০১. শতক বিহরণ

শতক বিহরণ

কালের অনন্ত প্রবাহে একশ’ বছর এক অতি সামান্য বিন্দুমাত্র। কিন্তু বঙ্গাব্দ চোদ্দ শতকের এই সামান্য সময়কালের মধ্যেই ঘটে গিয়েছে বৈপ্লবিক ঘটনাসমহ যথা, দই মহাযুদ্ধ, এক মন্বন্তর, স্বাধীনতা লাভ ও দেশ বিভাগ, গগনস্পর্শী মূল্যস্ফীতি, নৈতিক শৈথিল্য, মানবিক সত্তার অবনতি, নারী নির্যাতন-ধর্ষন ও বাঙালীর আত্মহনন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভ । সেই ঘটনাই শতাব্দীর ইতিহাসকে বিভক্ত করে দভাগে । সেই ঘটনা ঘটবার আগে আমরা কিরকম ছিলাম ও পরে কি হয়েছি, সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ।

বঙ্গাব্দ ১৩০০-র আগের একশ’ বছরে বাঙলায় ঘটে গিয়েছিল নবজাগরণ বা রেনেসাঁ। যদিও রেনেসাঁর প্রধান হোতাদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যু ঘটেছিল ১২৮০ বঙ্গাব্দে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১২৯৮ বঙ্গাব্দে ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৩০০ বঙ্গাব্দে, তা হলেও তাঁদের তিরোধানের সঙ্গে রেনেসাঁর ধারা শুকিয়ে যায়নি। পূর্ণমাত্রায় চলেছিল সেই ধারা । দেশকে বড় ও মহৎ করাই ছিল রেনেসাঁর হোতাদের প্রধান লক্ষ্য । ১৩০০ বঙ্গাব্দেই আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে দেখি আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত ধর্ম মহাসভায় ভারতীয় সংস্কৃতির মহান আদশ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বজনের মন জয় করতে। ভারত সেদিন গর্বিত হল, যখন পড়ল ‘নিউ ইয়র্ক হেরালড’-এর স্তম্ভে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে লিখিত প্রশস্তি—’ভারতের বাত্যাসৃজনী ঋষি ধর্মমহাসভার বৃহত্তম মানুষ ।’

বস্তুত শতাব্দীর প্রথম পাদটা ছিল ভারতের এক অত্যাশ্চর্য ও আনন্দমুখের যােগ । মোহনবাগান জয় করল আই এফ এ শিল্ড । রবীন্দ্রনাথ পেলেন নোবেল পরিস্কার। শরৎচন্দ্র শুরু করলেন তাঁর আবিস্মরণীয় উপন্যাসসমূহ । আমেরিকায় গিয়ে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় পেলেন তাঁর ‘গ্ৰে নেক’ গ্রন্থের জন্য মার্কিন মুলুকের বিখ্যাত পুরস্কার ‘জন নিউবেরি পদক’। প্রথম মহাযদ্ধের সময় বাঙালী দূর করল। সাহেবদের দেওয়া অপবাদ যে বাঙালীর সামরিক শৌর্যবীর্য নেই। সামরিক বাহিনীতে যোগদান করে এক দল বাঙালী বীর সেদিন বিশ্বকে চমৎকৃত করল। পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানদের গোলাবর্ষণের ব্যূহ ভেদ করে কেড়ে নিয়ে এল জার্মানদের কামানগুলো । বস্তুত, ধর্ম, ক্ৰীড়া, সাহিত্য, সামরিক শৌর্যবীর্য, সব ক্ষেত্রেই স্বীকৃত হল বাঙালীর শ্রেষ্ঠত্ব ।

