। কবিগুরুর বীক্ষণ-শক্তি ও স্থানীয় জ্ঞান দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। এই ধরনের ধানের চাষ সহজ এবং নিরাপদ এবং বাঙলাদেশের ও আসামাঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অন্য যে দুই ধরনের ধানের চাষ বাঙলাদেশে প্রচলিত কালিদাস তাহাও জানিতেন। কিনা, এই কৌতুহল প্রায় অনিবার্য। কাটা ধান মাড়াই করার পদ্ধতি এখন যেমন, সুপ্রাচীন কালেও তেমনই ছিল বলিয়া মনে হয়। “রামচরিত’-কাব্যের কবি-প্রশস্তিতে ধানের ‘খলা’ বা মাড়াই-স্থানের ইঙ্গিত আছে, এবং গোলাকার সাজানো কাটা ধানের উপর দিয়া গোরু-বলদ ঘুরিয়া ঘুরিয়া হাঁটিয়া কী করিয়া ধান মাড়াই করিত তাহারও উল্লেখ আছে। কালিদাসের রঘুবংশ’-কাব্যে ইক্ষুক্ষেত্রের ছায়ায় বসিয়া কৃষক রমণীগণ কর্তৃক শালিধান্য পাহারা দিবার কথা আছে, কিন্তু তাহা বাঙলাদেশ সম্বন্ধে কিনা, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না।

 

ইক্ষু

ধান্য, বিশেষভাবে শালিধান্য এবং ইক্ষু সম্বন্ধে বাঙালী কবির কল্পনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত হইয়াছে। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-গ্রন্থে উদ্ধৃত দুইটি বাঙালী কবির রচিত দুইটি শ্লোকে বর্ষায় ধানের ক্ষেত, হেমন্তে কাটা শালিধানের স্তুপ, আখের ক্ষেত, আখ-মাড়াই কল ইত্যাদি লইয়া যে কবি-কল্পনা বিস্তারিত হইয়াছে তাহা অন্য প্রসঙ্গে (দেশ-পরিচয় অধ্যায়ে, জলবায়ু প্রসঙ্গে) উদ্ধার করিয়াছি। এখানে পুনরুল্লেখ নিম্প্রয়োজন।

 

সর্ষপ

সর্ষপ যে অন্যতম উৎপন্ন শস্য ছিল তাহার কথা আগেই উল্লেখ করিয়াছি; বপ্য-ঘোষবাট গ্রামের তাম্র-পট্টোলীতে উল্লিখিত ‘সর্ষপ-যানক কথাটিতে তাহার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

য়ুয়ান-চোয়াঙ যে বাঙলার সর্বত্রই প্রচুর ফলশস্য-সম্ভারের কথা উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা উক্তি মাত্রই নয়; ইহার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় অষ্টম হইতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত রচিত তাম্র-পট্টোলীগুলিতে। আমি আগেই বলিয়াছি, পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত রচিত লিপিগুলিতে ভূমিজাত দ্রব্যাদির উল্লেখ নাই বলিলেই চলে। কিন্তু অষ্টম শতকে পাল-রাজত্বের আরম্ভের সূত্রপাত হইতেই এই উল্লেখ পাওয়া যায়। কী ভাবে তাহা পাওয়া যায় তাহা দেখা যাইতে পারে।

 

