০২. অন্সরা থিয়েটারের অভিনেতা নিখোঁজ

॥ ২ ॥

খবরটা জানা গেল খবরের কাগজ মারফৎ। ছোট করে লেখা খবর—অপ্সরা থিয়েটারের অভিনেতা নিখোঁজ। মহীতোষ রায় নাকি সন্ধ্যাবেলা থিয়েটার না থাকলে লেকের ধারে বেড়াতে যেতেন। গত পরশু, অর্থাৎ সোমবার, তিনি যথারীতি বেড়াতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেন নি। বাড়ির চাকর থানায় গিয়ে খবর দেয়। পুলিশ এই নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।

ফেলুদা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘লোকটাকে পই পই করে বলেছিলাম সাবধানে থাকতে, তার লেকে বেড়াতে যাবার কি দরকার ছিল? যাই হোক, আমার কাছে যখন এসেছিলেন ভদ্রলোক, তখন একবার ওঁর বাড়িতে যাওয়া দরকার। ঠিকানাটা মনে আছে?’

‘পাঁচ নম্বর পণ্ডিতিয়া প্লেস।’

‘গুড। তোর স্মরণশক্তি পরীক্ষা করছিলাম।’

নটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

পাঁচ নম্বর পণ্ডিতিয়া প্লেস একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি, তার একতলায় থাকতেন মহীতোষবাবু। চাকর দরজা খুলে দিলে আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ফেলুদা চাকরকে বলল, ‘তোমার মনিব আমার কাছে এসেছিলেন সাহায্য চাইতে। উনি মাঝে মাঝে হুম্‌কি চিঠি পাচ্ছিলেন সে খবর তুমি জান?’

‘জানি বৈ কি বাবু। আমি বাইশ বছর ওনার কাজ করছি। আমাকে সব কথাই বলতেন। আমি ওঁকে অনেক করে বলেছিলাম—আপনি বেড়াতে যাবেন না, বাড়িতে থাকুন, সাবধানে থাকুন। তা উনি আমার নিষেধ শুনলেন না। যখন দেখলাম রাত সাড়ে নটা হয়ে গেল তাও আসছেন না, তখন আমি নিজেই গেলাম লেকে। কোনখানটায় উনি বসতেন, কোনখানটায় বেড়াতেন, সেটা আমি জানতাম। কিন্তু কই, তাঁকে ত কোথাও দেখতে পেলাম না। তারপর পুরো একটা দিন কেটে গেল, এখনো কোনো খবর নেই। আমি থানায় গেসলাম। তেনারা সব লিখে-টিখে নিলেন, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ত কিছুই হল না’।

চলুন বাবু, যাচ্ছি।

ফেলুদা বলল, ‘তুমি এখন আমাদের সঙ্গে একবার আসতে পারবে? লেকে যে জায়গাটায় বসতেন সেটা যদি একবার দেখিয়ে দাও।’

‘চলুন বাবু, যাচ্ছি।’

‘তোমার নাম কী?’

‘দীনবন্ধু, বাবু।’

আমরা তিনজন ট্যাক্সি করে লেকে গিয়ে হাজির হলাম।

জলের ধারে একটা আমলকি গাছের পাশে একটা বেঞ্চি, তাতেই নাকি হাঁটা সেরে বসতেন ভদ্রলোক। হাঁটার অভ্যাসটা ডাক্তারই বলে বলে করিয়েছিলেন। এখন চতুর্দিকে কোনো লোক নেই, ফেলুদা খুব মন দিয়ে বেঞ্চি আর তার চারপাশটা পরীক্ষা করে দেখল। প্রায় মিনিট পাঁচেক তন্ন তন্ন করে খুঁজে ঘাসের মধ্যে একটা পিতলের কৌটো পেল। দীনবন্ধু সেটা দেখামাত্র বলে উঠল, ‘এ কৌটো ত বাবুর ছিল।’ কৌটোটা খুলে ভিতরে এলাচ আর সুপুরি পাওয়া গেল। ফেলুদা সেটা পকেটে পুরে নিল। তারপর দীনবন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি ভবানীপুর থানায় খবর দিয়েছিলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু।’

‘ঠিক আছে। চল তোমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমরা একটু থানায় খবর করে আসি।’