।। দুই ।।

চিন্তাশীলতার ক্ষেত্রে বাঙালী সেদিন ছিল অদ্বিতীয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন–‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইণ্ডিয়া থিংকস টুমরো ।’ গোপালকৃষ্ণ গোখলের এই উক্তির মধ্যে কোন অতিরঞ্জন ছিল না। আগের শতকে বাঙলাই ছিল নবজাগতির প্রসূতিগার। সব বিষয়ে বাঙালী ছিল এগিয়ে । ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে (১৩০০ বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছিল ১৩ এপ্রিল ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে ) বোম্বাইয়ে যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়, তখন তার সভাপতিত্ব করলেন একজন বাঙালী–উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার প্রথম বাঙালী সিভিলিয়ান নিযুক্ত হলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর । সাহেবদের ইংরেজি লেখার ভুল ধরতে লাগলেন রেভারেণ্ড লালবিহারী দে ।

চিন্তাশীলতার ক্ষেত্রে শতাব্দীর প্রথমার্ধে আমরা যেসব অনন্যসাধারণ বাঙালীকে দেখি, তাঁদের মধ্যে জনাকয়েকের আমরা এখানে নাম করছি–বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গিরীশচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিন চন্দ্ৰ পাল, রামেন্দ্ৰসুন্দর ত্ৰিবেদী, শিশির কুমার ঘোষ, মতিলাল ঘোষ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিনয়কুমার সরকার, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাসবিহারী ঘোষ, তারকচন্দ্র পালিত, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, যোগেশচন্দ্র রায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, যদ্যনাথ সরকার, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার ভাদুড়ি, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, ক্ষুদীরাম বসু, কানাইলাল দত্ত, সূর্য সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, হেমেন্দ্ৰ প্ৰসাদ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সুরেশচন্দ্র মজুমদার, চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, নলিনীরঞ্জন সরকার, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এদের সমতুল্য কোন ব্যক্তিকে আর দেখি না। শতাব্দীর প্রথমার্ধের মানুষেরা ছিলেন চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান। চিন্তাশীলতাই ছিল তাঁদের মূলধন। দ্বিতীয়ার্ধের মানুষদের মূলধন হচ্ছে চালাকি । চালাকির দ্বারাই তাঁরা সবকিছ, সমাধা করতে চান ৷ প্ৰতিভার আজ আর কোন কদর নেই। যারা চালাকিতে ওস্তাদ, পাঁচজনের বই থেকে বিনা স্বীকৃতিতে উপাদান চুরি করে বই ছাপাতে জানে, তারাই আজকের চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান পুরুষ। তারাই আজকের পণ্ডিতপ্রবর ও তারাই পায় সাম্মানিক ডি. লিট। সব দেখে শুনে বলতে ইচ্ছে করে—‘ডক্টরেটস আর অ্যাওয়াডেড বাই দ্য ফুলস ফর দ্য বেনিফিট অফ দ্য ফুলস।’

।। তিন ।।

শতাব্দীর প্রথমার্ধটা ছিল অত্যন্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের যােগ । জিনিসপত্তরের দাম ছিল খুবই সস্তা । শতাব্দীর সূচনায় চালের দাম ছিল এক টাকা মন । তবে বঙ্গাব্দ প্রথম দশকের গোড়ার দিকে বুয়ার যুদ্ধের জন্য দাম বেড়ে দেড় টাকা থেকে দু’টাকা হয়েছিল । চল্লিশের দশকে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে গুণাগুণ অনুযায়ী) চালের দাম ছিল আড়াই টাকা থেকে সাড়ে তিন টাকা মন । অধিকাংশ ডালের দাম ছিল ছ’ পয়সা সের। আটা দু’ পয়সা সের, ময়দা চার পয়সা সের, সর্ষের তেল দশ পয়সা সের, চিনি দু’ আনা সের, আর ভাল ভয়সা ঘি দশ আনা সের । মাখন আট আনা সের, মাংস ছ’ আনা সের । বাগদা, ট্যাংরা, পারসে ইত্যাদি মাছ চার আনা সের। কাটা রুই মাছ ছ’ আনা সের। দশ হাতি লাট্‌টূ মার্কা ভাল বিলিতি কাপড় দেড় টাকা থেকে সাত সিকা জোড়া। এখনকার এক টাকা দামের রসগোল্লার নাম ছিল ‘রসমুণ্ডি’। এক পয়সায় চারটে রসমুণ্ডি পাওয়া যেত। ফাউ চাইলে দোকানদার আরও একটা ফাউ দিত । আর বাকি সব রকম খাবার ছিল ছ’ আনা সের। এসব দাম ১৯৪২ খ্রীস্টােব্দ পর্যন্ত ( বঙ্গাব্দ শতকের প্রথমার্ধ পযন্ত) চাল ছিল । তখনও কলকাতা শহরে ‘পাইস হোটেল’- এর অস্তিত্ব ছিল । এসব হোটেলে এক পয়সার বিনিময়ে ভাত, ডাল, তারকারী, চাটনি পাওয়া যেত। কাপড়চোপড়ও ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আগেকার মতই ছিল । তবে তখন বিলিতি কাপড়ের পরিবর্তে এখানকার মিলের কাপড় পরার রীতি হয়েছিল । ১২০-কাউণ্ট সুতোর মিহি ধুতির দাম ছিল সাত সিকে ও শাড়ীর দাম দু’টাকা চার আনা জোড়া। আর ধনেখালির উৎকৃষ্ট শাড়ী তিন টাকা থেকে সাড়ে তিন টাকায় পাওয়া যেত ।