আম্র, মহুয়া, মৎস্য, লবণ, বাঁশ, কাঠ ও ইক্ষু

খালিমপুর-তাম্রশাসনে দেখিতেছি, ধর্মপাল চারিটি গ্রাম দান করিতেছেন। হট্টিকা তলপটক (বাটক?) সমেত; উৎপাদিত শস্যাদির কোন উল্লেখ নাই। দেবপালের মুঙ্গের-শাসনে দেখিতেছি, মোষিকা নামক একটি গ্রাম দান করাহ হইতেছে “স্বামীমাতৃণযুতিগোচর পর্যন্ত সতলঃ সোদ্দেশঃ সাম্র মধুকরঃ সজলস্থলঃ সমৎস্যঃ সতৃণঃ…”। যে জমি দান করা হইতেছে তাহার উপর রাজা কোনও অধিকারই রাখিতেছেন না, শুধু ভূমির উপরকার স্বত্ব নয়, ভূমির নিচের স্বত্ব (সতলঃ), জলস্থলের স্বত্ব (সজলস্থলঃ সমৎস্য), গাছগাছড়ার স্বত্ব সবই দান করিয়া দিতেছেন। তিনটি উৎপন্ন দ্রব্যের সংবাদ এখানে আছে—আম্র, মহুয়া (মধুকঃ) ও মৎস্য। নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপিতেও অনুরূপ সংবাদই পাওয়া যায়, শুধু মৎস্যের উল্লেখ নাই। যাহাই হউক, মুঙ্গের ও ভাগলপুর-লিপির দুটি গ্রামই হয়তো বর্তমানে বিহার প্রদেশে, কাজেই এই সাক্ষ্য হয়তো বাঙলাদেশের প্রতি প্রযোজ্য অনেকে না-ও মনে করিতে পারেন। কিন্তু, দেখিতেছি। দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে প্রাপ্ত প্রথম মহীপালদেবের তাম্রশাসনে যে কুরটিপল্লিকা গ্রাম দান করা হইতেছে, তাহার উৎপন্ন দ্রব্যাদির উল্লেখ ঠিক পূর্বোক্ত ভাগলপুর-লিপিরই অন্যরূপ; এখানেও মৎস্যের উল্লেখ নাই, কিন্তু আম ও মহুয়ার উল্লেখ আছে। প্রথম মহীপালদেবের রাজত্বকালে মোটামুটি একাদশ শতকের প্রথমার্ধ বলিয়া অনুমান করা হইয়াছে। অথচ, ইহার কিছু পূর্ববর্তী অর্থাৎ দশম শতকের একটি শাসনে উৎপন্ন দ্রব্যাদির তালিকা অন্যরূপ। কম্বোজরাজ নয়পালদেবের ইরদা তাম্রপট্টে বৃহৎ ছত্তিবান্না (যে গ্রামে খুব বড় একটি ছাতিম গাছ ছিল?) নামে একটি গ্রাম দানের উল্লেখ আছে। এই গ্রামটি বর্ধমানভুক্তির দণ্ডভুক্তি মণ্ডলের অন্তর্গত। দণ্ডভুক্তি মেদিনীপুর জেলার দাতন অথবা দান্তন! এই গ্রামটি দান করা হইতেছে সমস্ত অধিকার সমেত; র্যাহাকে দান করা হইতেছে তিনিই ইহার সাব-কিছু ভোগ করিবেন, বাস্তুক্ষেত্র, জলাধার, গর্ত, মার্গ (পথ), পতিত বা অনুর্বর জমি, জঞ্জাল বা আবর্জনা ফেলিবার। জায়গা যাহাকে আমরা বলি আঁস্তাকুড় (=আবষ্করস্থান), লবণাকর, সহকার (আম) ও মধুক বৃক্ষের ফলফুল, অন্যান্য গাছ-গাছড়া, হাট, ঘাট, পার বা খেয়া ঘাটী, (সহট্ট-ঘট্ট-সতর) ইত্যাদি সমস্তই তাহার ভোগ্য। ধান্য ও অন্যান্য শস্য ছাড়া, আস্ৰ-মধুক ছাড়া, এখানে আর একটি উৎপন্ন দ্রব্যের খবর পাওয়া যাইতেছে, তাহা লবণ। মেদিনীপুর জেলার দান্তন সমুদ্রতীরবর্তী। জোয়ার। যখন আসে, তখন সমুদ্রতীরবর্তী অনেক স্থানই নোনীজলে ভাসিয়া ডুবিয়া যায়, বড় বড় গর্ত করিয়া লোকে এখনও সেই জল ধরিয়া রাখে, পরে রৌদ্রে অথবা জ্বাল দিয়া শুকাইয়া লবণ তৈরি করে। এই প্রথা প্রাচীন কালেও প্রচলিত ছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় ইরদা লিপিটিতে। এই বড় বড় গর্তগুলিই শাসনোল্লিখিত লবণাকর। জল কিংবা তলের কিংবা পারঘাটের অধিকার ছাড়িয়া দিয়া রাজা যে ভূমিচ্ছিন্দ্ৰন্যায়ানুযায়ী বা অক্ষয়নীবীর্ধমানুযায়ী ভূমি দান করিতেছেন বলিয়া দেখিতেছি, তাহার অর্থ পরিষ্কার। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্ৰে’ দেখি, জল, স্থল, পারঘাট ইত্যাদির। অধিকার রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত; পারঘাটের আয় রাজার, ভূমির উপরকার অধিকার প্রজার হইলেও নিচেকার অধিকার রাষ্ট্র কখনই ছাড়িয়া দেয় না। সেইজন্যই যেখানে ছাড়িয়া দেওয়া হইতেছে, তাহা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই ‘অর্থশাস্ত্ৰেই দেখি, লবণে রাষ্ট্রের অথবা রাজার একচেটিয়া অধিকার। সেই একচেটিয়া অধিকারও ছাড়িয়া দেওয়া হইতেছে যেখানে রাজা ভূমিদান করিতেছেন। বৈদ্যদেবের কমােলি লিপিতে প্রাগজ্যোতিষভুক্তির কামরূপ মণ্ডলের বাড়া বিষয়ে। একটি গ্রামাদানের উল্লেখ আছে; এই গ্রামটি দানের শর্ত জল-স্থল-খিলারণ্য-বাট। গোবাট-সংযুক্ত’। পথ-গোপথের অধিকারও ছাড়া হইতেছে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য হইতেছে অরণ্যের উপর অধিকার ত্যাগ। অথচ, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্ৰে’ অরণ্য রাষ্ট্রসম্পদ ও সম্পত্তি। এই অরণ্য-দানের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট। কাঠ অর্থোৎপাদনের একটি প্রধান উপায়। মদনপালদেবের মনহসি তাম্রপট্টে পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির কোটিবৰ্ষবিষয়ের খলাবর্তমণ্ডলে যে গ্রামদানের উল্লেখ আছে তাহাও দেখিতেছি সতলঃ–সাম্রমধুকঃ সজলস্থলঃ সৰ্গতোষিরঃ সকাট-বিটপঃ-। পুণ্ড্রবর্ধনেও তাহা হইলে বিস্তুত মহুয়ার চাষ ছিল। এই মহুয়া গাছের আয় দুই প্রকার—খাদ্য হিসাবে এবং মহুয়াজাত আসব হইতে। মহুয়া-আসবের উল্লেখ কৌটিল্য তো বিশদভাবেই করিয়াছেন। ঝাট-বিটপও উল্লেখযোগ্য; বাঁশ অথবা অন্য গাছের ঝাড় ও অন্যান্য বড় গাছও একরকমের অর্থাগমের উপায়। সাধারণ লোকেরা যে বাশের চাচের বেড়া দিয়াই ঘর-বাড়ি বাধিত (খুঁটিও ব্যবহার করিত নিশ্চয়ই।), তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় শবরীপাদের একটি চর্যাগীতিতে—“চারিপাশে ছাইলারে দিয়া চঞ্চালী।” চঞ্চালী-চঞ্চারিকা যে আমাদের বাঁশের চাচারি এ সম্বন্ধে আর সন্দেহ কী? বাশের ব্যবসায় তো এখনও বাঙলাদেশে সর্বত্র সুপরিচিত। খুব ভাল বাঁশের ঝাড় ছিল বরেন্দ্রীতে; রামচরিতে এ কথার প্রমাণ আছে। এই প্রসঙ্গেই সন্ধ্যাকর নন্দী একথাও বলিতেছেন যে, বরেন্দ্রীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম উপকরণ ছিল সেখানকার ইক্ষু বা আখের ক্ষেত। এই ভূমির প্রাচীনতর ও বৃহত্তর সংজ্ঞা হইতেছে পুণ্ড্র। ব্রাত্য পুণ্ড্রদের বাসস্থান পুণ্ড্রদেশ, পুণ্ড্রবর্ধন। এই পুণ্ড্র-পুড় কোম বোধ হয় আখের চাষে খুব দক্ষ ছিল, এবং হয়ত সেইজন্যই আখের অন্যতম নামই হইতেছে। পুঁড়ি; এক জাতীয় দেশি আখকে বলে পুঁড়ি। আর একটি লক্ষণীয় নাম গৌড়। গৌড় যে গুড় হইতে উৎপন্ন তাহার শব্দতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণ সুবিদিত। এ তথ্যের মধ্যেও আখের চাষের ইঙ্গিত ধরিতে পারা কঠিন নয়। সুবিখ্যাত “সুশ্রুত’-গ্রন্থে পৌণ্ডক নামে একপ্রকার ইক্ষুর উল্লেখ আছে, এবং বহু সংস্কৃত নিঘন্টু-রচয়িতা ও কোষকারদের মত এই যে, পুণ্ড্রদেশে যে ইক্ষু জন্মাইত তাঁহাই পৌণ্ডক। আজকাল পীেড়িয়া, পুঁড়ি, পীেড়া প্রভৃতি নামে যে ইক্ষু ভারতের সর্বত্র চাষ হইতে দেখা যায় তাহা এই পৌণ্ডক ইক্ষু নাম হইতে উদ্ভূত। সুপ্রাচীন কালেই প্রাচ্যদেশের ইক্ষু ও ইক্ষুজাত দ্রব্য-চিনি ও গুড়—দেশে-বিদেশে পরিচিত ছিল। গ্ৰীক লেখক ঈলিয়ন (Aelien) ইক্ষদণ্ড পেষণ-জাত একপ্রকার প্রাচ্যদেশীয় মধুর (পাতলা ঝোলা গুড়?) কথা বলিতেছেন। ইক্ষুনল পেষণ করিয়া একপ্রকার মিষ্ট রস আহরণ করিত গঙ্গাতীরবাসী লোকেরা, একথা বলিতেছেন অন্যতম গ্ৰীক লেখক লুক্যান (Lukan); এ-সমস্তই খ্ৰীষ্টপূর্ব শতাব্দীর কথা।