মোটামুটি কলকাতার বেশির ভাগ থানার ও.সি-র সঙ্গেই ফেলুদার আলাপ আছে। ভবানীপুর থানার ও.সি হচ্ছেন সুবোধ অধিকারী। আমরা দীনবন্ধুকে পণ্ডিতিয়া প্লেসে নামিয়ে দিয়ে গেলাম অধিকারীর সঙ্গে দেখা করতে। রাশভারী হলেও বেশ মাইডিয়ার লোক, আর ফেলুদাকে খুব পছন্দ করেন। আমাদের দেখে একটু অবাক হয়েই বললেন, ‘কী ব্যাপার, এত সকাল সকাল?’

আমরা দুটো চেয়ারে বসলাম।

ফেলুদা বলল, ‘একটা ডিসাপিয়ারেন্সের কেস আপনাদের কাছে রিপোর্টেড হয়েছে। মহীতোষ রায়।’

‘হ্যাঁ। এটা বোধহয় সত্যবান দেখছিল। দাঁড়ান, ওকে ডাকি। একটু চা চলবে?’

‘তা আপত্তি নেই।’

মিনিট খানেকের মধ্যেই ইন্‌সপেক্টর সত্যবান ঘোষ এসে গেলেন। ইনিও ফেলুদার যথেষ্ট চেনা; দুজনে হ্যাণ্ডশেক করার পর সত্যবান বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন।’

‘মহীতোষ রায় বলে একটি অভিনেতা বোধহয় নিরুদ্দেশ হয়েছেন?’

‘নিরুদ্দেশ কেন, আমার ত মনে হয় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁর বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা হুম্‌কি চিঠি পাওয়া গেছে। আর লেকের ধারে মেরে ফেলে গায়ে কিছু ভারী জিনিস বেঁধে লাশ জলে ফেলে দিলে সে ত আর পাওয়াও যাবে না। আপনি এ ব্যাপারে কী করে ইন্টারেস্টেড হলেন?’

ফেলুদা মহীতোষবাবুর আসার কথাটা বলল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কোনোরকম এগোবার রাস্তা খুঁজে পাননি বোধহয়?’

ঘোষ বললেন, ‘ভদ্রলোক অপ্সরা থিয়েটারে অভিনয় করতেন। আমরা সেখানে খোঁজ করেছি, কিন্তু কিছু এগোতে পারিনি। থিয়েটারের কারুর সঙ্গে এমন শত্রুতা ছিল না যে খুন হতে পারে। পেটি জেলাসি সব সময়ই থাকতে পারে, কিন্তু সেটা খুনের কারণ হয় না।’

‘ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল?’

‘মোটামুটি। বারোশ টাকা মাইনে পেতেন। একা মানুষ, তাই চলে যেত। অবিশ্যি খুনই যে হয়েছে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। ভদ্রলোককে কেউ হয়ত ফুসলে নিয়ে গেস্‌ল, কিংবা ভদ্রলোক হয়ত নিজেই কোনো কারণে গা ঢাকা দিয়েছেন।’

‘আমি আজ লেকের ওখানে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক যে বেঞ্চিতে বসতেন তার পাশেই ঘাসে ওঁর একটা মশলার কৌটো পাই।’

‘তাই বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে ত খুন বলেই মনে হচ্ছে। আততায়ীর সঙ্গে স্ট্রাগলের সময় পকেট থেকে কৌটোটা পড়ে গেছল।’

‘তাই ত মনে হচ্ছে।’

‘ঠিক আছে! আমাদের এদিক থেকে কোনো খবর পেলে আপনাকে জানাব।’

‘ভেরি গুড। আমিও আপনাদের টাচে থাকব।’

মিঃ ঘোষ চলে গেলেন। চা এসে গিয়েছিল, আমরা চা খেয়ে উঠে পড়লাম।

বাইরে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, ‘একবার অপ্সরা থিয়েটারে যাওয়া দরকার। ওই কেমিস্টের দোকান থেকে লালমোহনবাবুকে একটা ফোন করে বলে দে উনিও যেন চলে আসেন।’

ফোন করে আমরা আবার ট্যাক্সি ধরলাম। যেতে হবে সেই শ্যামবাজার।