ছেলেদের লেখাপড়ার খরচও ছিল খুব কম। স্কুলের মাইনে ছিল। মাসিক এক আনা থেকে শুরু করে ম্যাট্রিকুলেশন (সকল ফাইনাল ) ক্লাসে দু’টাকা । কলেজের মাইনে এক টাকা (ক্ষুদিরাম বাবুর সেনট্রাল কলেজে ) থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা ( স্কটিশ চার্চ কলেজে ) । বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ ক্লাসের মাইনে ছিল আট টাকা। পরীক্ষার ফি ছিল পনের থেকে পঁচিশ টাকা । আমার প্রথম বছরে লেখাপড়া করতে মোট খরচ হয়েছিল চোদ্দ আনা পয়সা–মাসিক এক আনা হিসাবে এক বৎসরের মাইনে বারো আনা, একখানা বর্ণপরিচয় দু’পয়সা, একখানা ধারাপাত দু’ পয়সা, একখানা শ্লেট তিন পয়সা ও শ্লেট-পেনসিল এক পয়সা । আজকালকার মত বছরে বছরে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তিত হত না । একবার পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির বই কিনলে দু-চার পুরুষ তা পড়ত।

ডাক মাসুলের খরচও খুব কম ছিল । পোস্টকার্ড এক পয়সা, খাম দ’ পয়সা, রেজিস্ট্রেশন খরচ দু’ আনা ও বিলেতে চিঠি পাঠাতে খরচ হত দশ পয়সা । পোস্ট আপিসের কর্মকুশলতা ছিল অদ্ভূত। আজ সকালে আটটার মধ্যে কলকাতা থেকে ব্যারাকপরের ঠিকানায় চিঠি পোস্ট করলে, তা বেলা তিনটার সময় সেখানে বিলি হত, এবং সেখান থেকে তার জবাব পাঁচটার মধ্যে পোস্ট করলে কাল সকালে আটটার মধ্যে তা কলকাতায় বিলি হত । আর আজকের একটা নমুনা দিচ্ছি। একখানা চিঠি আমার নামে এবছর ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে লেনিন সরণী থেকে পোস্ট করা হয়েছে। ষোল আনা শুদ্ধ ঠিকানা থাকা সত্ত্বেও চিঠিখানা পেলাম ১০ এপ্রিল তারিখে ।