 

পান, গুবাক, নারিকেল

উৎপন্ন দ্রব্যাদির, অবশ্যই ধান্য ও অন্য শস্য ছাড়া, বিস্তৃততর উল্লেখ আমরা পাই পরবর্তী লিপিগুলিতে। একাদশ শতকের শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-তাম্রশাসনে পাই “সতলা –সাম্রপনসা। সগুবাক-নালিকেরা সলবণা সজলস্থলা…।” দ্বাদশ শতকের ভোজ্যবর্মনের বেলব লিপিতে পাই “সাম্রপনসা সগুবাক-নালিকেরা সলবণা সজলস্থলা সগর্তোেষরা।” বিজয়সেনের দেওপাড়া-লিপিতে উৎপন্ন দ্রব্যাদির খবর পাওয়া যায় না; এই রাজারই বারাকপুর শাসনেও তাহাই, কিন্তু শেষোক্তটিতে পুণ্ড্রবৰ্ধনভূক্তির খাড়িমণ্ডলের যে গ্রামে চার পাটক ভূমিদানের উল্লেখ আছে তাহার উৎপত্তি-মূল্য (বার্ষিক আয়?) ছিল দুই শত কপর্দক পুরাণ। চার কড়িতে এক গণ্ডা; ষোলো গণ্ডায় এক কপর্দক পুরাণ। বল্লালসেনের নৈহাটি-তাম্রপট্রে বর্ধমানভুক্তির উত্তর-রাঢ় মণ্ডলের স্বল্পদক্ষিণবীথির অন্তর্গত বাল্লহিঠঠা গ্রামে কিছু ভূমিদানের উল্লেখ আছে; এই ভূমির পরিমাণ বৃষভশংকর অর্থাৎ বিজয়সেনীয় নলের মাপে ৪০ উন্মান ৩ কাক। ইহার উৎপত্তি-মূল্য ৫০০ কপর্দকপুরাণ এবং এই আয়ের অন্তত কিয়দংশ পাওয়া যাইতেছে ভূমিসম্বন্ধ “ঝাট-বিটপ— গর্তৌষর-জলস্থল- গুবাক-নারিকেল হইতে। লক্ষ্মণসেনের তপণদীঘি-শাসনেও অন্যতম আয়ের পথ ঝাট-বিটপ ও গুবাক নারিকেল। দত্তভূমি পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির বরেন্দ্রীর অন্তর্গত বেলহিষ্ঠি গ্রামে; ভূমির পরিমাণ ১২০ আঢ়াবাপ, ৫ উন্মান; উৎপত্তি-মূল্য ১৫০ কপর্দকপুরাণ। এই নৃপতিরই মাধ্যইনগর-লিপিতে দত্তভূমি বরেন্দ্রীর অন্তর্গত কান্তাপুরের নিকট দীপনিয়াপটক গ্রাম, গ্রামটির পরিমাণ ১০০ ভুখাড়ী, ৯১ খাড়িকা; উৎপত্তি-মূল্য ১৬৮ (?) কপর্দকপুরাণ (কপর্দাকাষ্টষষ্টিপুরাণাধিকশত=কপর্দকষ্টকাষ্ট্যাধিকপুরাণশত)। লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর-শাসনেও অন্যতম আয়ের পথ ঝাট-বিটপ এবং গুবাক-নারিকেল। দত্তভূমি বর্ধমানভুক্তির পশ্চিম-খাটিকার বেতড চতুরক (= বেতড়) অন্তর্গত বিডডােরশাসন গ্রাম; পূর্বে গঙ্গা। ভূমির পরিমাণ ৬০ দ্রোণ, ১৭ উন্মান; উৎপত্তি-মূল্য ৯০০ পুরাণ, দ্রোণ প্রতি ১৫ পুরাণ। আনুলিয়া-শাসনে দত্তভূমি পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির ব্যাঘ্ৰতটী অন্তর্গত মাথরণ্ডিয়া-খণ্ডক্ষেত্ৰ; ভূমির পরিমাণ ১ পাটক, ৯ দ্রোণ, ১ আঢ়াবাপ, ৩৭ উন্মান এবং ১ ক্যাকিনিকা; বার্ষিক উৎপত্তি-মূল্য ১০০ কপর্দকপুরাণ এবং আয়ের অন্যতম উপকরণ ঝট-বিটপ ও গুবাক-নারিকেল। সুন্দরবন-শাসনে দত্তভূমির পরিমাণ ৩ ভূদ্রোণ, ১ খাড়িকা (?), ২৩ উন্মান এবং ২।০ ক্যাকিনি; উৎপত্তির মূল্য ৫০ পুরাণ; ভূমি পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির খাড়িমণ্ডলের কান্তস্লপুর চতুরকের মণ্ডল গ্রামে। আয়ের অন্যতম উপকরণ এক্ষেত্রেও ঝাট-বিটপ ও গুবাক-নারিকেল। ত্ৰয়োদশ শতকে বিশ্বরূপসেন বঙ্গীয়-সাহিত্য -পরিষৎ শাসনদ্বারা নানা তিথিপর্ব উপলক্ষে পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির সমুদ্রতীরশায়ী নিম্ন প্রদেশে বিভিন্ন গ্রামে ১১টি ভূখণ্ড দান করিয়াছিলেন। দুইটি ভূখণ্ড দিয়াছিলেন বঙ্গের নাব্যখণ্ডে (নৌকা-চলাচলযোগ্য) রামসিদ্ধি পাটকে; ভূমির পরিমাণ ৬৭ ৩/৪, উন্মান, উৎপত্তিক ১০০ পুরাণ; এই আয়ের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (১৯  ১১/১৬, ) পানের বরজ হইতে। এই নাব্যখণ্ডেই বিনয়তিলক গ্রামে দত্ত ২৫ উদান (উন্মান) ভূমির উৎপত্তিক ছিল ৬০ পুরাণ; মধুক্ষীরকা আবৃত্তির নবসংগ্ৰহচতুরকে অজ্যিকুলা পাটকে দত্তভূমির পরিমাণ ১৬৫ উন্মান, উৎপত্তিক ১৪০ পুরাণ; বিক্রমপুরের লাউহন্ডাচতুরকের দেউলহন্তী গ্রামে দত্ত পাঁচটি ভূখণ্ডের পরিমাণ ৪২ উন্মান, উৎপত্তিক ১০০ পুরাণ; চন্দ্ৰদ্বীপের ঘাঘরকাট্টি পাটক ও পাতিলাদিবীক গ্রামে দত্তভূমির পরিমাণ ৩৬ ৩/৪, উন্মান, উৎপত্তিক ১০০ পুরাণ। মোট দত্তভূমির পরিমাণ ছিল ৩৩৬*/, উন্মান, উৎপত্তিক ছিল ৫০০ পুরাণ। এই ভূমি নালভূমি (অর্থাৎ কৃষিভূমি) ও বাস্তুভূমি দুই-ই ছিল এবং আয়ের প্রধান উপকরণ ছিল পানের বরজ ও গুবাক-নারিকেল। রামসিদ্ধি পাটকে যে ৬৭ ৩/৪, উন্মান ভূমি দেওয়া হইয়াছিল তাহার বার্ষিক উৎপত্তিক ছিল ১০০ পুরাণ, একথা পূর্বেই বলিয়াছি; তাহার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (১৯ ১১/১৬ = ১৯ পুরাণ, ১১ গণ্ডা) আয় হইত শুধু পানের বরাজ হইতে। বাকি চারি অংশ পরিমাণ আয় যে অন্যান্য উৎপন্ন শস্যাদি হইতে এবং অন্যান্য উপায়ে হইত, তাহাতে আর সন্দেহ কী? কিন্তু সে সবের উল্লেখ নাই। অন্যান্য লিপিতেও এইরূপই; ধান্য ও অন্যান্য শস্য, মৎস্য ইত্যাদি উপকরণ অনুল্লিখিতই থাকিত। বিশ্বরূপ র্তাহার মদনপাড়া-তাম্রপট্টোলী দ্বারা পুন্ড্রবর্ধনভূক্তির ‘বঙ্গে বিক্রমপুর ভাগে পিঞ্জোকাষ্ঠি গ্রামে আরও দুইটি ভূখণ্ড দান করিয়াছিলেন; এই দুই খণ্ড ভূমির আয় ছিল ৬২৭ পুরাণ, এবং প্রধান উল্লিখিত উপকরণ এক্ষেত্রেও গুবাক-নারিকেল। বিশ্বরূপের ভ্রাতা কেশবসেন এই ‘বঙ্গে বিক্রমপুর ভাগেই তলপাড়াপাটক নামে একটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন। এই গ্রামটির মূল্য (না, বার্ষিক উৎপত্তিক) রাজসরকারে নির্ধারিত ছিল ২০০ শত [দ্রহ্ম?]; এখানেও গুবাক্ষ-নারিকেল হইতেছে অন্যতম প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য; এই গুবাক-নারিকেল গাছ ইত্যাদি সমেতই যে গ্রামটি দান করা হইতেছে শুধু তাঁহাই নয়, দান-গ্ৰহীতা নীতিপাঠক ঈশ্বরদেবশর্মণকে বলা হইতেছে, তিনি যেন মন্দির ও পুষ্করিণী ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করাইয়া (দেবকুল-পুষ্করিণ্যাদিকংকারায়িত্বা) এবং গুবাক-নারিকেল গাছ ইত্যাদি লাগাইয়া (গুবাক- নারিকেলাদিকংলগগাবায়িত্ব) এই গ্রাম যাবচ্চন্দ্ৰদিবাকর ভোগ করিতে থাকেন। গুবাক ও নারিকেলই যে ধান্য ইত্যাদি শস্যের পরই এই অঞ্চলের প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য ছিল, এই নির্দেশই তাহার প্রমাণ। ত্ৰয়োদশ শতকের মধ্যভাগে জনৈক রাজা দামোদর পৃথীধর নামক এক ব্ৰাহ্মণকে ৫ দ্ৰোণ ভূমি দান করিয়াছিলেন, তিন দ্রোণ ডাম্বরডাম গ্রামে, দুই দ্রোণ কেটঙ্গাপাল গ্রামে। ভূমির আয় বা উৎপন্ন দ্রব্যাদির কোনও খবরই চট্টগ্রামে প্রাপ্ত এই শাসনে উল্লেখ নাই, তবে ডাম্বরডাম গ্রামের দক্ষিণ সীমায় লবণোৎসীবাশ্রমসম্বাধা-বাটীর উল্লেখ হইতে মনে হয়, এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য ছিল লবণ, এবং লবণ উত্তোলন, অথবা এই ধরনের লবণ-সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে উৎসবও হইত, যেমন নবান্ন উপলক্ষে আজও হইয়া থাকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্রতীরবর্তী দেশে ইহা কিছু অসম্ভবও নহে। দনুজমাধব দশরথদেব সেনরাজবংশ অবসানের পর ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে পূর্ব-বাঙলার রাজা হইয়াছিলেন। তিনি একবার অনেক রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণকে পৃথক পৃথক ভাবে অনেকগুলি ভূখণ্ড দান করিয়াছিলেন। এই ভূখণ্ডগুলির সমগ্ৰ উৎপত্তিকের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০০ পুরাণ। বিক্রমপুর পরগণায় আদাবাড়ী গ্রামে প্রাপ্ত এক তাম্রপট্টে ইহার বিস্তৃত খবর পাওয়া যায়; দত্ত ভূখন্ডগুলি আদাবাড়ীতে এবং আদাবাড়ীরই নিকটস্থ অন্যান্য গ্রামে, কিন্তু উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিশেষ উল্লেখ তাহাতে নাই।

 

আম, মহুয়া, কাঁটাল ও অন্যান্য ফল

অষ্টম হইতে ত্ৰয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত সমস্ত লেখমালাগুলি এবং রামচরিত ও অন্যান্য গ্রন্থ বিশ্লেষণ করিয়া দেখা গেল, ধান্য এবং অন্যান্য শস্য ছাড়া প্রাচীন বাঙলার প্রধান ভূমি ও কৃষি জাত দ্রব্য হইতেছে, আম্র অথবা সহকার, মধুক অর্থাৎ মহুয়া, পনস অর্থাৎ কাঁটাল, ইক্ষু, ডালিম্ব বা দাড়িম্ব, পর্কটি, খর্জুর, বীজ, গুবাক অর্থাৎ সুপারি, নারিকেল, পান মৎস্য ও লবণ। আমি তো বাঙলাদেশের সর্বত্রই জন্মায়, কম-বেশি এই মাত্র; এইজন্যই প্রায় সব-কাটি লিপিতেই আমের উল্লেখ আছেই। মহুয়ার উল্লেখ যো-কাটি লিপিতে এবং অন্যান্য জায়গায় আছে। প্রত্যেকটিরই স্থানের ইঙ্গিত উত্তর-বঙ্গে, শুধু ইরদা তাম্রপট্টের ইঙ্গিত মেদিনীপুর জেলার দাঁতনের দিকে। মহুয়ার চাষ এই অঞ্চলে নিশ্চয়ই তখন ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে। ঈশ্বর ঘোষের রামগঞ্জশাসনেও মহুয়া বা মধুকের উল্লেখ দেখা যায়। পনস অর্থাৎ কঁাটালের ইঙ্গিত পাইতেছি। বিশেষভাবে পূর্ব-বাঙলায়, ঢাকা অঞ্চলে। য়ুয়ান-চোয়াঙ কিন্তু বলিতেছেন কাঁটাল প্রচুর জন্মাইত পুণ্ড্রবর্ধনে, অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে, এবং সেখানে এই ফলের আদরও ছিল খুব। গুবাক ও নারিকেল তো এখনও প্রচুরতর পরিমাণে জন্মায় বাঙলার গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথী-করতোয়া ও বিশেষভাবে সমুদ্রতীর-নিকটবতী অঞ্চলগুলিতে; আশ্চর্যের বিষয় কিছু নয়, লেখমালার ইঙ্গিতও তাই। ইক্ষুর কথা তো আগেই বলিয়াছি; বিচিত্র উল্লেখ হইতে মনে হয়, ইক্ষুচায্যের প্রধানতম স্থান ছিল। উত্তর-বঙ্গ, তবে গঙ্গা-ভাগীরথীবাহিত দেশগুলিতেও বোধ হয় কিছু কিছু জন্মাইত। এক ডালিম্ব ক্ষেত্রের উল্লেখ পাইতেছি লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর-পট্টোলীতে; ইহার অবস্থিতি ছিল বর্তমান হাওড়া জেলায় বেতড় গ্রামের নিকটেই, গঙ্গাতীরের সন্নিকটে। পৰ্কটি বৃক্ষের উল্লেখ পাইতেছি। একাধিক পট্টোলীতে; ইহাদের মধ্যে ধর্মাদিত্যের কোটালিপাড়া-শাসন অন্যতম। বীজফল ও খেজুরের উল্লেখ তো ধর্মপালের খালিমপুর-লিপিতেই আছে। কদলী বৃক্ষ বা ফলের উল্লেখ কোনও পট্টোলীতে বড় একটা দেখা যাইতেছে না; কিন্তু পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকে এবং নানা প্রস্তরচিত্রে বারবার ফলসমন্বিত বা ফলবিযুক্ত কলাগাছের চিত্ৰ দেখিতে পাওয়া যায়। সেই অস্ট্রিক আদি অস্ট্রেলীয় আমল হইতেই কলা বাঙালীর প্রিয় খাদ্য। উত্তর-রাঢ়ে, বরেন্দ্রীতে গুবাক ও নারিকেলের উল্লেখ পাইতেছি, সন্দেহ নাই; শুধু যে লিপিগুলিতেই আছে তাহা নয়, রামচরিতেও আছে। এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ আছে যে, বরেন্দ্রীর মাটি নারিকেল উৎপাদনের পক্ষে খুব প্রশস্ত। যাহাই হউক, বাঙলাদেশের সর্বত্রই তো সুপারি-নারিকেল জন্মায়, তবু অধিক উল্লেখ পাই বঙ্গে বিক্রমপুর-ভাগে, সুন্দরবনের খাড়িমণ্ডলে, বঙ্গের নাব্য অর্থাৎ নিম্ন জলাভূমি অঞ্চলে, ঢাকা জেলার পদ্মাতীরবর্তী ভূমি অঞ্চলে। খড়গবংশীয় রাজা দেবখড়েগির (অষ্টম শতক) আম্রফপুর তাম্র-পট্টোলী (২নং) দ্বারা তলপািটক গ্রামে / পািটক ভূমি দান করা হইতেছে, এবং এই ভূমিখণ্ডে যে দুইটি সুপারি বাগান(গুবাক বাস্তুদ্বয়েন সহ) আছে তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দেওয়া হইতেছে। ইহা হইতেই বুঝা যাইবে, ধন-সম্বল হিসাবে সুপারির আদর কতটুকু ছিল। পানের বরজের উল্লেখ যে পাই, সে-ও বঙ্গের নাব্য প্রদেশে; অন্যান্য স্থানেও হইত সন্দেহ নাই। মৎস্যের সবিশেষ উল্লেখ বাঙলার কোনও লিপি অথবা শাসনে নাই, কিন্তু যখনই ভূমি দান করা হইয়াছে, সজল অর্থাৎ জলাধার, খাল, বিল, প্ৰণুল্লী, নালা, পুষ্করিণী ইত্যাদির অধিকার সমেতই দান করা হইয়াছে; অষ্টম শতক-পরবর্তী শাসনগুলিতে সর্বত্রই তাহার উল্লেখও আছে। এই যে ‘সজল ভূমি দান, ইহা সমৎস্য দান, এই অনুমান কিছু অসংগত নয়। তাহা ছাড়া, এই নদ-নদী বহুল খালবিলাকীর্ণ বাঙলাদেশে মৎস্য যে একটি প্রধান সামাজিক ধনসম্পদ প্রাচীন কালেও ছিল, তাহাও সহজেই অনুমেয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অরণ্য এবং বহু ক্ষেত্রেই ঝাটবিটপ, তরুষণ্ডাদিসহ ভূমি দান করা হইয়াছে; ইহার আয়ও কম ছিল না। ঝাট অথবা ঝাড় আমার তো বাঁশের ঝাড় বলিয়াই সন্দেহ হয়, এবং অরণ্য ও বিটপ যে কাঠের কঁচামাল তাহাও সুস্পষ্ট। বাঁশ ও কাঠ এখনও পর্যন্ত বাঙলাদেশের অন্যতম ধন-সম্বল “লবণ ঠিক কৃষিজাত অথবা ভূমিজাত দ্রব্য না হইলেও এইসঙ্গেই উল্লেখ করা যাইতে পারে। এ কথা অনেকেই জানেন, বাঙলার সমুদ্রতীরের নিম্নভূমিগুলিতে কিংবা পদ্মার উজান বাহিয়া জোয়ারের জল সামুদ্রিক লবণ বহন করিয়া আনে। এই অঞ্চলের লোকেরা কী করিয়া লবণ প্রস্তুত করে, তাহা আগেই বলিয়াছি। সেইজন্যই দেখা যাইবে, উল্লিখিত শাসনগুলিতে যেখানে ‘সলবণ ভূমি দান করা হইতেছে, সেই ভূমি সর্বদাই সমুদ্রতীরবর্তী নিম্নভূমিতে অথবা পদ্মার তীরে তীরে, ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ -নারায়ণগঞ্জের পদ্মাতীরে মেদিনীপুর জেলার দাঁতন, চট্টগ্রামে। বিক্রমপুরে প্রাপ্ত শ্ৰীচন্দ্রের ধুল্লা-শাসনে যে লোনিয়াজোড়া- প্রস্তরের উল্লেখ আছে, তাহা যে লবণের গর্তের মাঠ এমন ধারণা বোধ হয় সহজেই করা চলে। ইহাও বিক্রমপুর অঞ্চলে।

