০২. কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেল

॥ ২ ॥

কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলটা দিব্যি ছিমছাম। ঘরে ঘরে টেলিফোন, হীটার, স্নানের ঘরে ঠাণ্ডা-গরম জলের ব্যবস্থা, বিছানার চাদর, বালিশ পরিষ্কার—মোটকথা সব কিছু দেখে মনটা যাকে বলে বেশ প্রসন্ন হয়ে গেল। দিন দশেকের জন্য এসেছি, তাই থাকার ব্যবস্থাটা মোটামুটি ভালো না হলে মনটা খুঁতখুঁত করে।

পথে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। সোনাদা এলে পর লালমোহনবাবু তাঁর রাজস্থান থেকে কেনা কান-ঢাকা চামড়া আর পশমের টুপিটা মাথায় চাপিয়ে নিলেন। পথের দুধারে পাহাড়ের দৃশ্য দেখে উনি কতবার যে ‘বাঃ’ বলেছেন তার হিসেব নেই। শেষটায় কার্সিয়ং রেলওয়ে রেস্টোরান্টে চা খাবার সময় ভদ্রলোক সত্যি কথাটা বলে ফেললেন। সেটা হল এই যে তিনি এই প্রথম দার্জিলিং-এ চলেছেন।

ফেলুদার চোখ কপালে উঠে গেল।

‘সেকি, আপনি এখনো কাঞ্চনজঙ্ঘাই দেখেননি?’

‘নো স্যার।’ একগাল হেসে জিভ কেটে বললেন লালমোহনবাবু।

‘ইস্‌—আপনাকে প্রচণ্ড হিংসে হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার যে কী অদ্ভুত অনুভূতি, সেটা ত আমাদের মধ্যে একমাত্র আপনিই বুঝবেন! ইউ আর ভেরি লাকি, মিস্টার গাঙ্গুলি।’

আকাশ পরিষ্কার থাকলে কার্সিয়ং থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, কিন্তু আজ ছিল মেঘলা। ঘুম যখন পৌঁছলাম তখন আলো পড়ে আসছে, আর তখনো মেঘ কাটেনি। মোটকথা লালমোহনবাবুর ভাগ্যে ব্যাপারটা এখনো ঘটেনি। এটা অবিশ্যি দার্জিলিং-এর বিখ্যাত ঘটনা। এমনও হতে পারে যে এই দশ দিনের একদিনও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে না। তাহলে অবিশ্যি খুবই খারাপ হবে। আমি নিজে এর আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে থাকলেও আবার নতুন করে দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছি। এই একটা দৃশ্য যা কোনদিনও পুরোন হবার নয়।

হোটেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেক খাড়াই উঠেই ম্যাল। যখন পৌঁছলাম তখন দোকানের আর রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। লালমোহনবাবু বললেন, ‘কী ব্যাপার মশাই, গাড়িটাড়ি দেখছি না কেন?’ ফেলুদাকে বুঝিয়ে দিতে হল দার্জিলিং-এর বেশ খানিকটা অংশে গাড়ি চলা নিষিদ্ধ। ম্যালটা হল সেরকম একটা জায়গা। এখানে শুধু হাঁটা চলে আর ঘোড়ায় চড়া চলে। ‘আপনি ঘোড়ায় চড়েছেন কখনো?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা।

‘নাঃ’, বললেন লালমোহনবাবু। ‘তবে উটেই যখন চড়া আছে তখন ঘোড়া ত তার কাছে নস্যি।’

আগেই বলেছি যে বিরূপাক্ষ মজুমদার বলে একজনের বাড়িতে শুটিং হবার কথা আছে। আশ্চর্য এই যে প্রথম দিনই ম্যালে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। সেটা হল পুলক ঘোষালের মারফৎ। শুটিং পার্টি ম্যালে বেড়াতে বেরিয়েছে, পুলক ঘোষাল একবার আগেই দার্জিলিং এসে বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়ি দেখে পছন্দ করে গেছেন, ভদ্রলোকও কোনো আপত্তি করেননি। ফেলুদাকে দেখেই পুলকবাবু এগিয়ে এলেন, তাঁর সঙ্গে একজন ফেল্ট হ্যাট আর সুট পরা ভদ্রলোক।

‘এঁর বাড়িতেই আমরা শুটিং করছি,’ বললেন পুলকবাবু, ‘ইনি হলেন মিস্টার বিরূপাক্ষ মজুমদার।’