।। চার ।।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আবির্ভূত হল মহামন্বন্তর। যুদ্ধ দেশের দোরগোড়া পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার ফলে, সৈন্যবাহিনীকে খাওয়ানোর জন্য সরকার চাল ‘কর্ণার’ করল । দেশে চাল দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় অন্নাভাবে গ্রাম থেকে ভূমিহীন কৃষকের দল ছুটে এল রাজধানী শহরের দিকে । এখানে অনাহারে কলকাতার রাজপথে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল হাজার হাজার নরনারী ও শিশু। তারই পদাঙ্কে রেশনিং প্রথা চাল করা হল । সঙ্গে সঙ্গে চোরাবাজারীদের আবির্ভাব ঘটল । ফলে জিনিসপত্তরের দামের সামান্য কিছ হেরফের হতে লাগল। পণ্ডিত নেহরু, তখন গদি পাননি। জিনিসপত্তরের মূল্যের উর্দ্ধগতি দেখে তিনি তো চটে লাল। উত্তেজিত হয়ে তিনি বললেন–‘আমি যদি কোনদিন ক্ষমতায় আসি, তাহলে চোরাবাজারীদের ল্যাম্প-পোস্টে ঝুলিয়ে তাদের গলা কেটে দেব ।’ ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের পনের আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেল । পণ্ডিত নেহেরুই প্রধানমন্ত্রী হলেন । পনেরো আগস্টের মধ্যরাত্রে তিনি জাতির প্রতি ভাষণে বললেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের অধীনতা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও তার অনবতী ঘটনাসমূহের ফলে, আমরা জীবনের অনেক পঞ্জীভূত গুরুতর সমস্যার উত্তরাধিকারী হয়েছি । আজ আমাদের দেশের লোকের খাদ্য, বসন, ও নিত্য আবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাব রয়েছে । আমরা মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির নাগপাশে বদ্ধ হয়েছি। আমরা বিচক্ষণতার সঙ্গে এসব সমস্যার সমাধান করতে চাই, যাতে সাধারণ লোকের ক্লেশের বোঝা হ্রাস পায় ও তাদের জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি পায় ।’

নেহরুর এই প্রতিশ্রুতি সাফল্যমণ্ডিত করবার জন্য ১৯৫১ সাল থেকে শুরু করে আমরা সাতটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও তিনটি বার্ষিক যোজনা ইতিমধ্যে রচিত ও রূপায়িত করেছি। বর্তমানে অষ্টম পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে। সপ্তম পরিকল্পনার শেষ পযন্ত আমরা খরচ করেছি ৫৪৪,২৭৬ কোটি টাকা । অষ্টম পরিকল্পনার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৮,৭২,১০০ কোটি টাকা । কিন্তু এই বিপুল অর্থব্যয় করেও আমরা দরিদ্র দেশবাসীর অদৃষ্ট ফেরাতে পারিনি। বরং পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে আমরা আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছি । মূল্যস্ফীতি সাধারণ লোকের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। সরকার অবশ্য বলবেন যে আমরা অনেক বিষয়ে এগিয়ে গেছি। কিন্তু সাধারণ লোকের জীবন যে আগেকার তুলনায় সুখময় হয়নি, সে সম্বন্ধে কোন বিতর্কই নেই। দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একই রব অনুরাণিত হচ্ছে–‘ম্যায়। ভুখা হুঁ।’ ধনী আরও বেশি ধনী হয়েছে, দরিদ্র হয়েছে দরিদ্রতর। মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তি ঘটেছে ।

।। পাঁচ ।।

সবচেয়ে বড় দুর্গতি যা আজ মানুষেকে অভিভূত করেছে তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। যারা মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছে, নেহেরু তাদের ল্যাম্প-পোস্টে ঝলিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসবার পর দেখা গিয়েছিল যে তাদের সঙ্গেই তিনি হাত মিলিয়ে ফেলেছেন । তাঁর উত্তরাধিকারীরা সেই একই নীতি অনসরণ করে এসেছেন, কেননা সেই ব্যবসায়ীদের বদন্যতার ওপরেই দলের পুষ্টি ও নির্বাচনের সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দোষ দিলে হবে না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকার নিজেও মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন। প্রত্যক্ষভাবে সরকার মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন পণ্যদ্রব্যের ওপর কর বসিয়ে, রেলের মাসুল বাড়িয়ে ও পণ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে । আর পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সমূহের রূপায়নের জন্য ঘাটতি ব্যয়নীতি অনসরণ করে। এ সবের ফলে বর্তমানে পণ্যদ্রব্যমূল্য এমন স্তরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে তুলনা করলে শতাব্দীর প্রথমার্ধের পণ্যদ্রব্যের মূল্যসমূহ রূপকথার কাহিনী বলে মনে হবে। নেহেরু পণ্যমূল্যের উর্দ্ধগতি দমন করে সাধারণ লোকের জীবন সুখময় করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পণ্যমূল্য গগনস্পর্শী হয়ে সাধারণ লোকের জীবন কিরকম ক্লেশকর করেছে তা নীচে শতকের দুই অংশের পণ্যমূল্যের তালিকা থেকে প্রতীয়মান হবে ।

 

পণ্যদ্রব্য শতকের প্রথমার্ধের মূল্য শতকের শেষের মূল্য
চাল (প্রতি মন) দু’ টাকা ৫০ পয়সা ৩২০ টাকা
ডাল (প্রতি সের) ছ’ পয়সা ২০ টাকা
সরষের তেল (প্ৰতি সের) দশ পয়সা ৩০ টাকা
চিনি (প্ৰতি সের) আট পয়সা ১৫ টাকা
ঘি (প্ৰতি সের) দশ আনা ২০০ টাকা
মাংস (প্রতি সের) ছ’ অনা ৭২ টাকা
মাছ (কাটা রই প্রতি সের) ছ’ আনা ৭০ টাকা
ধুতি (মিহি কাপড়) দু’ টাকা ৮০ টাকা
ধনেখালির শাড়ি তিন টাকা ২৫০ টাকা

গত দশ বছরেই দ্রব্যমূল্য দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। এটা সরকারী ‘কনস্যুমার প্রাইস ইনডেকস’ থেকে বুঝতে পারা যাবে । ১৯৮২ সালে সূচকসংখ্যা ছিল ১০০, আর ১৯৯২-তে ২১৯ । মূল্যস্ফীতি দেশের মধ্যে ধনবৈষম্য ঘটিয়েছে । ষাটের দশকে মহলানবীশ কমিটি এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছিলেন এবং এ সম্বন্ধে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন । সে সতর্ক বাণীতে আমরা কর্ণপাত করিনি। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে ধনবৈষম্য বিরাট আকারে প্রকট হয়েছে ।

।। ছয় ।।

শতাব্দীর পূর্বার্ধের রাজনৈতিক পরিস্হিতি পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। এবার শতাব্দীর শেষাধের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটার দিকে তােকানো যাক । ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের স্বাধীনতা লাভের শোচনীয় শর্ত হিসাবে বঙ্গদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়–পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বপাকিস্তান। পশ্চিমবঙ্গ জন্মগ্রহণ করেছিল অনেক সমস্যা নিয়ে । যুক্তবাঙলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল একটা ভারসাম্য। পূর্ববাঙলা ছিল কৃষিপ্রধান, সেজন্য পূর্ববাঙলা ছিল খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের আড়ত। আর পশ্চিমবঙ্গ ছিল শিল্প প্রধান । পশ্চিমবঙ্গকে খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের জন্য পূর্ববাঙলার ওপর নির্ভর করতে হত । দ্বিখন্ডিত হবার পর এই আৰ্থিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে । তারপর পশ্চিমবঙ্গ ছিল ঘনবসতিবহুল অংশ । তার মানে, আগে থেকেই এখানে ছিল বাসস্থানের অভাব । সে অভাবকে ক্রমশই তীব্রতর করে তুলেছিল অন্য প্রদেশ থেকে আগত জনসমুদ্র । এই সমস্যাকে আরও উৎকট করে তুলল যখন নিরাপত্তার কারণে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পূর্ববাঙলা থেকে পশ্চিমবাঙলায় এল।

যখন পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হল, তখন প্ৰফুল্ল চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে এক ‘ছায়া মন্ত্রি পরিষদ’ রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করল। কিন্তু চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই সেই মন্ত্রিসভা ভেঙে পড়ল। ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। স্বাভাবিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ যেসব উৎকট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, সেগুলির সমাধান এই নতুন মন্ত্রিসভার ঘাড়ে চেপে বসল। নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত আঠারো বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিধানচন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাগুলি একে একে সমাধান করে ফেললেন।