 

প্রাকৃত বাঙালীর খাদ্য । অগুরু, কস্তুরী ইত্যাদি

এইসব ছাড়া আরও কিছু কিছু ভূমিজাত অথবা বৃহত্তর অর্থে কৃষি-সম্পর্কিত দ্রব্যাদির খবর ইতস্তত অনুসন্ধানে জানা যায়। যেমন, বিদ্যাপতি তাহার কীর্তিকৌমুদী গ্রন্থে গৌড়দেশকে  “আজ্যসার গৌড়” বলিয়া বিশেষিত করিয়াছেন। আজ্য অর্থে ঘূত; আজ্য বা ঘূত যে গৌড়দেশের শ্রেষ্ঠ বস্তু, সেই গৌড় হইল আজ্যসার গৌড়; তাহাকে রাজা মোদকের মতন করতলগত করিয়াছিলেন। চতুর্দশ শতকের অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রাকৃত-পৈঙ্গল গ্রন্থের একটি পদে প্রাকৃত বাঙালীসুলভ যে আহার্য-বৰ্ণনা আছে, তাহাতে কলাপাতায় ওগরা ভাত ও নালিতা শাক এবং মীেরলা মাছের সঙ্গে সঙ্গে গব্য (মহিষের নয়) ঘূত ও দুগ্ধের উল্লেখ আছে। সন্ধ্যাকর নদীর রামচরিতে দেখিতেছি, বরেন্দ্রভূমিতে এলাচের সুবিস্তৃত চাষ ছিল; সেইসব ক্ষেতে খুব ভালো এলাচ উৎপন্ন হইত। প্রিয়ঙ্গুলতাও উৎপন্ন হইত। প্রচুর। এলাচ ও প্রিয়ঙ্গু-সরিষা। যেমন হইত। লবঙ্গও জন্মাইত তেমনই প্রচুর। সরিষার বাণিজ্যিক চাহিদা কেমন ছিল জানা নাই, কিন্তু ভারতবর্ষ হইতে অন্যান্য মসলার সঙ্গে সঙ্গে এলাচ ও লবঙ্গ যে প্রচুর পরিমাণে এশিয়া, মিশর এবং পূর্ব ও দক্ষিণ যুরোপে রপ্তানি হইত, পেরিপ্লাস-গ্রন্থে ও টলেমির ইণ্ডিকা-গ্রন্থেই সে প্রমাণ আছে। রাজশেখর তাহার কাব্য-মীমাংসা গ্রন্থে পূর্বদেশে ১৬টি জনপদের উল্লেখ করিয়াছেন— যথা, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, কোশল, তোসল, উৎকল, মগধ, মুদগর (মুদগগিরি = মুঙ্গের), বিদেহ, নেপাল, পুণ্ড্র, প্রাগ-জ্যোতিষ, তাম্রলিপ্তক, মলদ, মল্লবর্তক, সুহ্ম ও ব্রহ্মোত্তর। এই ষোলটি জনপদের উৎপন্ন দ্রব্যের ক্ষুদ্র একটি তালিকাও তিনি দিয়াছেন, যথা, লবলী, গ্রস্থিলর্ণক, অগুরু, দ্রাক্ষা, কস্তুরিকা। এই তালিকা রাজশেখর কী উদ্দেশ্যে করিয়াছিলেন, বলা শক্ত; কিন্তু এ কথা বুঝা শক্ত নয় যে, তিনি গন্ধদ্রব্য এবং আয়ুৰ্বেদীয় উপকরণের একটি ক্ষুদ্র তালিকা মাত্র দিয়াছেন। এই তালিকায় দ্রাক্ষা দ্রব্যটি সন্দেহজনক। যে কয়টি দেশের নাম তিনি করিয়াছেন তাহাদের কোথাও দ্রাক্ষা জন্মানো প্রায় অসম্ভব বলিলেই চলে। আমার মনে হয়, দ্রব্যটি হইবে লাক্ষা; এটি লিপিকর-প্রমাদ, অশুদ্ধ পাঠ। দ্রাক্ষা হয় না বটে, কিন্তু পূর্ব-ভারতের অনেক স্থানে লাক্ষা জন্মায়। এই ষোলোটি জনপদের চারিটি বর্তমান বাঙলাদেশে; যথা, পুণ্ড্র, তাম্রলিপ্তক, সুহ্ম ও ব্রহ্মোত্তর। লাক্ষা রাঢ়দেশে ও উত্তরবঙ্গে বা বরেন্দ্রভূমিতে এখনও জন্মায়। অগুরু বাঙলাদেশে কোথাও জন্মায় কিনা, জানি না; তবে কামরূপের নানা জায়গায় জন্মায়, তাহার প্রমাণ পাইতেছি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ও তাহার টীকায়। ইবন খুর্দদবা নামে একজন আরব ভৌগোলিক (দশম শতক) রহমি দেশে (রহন = আরাকান)। অগুরুকাষ্ঠ জন্মায়, এ কথা বলিতেছেন। কস্তুরী বা কিন্তুরিকা নেপালে হিমালয়ের পাদদেশে হয়তো পাওয়া যাইত; পূর্বদেশের অন্য কোনও জনপদে কন্তুরী-মৃগের বিচরণস্থান ছিল বলিয়া জানি না, তবে কিন্তুরিকা নামে একপ্রকার ভৈষজ্য আছে; রাজশেখর তাহারও ইঙ্গিত করিয়া থাকিতে পারেন। লবলী বরেন্দ্রীতে প্রচুর জন্মাইত; তাহার উল্লেখ রামচরিতে আছে (৩, ১১)। এই শ্লোকেই উল্লিখিত আছে যে, বরেন্দ্রী দেশে বড় বড় লকুচি, শ্ৰীফল ও খাদ্যোপযোগী কন্দমূল জন্মাইত।

 

হীরা, মুক্তা, সোনা, রূপা, তামা, লোহা ইত্যাদি

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের টীকাকার বাঙলাদেশের একটি আকরজ দ্রব্যের খবর দিতেছেন। কৌটিল্য যে অধ্যায়ে মণিরত্নের খবর বলিতেছেন, সেই অধ্যায়ে হীরামণির উল্লেখ আছে। টীকাকার এই হীরামণির খনি কোথায় কোথায় ছিল, তাহা একটি নাতিদীর্ঘ তালিকা দিয়াছেন; এই তালিকার দুইটি জনপদ নিঃসন্দেহে বাঙলাদেশে; তাহাদের নাম, টীকাকারের ভাষায়—পৌণ্ডক এবং ত্রিপুর (= ত্রিপুরা)। জৈন আচারাঙ্গ সূত্রের মতে, রাঢ়দেশের দুইটি বিভাগ ছিল বজ্রভূমি ও সুবভিভূমি (=সুহ্মভূমি)। বজ্রভূমিতে খুব সম্ভব হীরার খনি ছিল; তাহা হইতেই হয়তো বজাতৃভূমি নামের উৎপত্তি। আইন-ই-আকবরী-গ্রন্থে কিন্তু মদারণ বা গড়মন্দারণে এক হীরার খনির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই ভূমি হয়তো পশ্চিম দিকে বিহার-সীমায় অবস্থিত কোখরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জাহাঙ্গীরের আমলে কোখরায় একাধিক হীরাখনির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। আর একটি আকরজ দ্রব্যের উল্লেখও অর্থশাস্ত্ৰে দেখা যায়। গৌড়িক নাম কয়েকপ্রকার খনিজ-রৌপ্যের নাম কৌটিল্যা করিয়াছেন, এবং তাহা যে গৌড়দেশোৎপন্ন, তাহাও তিনি বলিয়াছেন। টীকাকার বলিতেছেন, এই রৌপ্যের রঙ অগুরু। ফুলের মতন। আর একটি খনিজ দ্রব্যের উল্লেখ পাওয়া যায় কতকটা অর্বাচীন একটি গ্রন্থে—ভবিষ্যপুরাণে। এই গ্রন্থ কতটা প্রাচীন এবং ইহার ব্ৰহ্মখণ্ড প্রক্ষিপ্ত, না মূল গ্রন্থের সমসাময়িক, বলা কঠিন। ইহার ব্ৰহ্মখণ্ডে রাঢ়দেশের জাঙ্গল-বিভাগের বিবরণে আছে

ত্ৰিভাগজাঙ্গলং তত্ৰ গ্ৰামশৈচবৈকভাগকঃ
স্বল্প ভূমিরুর্বরা চ বহুলা চোষরা মতাঃ।
রারী (ঢ়ী) খণ্ডজাঙ্গলে চ লৌহধাতোঃ কাচিৎ ক্কচিৎ
আকারো ভবিতা তত্ৰ কলিকালে বিশেষতঃ ॥

এখানে রাঢ়দেশের জাঙ্গলখণ্ডে লৌহখনির উল্লেখ আমরা পাইতেছি। বঁকুড়া-বীরভূমে-সাঁওতালভূমে তো এখনও জায়গায় জায়গায় লোহা আহরণ এবং লোহার তৈজসপত্র, গৃহোপযোগী অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি তৈরি করা স্থানীয় দরিদ্রতর জনসাধারণের জীবন-ধারণের অন্যতম উপায়। এ-সব জায়গায় লোহা গলানোর পদ্ধতিও প্রাগৈতিহাসিক। ভারতবর্ষের বৃহত্তম লৌহ কারখানা তো এখনও বাঙলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমা-সংলগ্ন। তাম্র বা তামা সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা। সুবর্ণরেখার তীর ধরিয়া জামশেদপুর এবং তারপর পশ্চিমে চক্ৰধরপুর ছাড়াইয়া সমানেই তাম্রসমাবেশ এবং তাম্রখনিনিচয়। আমার তো মনে হয়, তাম্রলিপ্ত নামটির মধ্যেও এই তাম্রাসমৃদ্ধির স্মৃতি জড়িত। এই স্মৃতিও প্রাগৈতিহাসিক।