তারপর পুলকবাবু আমাদের তিন জনের পরিচয় দিয়ে দিলেন ভদ্রলোককে।

‘আপনার সঙ্গে শুটিং-এর কী সম্পর্ক?’ ফেলুদাকে জিগ্যেস করলেন মিঃ মজুমদার।

ফেলুদা বলল, ‘আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তবে আমার এই বন্ধুটি একজন বিখ্যাত রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক। এঁরই একটি গল্প থেকে ছবিটা হচ্ছে।’

‘বাঃ, ভেরি গুড। ইনি ক্রাইম রাইটার, আর আপনি গোয়েন্দা—ভেরি গুড! প্রদোষ মিত্র নামটা ত জানা বলে মনে হচ্ছে। আপনার নাম ত কাগজে বেরিয়েছে কয়েকবার, তাই না?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ’, বলল ফেলুদা। ‘গত বছর বোসপুকুরে একটা খুনের ব্যাপারে আমি কিছুটা সাহায্য করেছিলাম।’

‘দ্যাট্‌স রাইট’, বলে উঠলেন ভদ্রলোক, ‘তাই চেনা চেনা লাগছিল। আমার আবার একটা বাতিক আছে; আমি খবরের কাগজের খবর সংগ্রহ করি। আমার সতের বছর বয়স থেকে এই হবি। সব খবর নয়, যাকে বলা যায় একটু গরম খবর। একত্রিশটা খণ্ড হয়েছে সেই খবরের খাতার। এখন ত রিটায়ার করেছি; মাঝে মাঝে সেই সমস্ত পুরোনো খাতার পাতা উল্টে উল্টে দেখি। লোকে গল্পের বই পড়ে, আর আমি পুরনো খবর পড়ি। এখন অবিশ্যি আমার একজন হেল্‌পার হয়েছে। রজত—আমার সেক্রেটারি—আমার কাটিংগুলো খাতায় সেঁটে দেয়। আপনার কাটিংও আছে তার মধ্যে।’

আপনার কাটিংও আছে তার মধ্যে

আমরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছিলাম ম্যালের মুখে ফোয়ারাটা ছাড়িয়ে মেন রোডের দিকে। মিঃ মজুমদার বললেন, ‘আমার একটা ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, কেনা দরকার। চলুন না ওই কেমিস্টের দোকানে।’

আমরা গিয়ে দোকানে ঢুকলাম। ভদ্রলোক টফ্রানিল নামে রাংতায় মোড়া একত্রিশটা বড়ি কিনলেন। বললেন, ‘এ হল অ্যান্টি-ডিপ্রেসন্ট পিল্‌স্‌—আমার এক মাসের স্টক। রোজ একটি করে না খেলে আমার ঘুম হয় না।’

দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, ‘একদিন গিয়ে আপনার খাতাগুলো একটু দেখব।’

‘একশোবার!’ বললেন ভদ্রলোক। ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। এও আপনাকে দেখিয়ে দেব যে এখনও কিনারা হয়নি এমন পুরোনো তদন্তের খবরও আমার খাতায় সাঁটা আছে। আমি বলছি প্রায় বিশ বছর আগের কথা।’

‘খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ত।’ বলল ফেলুদা।

‘অবিশ্যি আমার নিজের জীবনটাও কম ইন্টারেস্টিং নয়,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘এক এক সময় ইচ্ছে করে আত্মজীবনী লিখি, কিন্তু তার পরেই মনে হয়—সবগুলো সত্যি কথা ত লিখতে পারব না। আত্মজীবনী লিখতে গেলে কোনো কিছু গোপন রাখা উচিত নয়। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। যাক্‌ গে—একদিন আসবেন।’

‘কোন সময় গেলে আপনার ব্যাঘাত হবে না?’

‘দ্য বেস্ট টাইম ইজ ইন দ্য মর্নিং। আমি বিকেলে একটু ঘুরতে বেরোই। মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল ছাড়িয়ে একটু গেলে বাঁয়ে একটা রাস্তা পাবেন যেটা পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে। সেটা দিয়ে কিছুদূর গেলেই দেখবেন গেটে “নয়নপুর ভিলা” লেখা একটা বাগানে ঘেরা বাংলো। সেটাই আমার বাড়ি।’

ভদ্রলোক হাত তুলে গুড বাই করে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘোড়ায় চাপলেন, সঙ্গে একজন সহিস। ফেলুদা বলল, ‘রুগী মানুষ, খাড়াই ওঠা বারণ, তাই নিশ্চয়ই ঘোড়া ব্যবহার করেন। তবে বেশ লোক, তাতে সন্দেহ নেই।’

শুটিং পার্টির সকলে এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে দেখছে, পুলকবাবু এগিয়ে এসে বললেন, ‘মজুমদার মশাইকে কেমন লাগল?’