১৯৬২ খ্রীস্টাব্দের ১ জলাই বিধান রায়ের মাতুত্যুর পর কংগ্রেস নেতা প্রফুল্লচন্দ্র সেন নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু তাঁর অনুসৃত খাদ্যনীতি জনমতের বিরুদ্ধে যাওয়ায়, ১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন ও অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় ড. প্রফাল্ল চন্দ্র ঘোষ এক নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন । তা-ও স্বল্পকালস্থায়ী হওয়ায় ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়। ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে বামফ্ৰণ্ট সরকার গঠিত হয়। মাত্র এক বছরের বেশি এ-সরকার স্থায়ী হয় না । ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের ১৯ মার্চ আবার রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয় । ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক ডেমোক্ৰেটিক কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় । কিন্ত দু’মাস পরে ( জুন ১৯৭১) তা ভেঙে পড়ে। তখন ( ৩০ জুন ১৯৭১) আবার রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয় । ১৯৭২-এর মার্চ মাসে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ে্র নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দের নিবাচনে ‘বামফ্রন্ট’ দল সাফল্য অর্জন করাতে জ্যোতি বসু, ‘বামফ্রন্ট সরকার’ গঠন করেন । এই বামফ্রন্ট সরকারই এখনও পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আছে ।

বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির অন্তরালে বামফ্ৰণ্ট সরকারের আমলে ঘটেছে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক দলাদলি, দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও নির্যাতন, মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তি, শিক্ষার সংকট, বাঙলায় অবাঙালীর অবারিত আগমন ও কর্রসংস্থানের ওপর তার প্রতিঘাত, বেকারের সংখ্যাবৃদ্ধি ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশঙ্খলতা ও নৈতিক শৈথিল্যে । তাছাড়া বাঙালীর মানবিক সত্তা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। নারীনিগ্রহ ও বাধা-নির্যাতনের ক্রমবৃদ্ধিতার দৃষ্টান্ত ।

বস্তুত, সমকালীন সামাজিক বিশৃঙ্খলতা, মানবিক সত্তার হ্রাস ও নৈতিক শৈথিল্যের প্রতি দুটি রেখে মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে বাঙালীর জীবনচর্যা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা অবক্ষয়ের পথে চলেছে কিনা ? অশন-বসনে, আচার-ব্যবহারে বাঙালী আজ যেমন নিজেকে বহুরূপী করে তুলেছে, তেমনই বর্ণচোরা করেছে তার সংস্কৃতিকে । অতীতের গৌরবময় সংস্কৃতির পরিবর্তে এক জারজ সংস্কৃতির প্রাবল্যই লক্ষিত হচ্ছে ।

।। সাত ।।

এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য অগ্রগতি । আগের শতকে আমরা পেয়েছিলাম টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বৈদ্যুতিক আলো, পাখা ইত্যাদি । বিংশ শতাব্দীতে আমরা পেয়েছি বেতার, বিমান, খনিজতৈল, মোটরগাড়ি, পরমাণুর ব্যবহার, ইলেকট্রনিকস্‌, টেলিভিসন, প্লাস্টিকস্‌ ইত্যাদি। বস্তুত বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিদ্যার সাহায্যে আমরা এমনভাবে এগিয়ে গেছি যে মনে হবে বিজ্ঞানই বঝি বা স্বয়ং ভগবান। ভগবানের দুই সত্ত্বা আছে–তিনি যােগপৎ স্রষ্টা ও সংহারকর্তা। বিজ্ঞােনও তাই। বিজ্ঞান যেমন একদিকে মানুষের কল্যাণ সাধন করছে, অপরদিকে মানুষেকে ধবংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। জানিনা আগামীকালে মানুষের কপালে কি আছে। কেননা এখন চলেছে প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের জন্য বিজ্ঞানের লড়াই। এই বিজ্ঞান বনাম প্রকৃতির লড়াইয়ের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে, হয় মানবসভ্যতার আরও অগ্রগতি, আর তা নয়তো মানুষের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। ( অতুল সুর, ‘মানব সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রঃ)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *