০২. উপাদান-বিবৃতি ৷। ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলী

উপাদান-বিবৃতি ৷। ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলী

শ্ৰেণী-বিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের প্রধান উপকরণ ভূমিদানি-বিক্রয়ের পট্টোলী, এবং সমর্থক ও আনুষঙ্গিক উপকরণ–পাল ও সেন আমল— সমসাময়িক সাহিত্য, বিশেষভাবে বৌদ্ধ, চর্যাগীতি, বৃহদ্ধৰ্মপুরাণ, ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ ও বাঙলার স্মৃতিগ্রন্থাদি। শেষোক্ত গ্রন্থগুলি সম্বন্ধে বর্ণ-বিন্যাস অধ্যায়ে আলোচনা করা হইয়াছে। বর্তমান প্রসঙ্গে পট্টোলীগুলির স্বরূপ বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন।

মহাস্থান শিলাখণ্ড লিপি বা চন্দ্ৰবৰ্মার শুশুনিয়া লিপি আমাদের বিশেষ কোনও কাজে লাগিতেছে না। যদি অনুমান করা যায় যে, মৌর্যকালে বাঙলাদেশ অথবা তাহার কতকাংশ মৌর্য সম্রাটদের করতলগত ছিল এবং মৌর্যশাসন-পদ্ধতি এ দেশেও প্রচলিত ছিল, তাহা হইলে ধরিয়া লাইতে হয় যে, মৌর্যরাষ্ট্রে আমরা যে-সব রাজপুরুষদের পরিচয় অশোকের লিপিমালা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মেগাস্থিনিসের ইণ্ডিকা-গ্রন্থ হইতে পাই, সেই সব রাজপুরুষেরা এদেশেও বিদ্যমান ছিলেন, এবং মৌর্য প্রাদেশিক-শাসনের যন্ত্র পুদনগলের (পুণ্ড্রনগরের) মহামাত্যের নির্দেশে বাঙলাদেশেও পরিচালিত হইত। কিন্তু তাহা হইলেও এই অনুমান বা প্রমাণ হইতে আমরা একমাত্র রাজপুরুষশ্রেণী বা সরকারি চাকুরীয়া ছাড়া আর কোনও শ্রেণীর খবর পাইলাম না। পরবর্তী যুগেও কতকটা তাঁহাই; উত্তর-ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সমসাময়িক লিপিগুলি অধিকাংশই তো রাজরাজড়ার বংশপরিচয় ও যুদ্ধ-জয়বিজয়ের এবং অন্যান্য কীর্তিকলাপের বিবরণ। এই সব লিপিতেও রাজপুরুষশ্রেণী ছাড়া আর কাহারও খবর বড় একটা নাই। সমসাময়িক সংস্কৃত-সাহিত্যে, যেমন শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকে, ভাসের দু’একটি নাটকে, কালিদাসের শকুন্তলায় পরোক্ষ ভাবে সমাজের অন্যান্য বৃত্তি ও শ্রেণীর খবরাখবর কিছু কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু তাহাও অত্যন্ত অস্পষ্ট। শুঙ্গ আমলের ভরহুত স্তুপের বেষ্টনীতে কিংবা কিছু পরবর্তী কালের সীচীর শিলালিপিগুলিতে ও মথুরায় প্রাপ্ত কোনও কোনও লিপিতে, কোনও কোনও প্রাচীন মুদ্রায়ও এই ধরনের পরোক্ষ কিছু কিছু খবর আছে; শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীশ্রেণীর আভাস তাহাতে আছে। বস্তুত, একমাত্র জাতক-গ্ৰন্থ ছাড়া আর কোনও উপাদানের ভিতরই প্রাচীন ভারতের শ্রেণী-বিন্যাসের সুস্পষ্ট চেহারা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। পঞ্চম শতক পর্যন্ত বাঙলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধেও এ কথা প্রযোজ্য। তবে, অনুমান করিয়া একটা অস্পষ্ট চেহারা আঁকিয়া লওয়া যায়। কিন্তু সে-চেষ্টা করিয়া লাভ নাই।

পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত বাঙলাদেশ-সংক্রান্ত পট্টোলীগুলি সমস্তই ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিল। এই পট্টোলীগুলির মধ্যে আমরা শ্রেণী-সংবাদ যে খুব বেশি পাইতেছি, তাহা নয়; তবে দুইটি শ্রেণী বেশ পরিষ্কার হইয়া উঠিতেছে, এ কথা সহজেই বলা চলে, একটি রাজপুরুষ শ্রেণী, আর একটি বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী। তাহা ছাড়া, মহত্তরাঃ, ব্ৰাহ্মণাঃ, কুটুম্বিনঃ, ব্যবহারিণঃ প্রভৃতি, এবং সাধারণ ভাবে “অক্ষুদ্র প্রকৃতি’ অর্থাৎ গণ্যমান্য জনসাধারণের সঙ্গেও আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে। ব্ৰাহ্মণদের বৃত্তি কী ছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়। মহত্তর (মহতর=মাহাতো = মাতব্বর লোক, অর্থাৎ সম্পন্ন গৃহস্থ), কুটুম্ব (অর্থাৎ গ্রামবাসী সাধারণ গৃহস্থ) এবং ‘অক্ষুদ্র প্রকৃতি’ জনসাধারণ কিংবা যে সমস্ত সদব্যবহারী’ কোনও বিশেষ প্রয়োজনে নিজেদের মতামত দিবার জন্য স্থানীয় অধিকরণের (তথা রাষ্ট্রের) সাহায্য-নিমিত্ত আহুত হইতেন, তাহাদের বৃত্তি কী ছিল, তাঁহারা কোন শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত ছিলেন, এ-সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনও আভাস এই লিপিগুলিতে পাওয়া না গেলেও অনুমান করা খুব কঠিন নয়। ভূমি দান-বিক্রয় উপলক্ষে যাঁহাদের সাহায্যের প্রয়োজন হইতেছে, যাঁহাদের এই দান-বিক্রয় বিজ্ঞাপিত করা প্রয়োজন হইতেছে, তাহাদের মধ্যে শ্রেণী হিসাবে কোনও শ্রেণীর উল্লেখ নাই; তবে যাঁহারা এই ব্যাপারে প্রধান তাহদের মধ্যে রাজপুরুষশ্রেণী এবং বণিক-ব্যবসায়ীশ্রেণীর লোকেদেরই নিঃসংশয় উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। অন্য যাঁহাদের উল্লেখ আছে, তাহারা কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণী:পর্যায়ভুক্ত বলিয়া উল্লিখিত হন নাই, কিন্তু উল্লেখের রীতি দেখিয়া মনে হয়, শ্রেণীর ইঙ্গিত বর্তমান। সঙ্গে সঙ্গে ইহাও মনে রাখা দরকার যে, রাজপুরুষদের উল্লেখ তাহাদিগের অধিকৃত পদমর্যাদার জন্যই। সুস্পষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত করিয়া তাহাদিগকে উল্লেখ করা হইতেছে না; তেমন উল্লেখের প্রয়োজনও হয় নাই।

অষ্টম শতক হইতে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত লিপিগুলির স্বরূপ একটু ভিন্ন প্রকারের। এইগুলি সবই ভূমিদানের দলিল। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতকের দলিলগুলিতে ভূমি কী ভাবে বিক্ৰীত হইতেছে, এবং পরে কী ভাবে দান করা হইতেছে, তাহার ক্রমের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। অষ্টম শতক-পরবর্তী দলিলগুলিতে ভূমি ক্ৰয়ের যে ক্রম তাহা আমাদের দৃষ্টির বাহিরে; আমরা শুধু দেখি, রাজা ভূমি দান করিতেছেন, এবং সেই ভূমিদানি বিজ্ঞাপিত করিতেছেন। এই বিজ্ঞাপন যাঁহাদের নিকট করা হইতেছে, তাহাদের উপলক্ষ করিয়া সমসাময়িক প্রায় সমস্ত শ্রেণীর লোকেদের কথাই উল্লিখিত হইয়াছে। র্যাহাদিগকে বিজ্ঞাপিত করার কোনও প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় না, তাহাদেরও জানানো হইতেছে; যেমন, যে-গ্রামে ভূমিদান করা হইতেছে, সেই গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের সমস্ত শ্রেণীর লোকেদের নিশ্চয়ই জানানো প্রয়োজন, সেই গ্রাম যে বীথী বা মণ্ডল বা বিষয় বা ভুক্তিতে অবস্থিত তাহার রাজপুরুষদের জানানো প্রয়োজন, কিন্তু রাজনক, রাজপুত্র, রাজমাতা, সেনাপতি ইত্যাদি সকল রাজপুরুষদের জানাইবার কোনও প্রয়োজন বাস্তবক্ষেত্রে আছে বলিয়া তো মনে হয় না। কিংবা মালব, খস, কুণ, কর্ণাট, লাট ইত্যাদি ভিনদেশাগত বেতনভোগী সৈন্যদের বিজ্ঞাপিত করিবার কারণও কিছু বুঝা যায় না। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত লিপিগুলিতে এই ধরনের সর্বশ্রেণীর, সকল বৃত্তিধারী লোকের উল্লেখ নাই; সেখানে যে-বিষয়ে অথবা মণ্ডলে ভূমি দান-বিক্রয় করা হইতেছে, সেই বিষয়ের অথবা মণ্ডলের রাজপুরুষ, বণিক ও ব্যবসায়ী, মহত্তর, ব্ৰাহ্মণ, কুটুম্ব ইত্যাদির বাহিরে আর কাহারও উল্লেখ করা হইতেছে না।