বাঙলাদেশের হীরাসমৃদ্ধির প্রমাণ আরও কিছু আছে। রত্নপরীক্ষা, বৃহৎসংহিতা, নবরত্নপরীক্ষা, রত্নসংগ্ৰহ প্রভৃতি গ্রন্থে সর্বত্রই উল্লেখ আছে, পৌণ্ডদেশ এক সময় হীরার জন্য বিখ্যান্য ছিল; অগস্তিমত-গ্রন্থের মতে বঙ্গেও কিছু কিছু হীরা পাওয়া যাইত। তবে, মনে হয়, এই সমৃদ্ধি খ্রীস্টপূর্ব শতকের; পেরিপ্লাস-গ্রন্থের সময় সে সমৃদ্ধি আর ছিল না। পেরিপ্লাসে গাঙ্গেয় মুক্তার উল্লেখের কথা আগেই বলা হইয়াছে; তাহা ছাড়া, রত্নপরীক্ষা গ্রন্থে এবং মহাভারতের সভাপর্বে পূর্বদেশে সমুদ্রতীরের জনপদগুলিতে মুক্তাসমৃদ্ধির উল্লেখ আছে।

 

পশুপক্ষী, হাতি, হরিণ, মহিষ, বরাহ, ব্যাঘ্র ইত্যাদি

বাঙলাদেশের রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ও সংস্থাপনার মধ্যে হন্তীর একটি প্রধান স্থান ছিল। গ্ৰীক ঐতিহাসিকদের বিবরণীতে পাই, Prasio = প্রাচ্য ও Gangaridae = গঙ্গারাষ্ট্রের সম্রাট Agrammes বা ঔগ্রসৈন্যের সামরিক শক্তি অনেকটা হস্তীর উপর নির্ভর করিত। পাল ও সেন রাজাদের হস্তী, অশ্ব ও নৌবল লইয়াই ছিল সামরিক শক্তি। এই হস্তী আসিত কোথা হইতে? কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰে আছে, কলিঙ্গ, অঙ্গ, করূষ এবং পূর্বদেশীয় হন্তীই হইতেছে সর্বশ্রেষ্ঠ। এই পূর্বদেশ বলিতে কৌটিল্য বাঙলাদেশ, বিশেষভাবে উত্তর-বঙ্গ ও কামরূপের পার্বত্য অঞ্চলের কথা বলিতেছেন, তাহা অনুমান করা যাইতে পারে। এখনও তো গারো পাহাড় অঞ্চল হাতির জায়গা। আর এই বাঙলাদেশেই তো পরবর্তী কালে হাতি ধরার এবং হন্তী-আয়ুৰ্বেদ নামে এক বিশেষ বিদ্যা ও শাস্ত্রের উদ্ভব হইয়াছিল, সে কথা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বহুদিন আগেই প্রমাণ করিয়া গিয়াছেন। প্রাচীন গৌড়দেশ যে হাতির জন্য বিখ্যাত ছিল তাহা রাজতরঙ্গিণীর কবির নিকটও সুবিদিত ছিল। প্রাচ্য ও গঙ্গারাষ্ট্র দেশও একই কারণে বিখ্যাত ছিল, তাহা মেগাস্থিনিসের বিবরণে, এবং কামরূপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে (গারো পাহাড়ে?) যুথবদ্ধ হাতি বিচরণ করিত তাহা যুয়ান-চোয়াঙের বিবরণে জানা যায়। জীবজন্তু পশুপক্ষীও দেশের ধন-সম্বলের মধ্যে গণ্য। হাতি ছাড়া অন্যান্য পশুর উল্লেখ কিছু কিছু বাঙলার লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীতে একটি গহন বন কাটিয়া নূতন এক গ্রাম পত্তন করিবার কথা আছে; সেই বনে যে-সব জীবজন্তুর উল্লেখ আছে তাহার মধ্যে হরিণ, মহিষ, বরাহ, ব্যাঘ্র ও সর্প অন্যতম। আদিম বাঙালীর সর্প ও ব্যাঘ্র-ভীতি সুবিদিত, এবং এই দুইটি প্রাণী ভয় দেখাইয়া কী করিয়া তাহাদের পূজা আদায় করিয়াছিল তাহাও এখন আর অবিদিত নয়। মধ্যযুগে মনসাপূজা এবং দক্ষিণরায় বা ব্যাঘ্ৰপূজার বিস্তৃত প্রচলন এই দুইটি প্রাণী হইতেই। বনবহুল বৃষ্টিবহুল গ্ৰীষ্মপ্রধান এই দেশে এই দুয়েরই অপ্রতিহত প্রভাব। বিশেষভাবে বনময় জলময় সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলি তো এই দুই প্রাণীর লীলাস্থল। পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকগুলিতে এবং কোনও কোনও প্রস্তরচিত্রে আরও অন্যান্য নানা জীবজন্তুর পরিচয় পাওয়া যায়; তাহার মধ্যে গোরু, বানর, হরিণ, শূকর, ঘোড়া ও উট উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত দুইটি প্রাণী বিদেশাগত, সন্দেহ নাই এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য-সংক্রান্ত ব্যাপারেই হয়তো ইহাদের আমদানি হইয়াছিল। পক্ষীর উল্লেখ ও পরিচয় কমই পাওয়া যায়; তবে হাঁস, বন্য ও গৃহপালিত কুকুট, কপোত, নানা জাতীয় জলচর বিহঙ্গ, কাক ও কোকিলের উল্লেখও পরিচয় লিপিগুলিতে, মৃৎ ও প্রস্তর চিত্রে ও সমসাময়িক সাহিত্যে দুর্লভ নয়। বাঘ, হরিণ, বন্য মহিষ, নানা প্রকার হাঁস, বানর ইত্যাদি যে বাঙলার সাধারণ বন্য প্রাণী তাহা মধ্যযুগের  Ralph Fitch (1583-91)- Fernandes (1598)- Fonseca (1599) প্রভৃতি পর্যটকদের বিবরণী পড়লেও জানিতে পারা যায়।