‘খুব ভালো’, বলল ফেলুদা। ‘অসুখ হলে কী হবে, এখনো বেশ তাজা আছেন।’

‘আর সব ব্যাপারে ইন্টারেস্ট। শুটিং-এর বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করছিলেন।’

‘উনি ছাড়া আর কে থাকেন ওঁর বাড়িতে?’

‘ওর সেক্রেটারি আছেন, রজত বোস। এ ছাড়া জনা তিনেক চাকর, মালি আর সহিস আছে। ভদ্রলোক বিপত্নীক। ওঁর ছেলে আসছেন কলকাতা থেকে। অন্তত কথা ত আসার। একটিই ছেলে। মেয়ে আছে দুটি, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা কলকাতায় থাকে না।’

‘ভদ্রলোকের হবিটা কিন্তু খুব চিত্তাকর্ষক।’

‘কাটিং জমানোর কথা বলছেন?’

‘হ্যাঁ। অনেকটা আমাদের সিধু জ্যাঠার কথা মনে পড়ছে।’

আমারও যে তা মনে হয়নি তা নয়, তবে সিধু জ্যাঠা শুধু খুনখারাপির খবরই জমান না; ইন্টারেস্টিং খবর হলেই সেটা সেঁটে রাখেন।

কথা আর বেশিদূর এগোল না। পুলকবাবু বললেন শুটিং-এর অনেক তোড়জোড় আছে, এবার হোটেলে ফিরতে হবে। আগামীকাল নাকি খুব হাল্‌কা আউটডোরের কাজ রাখা হয়েছে; তার পরদিন থেকে আর্টিস্ট নিয়ে কাজ শুরু হবে, আর প্রথমেই বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়িতে কাজ।

পুলক ঘোষাল সমেত ফিল্মের দল চলে যাবার পর আমরা ম্যালের কাছেই কেভেনটারের দোকানের খোলা ছাতে বসে হট চকোলেট খেলাম। লালমোহনবাবু খুব তৃপ্তি সহকারে চকোলেটে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘মশাই, আমার মন কিন্তু একটা কথা বলছে।’

‘কী বলছে?’

‘বলছে এ যাত্রা বৃথা যাবে না।’

‘বৃথা কেন যাবে? দার্জিলিং-এ এসেছি চেঞ্জে, এমন চমৎকার ক্লাইমেট, বৃথা কখনো যেতে পারে? পোলিউশন-ফ্রী আবহাওয়া—শরীর সারতে বাধ্য।’

‘আমি সেদিক দিয়ে বলছি না,’ একটা বিজ্ঞ হাসি হেসে বললেন জটায়ু।

‘তবে কোন দিক দিয়ে বলছেন?’

‘আমি আপনার পেশার কথা ভাবছি।’

‘আমার পেশা?’

‘আমার মন কেন জানি বলছে যে, আপনাকে কাজে লেগে পড়তে হবে।’

ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, ‘আসলে মুশকিলটা করছে আমার পেশা নয়, আপনার পেশা। আপনার স্বভাবই হল অলিতে গলিতে রহস্যের গন্ধ পাওয়া। অবিশ্যি যদি তেমন কিছু ঘটেই বসে, গড ফরবিড, তাহলে ফেলু মিত্তির হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না এটা জোর দিয়ে বলতে পারি।’

‘এই ত চাই! এই ত এ. বি. সি. ডি.-র পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত মনোভাব!’

এইখানে বলে রাখি, এ. বি. সি. ডি. হল লালমোহনবাবুর ফেলুদাকে দেওয়া খেতাব । এর মানে হল এশিয়াজ ব্রাইটেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর। কাজেই উনি ফেলুদাকে মাঝে মাঝে এ. বি. সি. ডি. বলে সম্বোধনও করে বসেন।

আমি জানি না, কিন্তু বিরূপাক্ষ মজুমদারের সঙ্গে যেটুকু আলাপ হল, তাতে আমারও ভদ্রলোককে বেশ রহস্যজনক চরিত্র বলে মনে হল। বছরের পর বছর প্রায় একাই দার্জিলিং-এ পড়ে আছেন, খাতায় গরম গরম খবর সাঁটছেন, আর পুরোন খবর পড়ে দেখছেন। অবিশ্যি তার মানেই যে তাঁকে ঘিরে কোনো ক্রাইম ঘটবে সেটা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। আসল কথাটা হচ্ছে কি—ফেলুদা চেঞ্জে গেলেও যে সেখানে শেষ পর্যন্ত তাঁকে গোয়েন্দার ভূমিকা নিতে হয়, এটা এতবার দেখেছি যে, মন বলছে এবারও সেটা না হয়ে যায় না।

দেখা যাক, কপালে কী আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *