০১. ঋগ্বেদ

ঋগ্বেদ

ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ—এই চার বেদের প্রত্যেকটিই চারটি অংশে বিন্যস্ত : সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতার আক্ষরিক অর্থ হল আবৃত্তিযোগ্য (ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদের ক্ষেত্রে), গেয় (সামবেদ) ও জপনীয় (যজুর্বেদ) মন্ত্রসমূহের সংকলন। ঋগ্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদের একটি করে সংহিতা রয়েছে—এদের প্রত্যেকটির এক বা একাধিক পাঠভেদ আছে; অন্যদিকে যজুর্বেদের দুটি সংহিতা—শুক্ল ও কৃষ্ণরূপে পরিচিত। প্রত্যেক সংহিতার সঙ্গে একাধিক ব্রাহ্মণ যুক্ত রয়েছেম শুধু অথর্ববেদের একটি মাত্র ব্রাহ্মণ। আবার চারটি সংহিতার প্রত্যেকটির একাধিক আরণ্যক ও উপনিষদ আছে; তবে, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদের মধ্যেবর্তী ভেদরেখা খুব স্পষ্ট নয়। সংহিতাগুলির রচনাশৈলী ও রচনাকাল স্পষ্ট হলেও ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদগুলি প্রায়শই পারস্পরিক সীমা লঙ্ঘন করেছে; তাই একটি ধরনের রচনা কোনো শাখার কাছে ব্রাহ্মণ, আবার অন্য শাখার কাছে আরণ্যক বা উপনিষদ রূপে পরিচিত। কিংবা কোনো ব্রাহ্মণের হয়ত এমন উপসংহার অংশ রয়েছে, যাকে ঐ ব্রাহ্মণটি কখনো আরণ্যক কখনো বা উপনিষদ বলে উল্লেখ করছে অথবা একই সঙ্গে দুটোই।

 

বেদের সংহিতা পাঠ প্রচলিত ধরনে আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বিন্যস্ত হয়েছিল; এই পাঠ আবার শাখা বা চরণ বলে পরিচিত বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত। প্রতিটি শাখায় একটি একটি সংহিতা রয়েছে; অন্যদিক চরণগুলির সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত আছে বিভিন্ন ব্রাহ্মণ ও সূত্র—এই পার্থক্য সাধারণভাবে আঞ্চলিক ভেদজনিত বলেই গণ্য করা যায়। ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে এক যুগ থেকে অন্যযুগে আনুক্রমিক সঞ্চরণ এবং এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশের সঞ্চরণের ফলে মৌখিক সাহিত্যের বিশুচ্ছ পরস্পর কিছু না কিছু পরিবর্তিত হতে বাধ্য। এটাও সম্ভব যে, কিছু কিছু বিকল্প পাঠের প্রতি আঞ্চলিক পক্ষপাতের ফলেই রচনার স্থান-স্থানে পাঠভেদ তৈরি হয়েছে, যদিও সমগ্র সাহিত্যকে ঐশী প্রেরণালব্ধ ও অপৌরুষেয় (আর সেই জন্য আবহমান কাল ধরে সমরূপ ও অপরিবর্তনীয়) বলে দাবি করা হয়ে থাকে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, বেদের এই পাঠভেদগুলি যে এত বিরল ও তাৎপর্যহীন—সেটাই বরং বিস্ময়ের। এতে আমরা যেমন চিরাগত ভারতীয় রক্ষণশীলতার পরিচয় পাই, তেমনি উচ্চারিত শব্দকে অপরিমেয় তাৎপর্যপূর্ণরূপে গ্রহণ করার মৌলিক প্রবণতা সম্পর্কেও অবহিত হই।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বেদের বহু প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায়—শ্রুতি, অনুশ্রব, আম্নায়, ত্রয়ী, ছন্দঃ, স্বাধ্যায়, আগম এবং নিগম। সংহিতা শব্দের তাৎপর্য এই যে, তা অনেক শিথিল, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্ত্রের সঙ্কলন। ঐতিহ্য অনুযায়ী এই সব মন্ত্রের আক্ষরিক অর্থা ‘বিভাজন’। অঞ্চলভেদে সংহিতার বিভিন্ন বিভাগের নিম্নোক্ত ছক তৈরি করা যায় :-

  • বেদ
    • ঋক্‌
      • শাকল
      • বাষ্কল
    • সাম
      • কৌথুম (গুজরাট), রাণায়ণীয় (মহারাষ্ট্র)
      • জৈমিনীয় বা অবলকার (কর্ণাটক)
    • যযুঃ
      • কৃষ্ণ
        • কাঠক (কাশ্মীর)
        • কপিষ্ঠল (পাঞ্জাব)
        • মৈত্রায়ণী বা শাঙ্খায়ণ (গুজরাট)
        • তৈত্তিরীয় (দক্ষিণ ভারত)
      • শুক্ল
        • কাণ্ব
        • মাধ্যন্দিন
        • বাজসনেয়ী (বিদেহের উত্তর-পূর্ব)
    • অথর্ব
      • শৌনক
      • পৈপ্পলাদ

 

ঋগ্বেদ

আনুমানিক ৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে বা তার এক শতাব্দী পরে মহাভারতের মহাযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময় (যদি তা সত্যিই ঘটে থাকে) ঋগ্বেদ সম্ভবত তার বর্তমান আকৃতি ধারণ করেছিল। মহাভারতের রচয়িতা ব্যাস সম্ভবত ঋগ্বেদের নবম খণ্ড অর্থাৎ সোম মণ্ডলের প্রণেতা ছিলেন কেননা এই মণ্ডলের মধ্যে সম্পাদকীয় প্রয়াস খুব স্পষ্ট। পূর্বতন নয়টি মণ্ডলের তুলনায় দশম মণ্ডল অনেক পরবর্তীকালের রচনা। বৈদিক সাহিত্যের প্রথম সৃষ্টিধর্মী পর্যায়ের মধ্যে রয়েছে চারটি সংহিতা। ঐতিহ্যগতভাবে ঋগ্বেদ দশটি খণ্ড বা মণ্ডলে বিভক্ত; এই মণ্ডলগুলি আবার বিভিন্ন ‘অনুবাকে’ বিভক্ত; প্রতি অনুবাকে অনেক সূক্ত এবং প্রতি সূক্ত কিছু মন্ত্র বা শ্লোকের সমষ্টি। শাকল শাখা মণ্ডলক্রমে বিভাগকেই অনুসরণ করেছে ও বালখিল্য সূক্তগুলি সংকলন করেছে। প্রখ্যাত টীকাকার সায়ণ খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতকে এই শাখাকেই অনুসরণ করেছিলেন। মণ্ডল বিভাগের প্রাচীনতম উল্লেখ রয়েছে ঐতরেয় আরণ্যকে। মণ্ডল বিভাগের তুলনায় যান্ত্রিকতর বিভাজন রয়েছে বাষ্কল শাখায়; সেখানে সমগ্র ঋগ্বেদ সংহিতাকে পরিমাণগতভাবে সমান আটটি খণ্ড বা অষ্টকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রতি অষ্টকের আটটি করে অধ্যায় এবং প্রতি অধ্যায়ের মোটামুটিভাবে তেত্রিশটি করে বর্গ রয়েছে—আবার প্রতি বর্গই কিছু শ্লোকের সমষ্টি।

বাষ্কল—৮ অষ্টক, ৬৪ অধ্যায়, ২০০৬ বর্গ
১০৮১৭ / ১০৬১৬ / ১০৬২২ সূক্ত

ঋগ্বেগ—শাকল ১০ মণ্ডল, ৮৫ অনুবাদ, ১০১৭ (৭১১ বালখিল্য) সূক্ত, ১০৮৫০ ঋক্‌, ১৫৩৮২৬ পদ

বৈদিক শাখা সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন গ্রন্থ চরণব্যূহ অনুযায়ী ঋগ্বেদ সংহিতার পাঁচটি বিভিন্ন পাঠভেদ ও সমপরিমাণ শাখা ছিল। বৃহ*বতা (?) গ্রন্থের অধিকতর সমীমবর্তী বাষ্কল শাখা বর্তমানে অপ্রচলিত। পরবর্তী ঋগ্বেদ-সাহিত্যের দুটি প্রধান শাখা : ঐতরেয় এবং কৌষীতকি।

 

ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডলের মধ্যে প্রত্যেকটির রচনাকাল ভিন্ন; এর মধ্যে অন্তত তিনটি প্রধান পর্যায় সহজেই আবিষ্কার করা যায়। প্রাচীনতম বা মূল পর্যায়ে রচিত হয় ‘পারিবারিক মণ্ডল’ রূপে পরিচিত দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল। গৃৎসমদ, বিশ্বামিত্র, বামদেব, অত্রি, ভরদ্বাজ ও বশিষ্ট—এই কটি ঋষি-পরিবারের অন্তর্ভূক্ত কবিরাই মণ্ডলগুলির রচয়িতা। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে মূলত কাণ্ব পরিবারভুক্ত কবিরাই মণ্ডলগুলির রচয়িতা। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে মূলত কাণ্ব পরিবারভুক্ত কবিদের রচনা : অষ্ট মণ্ডল, এবং এই মণ্ডল বিন্যাসের পরিকল্পনা অনুযায়ী সঙ্কলিত প্রথম মণ্ডলের দ্বিতীয় অংশ (৫১ তম সূক্ত থেকে ১৯১তম সূক্ত)। তৃতীয় পর্যায়ে, সম্ভবত সমযাগের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের জন্য, আটটি মণ্ডল থেকে সোমদেবতার উদ্দেশে রচিত সমস্ত সূক্ত একটি পৃথক মণ্ডলে সঙ্কলিত হয়। এটিই হল নবম বা সোমমণ্ডল। আরো অন্তত দুই শতাব্দী পরে চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ে রচিত হয় দশম মণ্ডল এবং প্রথম মণ্ডলের প্রথম অংশ (১-৫০ সূক্ত)।

শেষ দুটি পর্যায়ের সূক্তসমূহ বিষয়বস্তু অনুযায়ী সংহিতায় সঙ্কলিত; প্রথম দুটি পর্যায়ের মতো কবি-পরিবারের পরিচয় অনুযায়ী নয়।

সুতরাং আমরা ঋগ্বেদের চারটি ভিন্ন রচনাস্তরের রৈখিখ বর্ণনা নিন্মোক্ত রূপে করতে পারি :

পর্যায় ক : পারিবারিক মণ্ডল (নিম্নলিখিত পরিবারসমূহ)

  • ২য় গৃৎসমদ
  • ৩য় বিশ্বামিত্র
  • ৪র্থ বামদেব
  • ৫ম অত্রি
  • ৬ষ্ঠ ভরদ্বাজ
  • ৭ম বশিষ্ট

পর্যায় খ

  • ১ম (সূক্ত ৫১-১৯১), অনেক কবি; পরবর্তীকালের
  • ৮ম মূলত কাণ্ব পরিবারের কবিগণ

পর্যায় গ

  • ৯ম (সোমমণ্ডল), (১ম মণ্ডল ২য় অংশ ও ৮ম মণ্ডলের সমকালীন; বিবিধ কবি)

পর্যায় ঘ

  • ১ম মণ্ডল (১-৫০ সূক্ত) (কাণ্ব পরিবারের কবি; ৮ম মণ্ডলের রচনা-পরিকল্পনা অনুযায়ী বিন্যস্ত)
  • ১০ মণ্ডল (পরবর্তী; বিবিধ কবি)

ডাঃ রাহুড়কর মনে করেন, দশম মণ্ডলের ১৫১টি কবি-নামের মধ্যে মাত্র ৭৮টি নাম নির্ভরযোগ্য; কিন্তু অন্য ৭৩টি কাল্পনিক।

মন্ত্র বিন্যাসের পদ্ধতিতে কিছুটা অস্পষ্ট ও অসংলগ্ন পরিকল্পনার ছাপ দেখা যায়; পারিবারিক মণ্ডলগুলির প্রত্যেকটির প্রথম সূক্ত অগ্নির প্রতি নিবেদিত—আবার নবম মণ্ডলে একমাত্র সোমদেবতাই স্তুত হয়েছেন; সম্পূর্ণত ছন্দঃক্রম অনুযায়ী মন্ত্রগুলি বিন্যস্ত। বাইবেল বা কোরাণের মতো ঐতিহ্য অনুসারী বেদ ঐশীপ্রেরণাজাত, বোধিলব্ধ ও অপৌরুষেয়। নিশ্চিতভাবেই প্রত্যাদেশ রূপে বর্ণিত হওয়ায় বৈদিক সাহিত্য বিশুদ্ধ ও অখণ্ডনীয় অর্থাৎ যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে উন্নীত হয়েছে। তবে এবং অন্যবিধ তাৎপর্যও রয়েছে, যে দৈব প্রেরণা মন্ত্রপ্রণেতাকে এতটা আলোড়িত করত যে তিনি শিহরিত হতেন (তুলনীয় ‘বিপ্র’, বিপ্‌ ধাতু, শিহরণ অর্থে) সেই প্রেরণার ফলেই দৈনন্দিন সাধারণ ভাষা থেকে মন্ত্রগুলির ভাষা খানিকটা পৃথক হয়ে পড়ত। এই পার্থক্যের মূলে আছে কাব্যিক ভাষায় উপলব্ধিগত তুরীয়ভাবে প্রতিফলন। তাই ঋষিগণ ‘মন্ত্র রচিয়তা’ নয়, এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে তাই তাদের বলা হয় ‘মন্ত্রদ্রষ্টা’, তা না হলে প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, সাধারণ মানুষই এই সর্বজনস্বীকৃত অতিমানবিক সাহিত্যের প্রণেতা। তাই মন্ত্র হয়ে উঠল প্রত্যাদেশ আর ঋষি-কবি হলেন দ্রষ্টা। খুবই যথার্থ অর্থে সমস্ত মহৎ কবিতাই প্রত্যাদেশ, কেননা মুষ্টিমেয় মহৎ কবিই তা রচনা করতে পারেন; আর, এই অনন্য অন্তর্দৃষ্টি ও যথাযোগ্য ভাষায় তাকে প্রকাশ করার ক্ষমতাই তাঁদের সাধারণ জনপ্রবাহ থেকে পৃথক করে রাখে। সাধারণ মানুষও এই অসামান্য সৃষ্টিপুঞ্জকে পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়রূপে গ্রহণ করে বিশেষ মর্যাদা দিতে চাইল। প্রকৃতপক্ষে এ সমস্ত মন্ত্রের আবৃত্তিকালীন স্বরভঙ্গী ও আনুষ্ঠানিক প্রয়োগরীতি সংযোজক উপাদানরূপে সমাজসত্ত্বাকে অখণ্ড সামগ্রিকতায় গ্রথিত রেখেছিল।

বহুপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত পরিবারসমূহের কবি ছাড়াও আমরা কয়েকজন মহিলাকবি বা ঋষিকারের সন্ধান পাই; যেমন লোপামুদ্রা (১.১৭৯), অপালা মৈত্রেয়ী (৮.৯১), ষমী (১০.১০), বসুক্রের পত্নী (১০.২৮), কাক্ষীবতী ঘোষা (১০.৩৯-৪০), সূর্যা (১০.৮৫), ঊর্বশী (১০.৯৫), অম্ভৃণ-কন্যা বাক্‌ (১০.১২৫), ব্রহ্মজায়া (১০.১৩৯)। বিবস্বৎ-কন্যা ষমী (১০.১৪৫)। ইন্দ্রানী (১০.১৪৫), শ্রদ্ধা কামায়নী (১০.১৫১), পৌলোমী শচী (১০.১৫৯)। এই সমস্ত সূক্তের নাম ও বিষয়সূচী অর্থাৎ প্রার্থনার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আমরা রচিয়তাদের সামায়িক পশ্চাৎপট সম্পর্কে অবহিত হই; অর্থাৎ এইসব কবিদের তৎকালীন সমাজের নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধিরূপে গণ্য করা চলে। কোন মহিলাকবিই অন্য কারো সঙ্গে সর্বাংশে তুলনীয় নন, তবুও সামগ্রিকভাবে বৈদিক সমাজের নারীজগৎ সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য পরিচয় তাঁদের রচনার মধ্যে দিয়েই আমরা পাই। যেসব কবি অনেক শ্লোক জানতেন কিংবা রচনা করেছিলেন, তাঁদের ‘বহৃবচ’ (বহু+ঋচ্‌) বলে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন কবির মধ্যে চারণকবিসুলভ প্রতিযোগিতার লক্ষণও আমরা দেখতে পাই। বিশেষত বশিষ্ট ও বিশ্বামিত্রের মধ্যে প্রায় সমতুল্য মর্যাদাদানের মধ্যে এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। পরবর্তী জনশ্রুতি অনুযায়ী এই দুই ঋষির প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরম বিদ্বেষের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল। কিছু কিছু সূক্তে কবি পরিচয় অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে নির্ধারিত হয়েছে; দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনারত ঋষির নাম অনুসারে সংবাদ সূক্তগুলির প্রতি শ্লোকে সেই পরিচয় অর্থাৎ যাঁর উদ্দেশ্যে কিছু বলা হয়েছে তিনি তখন দেবতা এবং যিনি তা বলছেন তিনি ঋষি। তাছাড়া এমন কিছু সূক্তও রয়েছে যেখানে কবির পরিচয়ে কোন দেহধারী মানুষের ইঙ্গিত নেই; যেমন মন্যু বা ক্রোধ (১০.৮৩) এবং অর্বুদ নামে সর্প (১০.৯৪)।

পুরোহিত-পরিবারগুলি বিশেষভাবে কৌতুহলজনক। যখন কোন অনুপ্রাণিত কবি কাব্যিক বা অনুষ্ঠানগতভাবে তাৎপর্যময় গীতিরচনায় সফলকাম হতেন, সম্ভবত তখনই তিনি তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘায়ু কামনা করে স্বাভাবিকভাবে সন্তান বা শিষ্যদের তা কণ্ঠস্থ করতে শিক্ষা দিতেন। নিরক্ষর সমাজও স্মরণীয় শ্লোক রচনায় সমর্থ ছিল, কিন্তু সংরক্ষণই ছিল তার সমস্যা; অতএব স্বাভাবিকভাবেই সংরক্ষণ-বিষয়ে কবির নিকট-আত্মীয় বা শিষ্যগণ সর্বাধিক আগ্রহী এবং এঁরাই ছিলেন নির্ভরযোগ্য আধার। সম্ভবত তাঁরা মৌখিক সাহিত্য রচনার প্রক্রিয়াকে খুবই নিবিষ্টভাবে লক্ষ্য করে থাকবেন এবং ক্রমশ আবেগের সংবেদনশীল মুহূর্তগুলিকে বাচনিক অভিব্যক্তিদানের রহস্যেও তাঁরা দীক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। এভাবেই কিছু কিছু পরিবারের সদস্যরা অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ-ক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে এক একটি কবি-পরিবাররূপে সম্মানিত হয়েছিলেন; কখনও কখনও পাঁচ প্রজন্ম এই মর্যাদা অক্ষুণ্ন থেকেছে। আধুনিক গবেষণায় প্রতিপন্ন হয়েছে যে চৌষট্টি প্রজন্ম ধরে ঋগ্বেদের প্রকৃত রচনা অব্যাহত ছিল।

পুরোহিত, চারণ-কবি এবং ঋষি-কবিদের গুণগ্রাহী পৃষ্ঠপোষকরা শিল্প-চাতুর্য্যের জন্য কবিদের রচনার পুরস্কার দিতেন। কেউ কেউ মনে করছেন যে নববর্ষ উৎসবে চারণকবিরা পুরস্কারের আশায় রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন; তা হয়ে থাকলে খুব সম্ভবত এটি ইন্দো-ইয়োরোপীয় ঐতিহ্য (যেমন গ্রীসের ট্রাগোইডিয়াতে) যজ্ঞানুষ্ঠান যখন পরবর্তীকেল বহুমাত্রিক ও জটিল হয়ে উঠেছিল তখন ক্রমেই কবিপরিবারগুলি বিশেষ মর্যাদার আসনের অধিকারী হয়ে উঠছিলেন। তাই ঋগ্বেদের প্রতি সূক্তেই ছন্দ, দেবতা ও যজ্ঞবিষয়ক বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ঋষিকবির নামও উল্লেখ থাকে। এ নামের উল্লেখে রচনাটির ওপরে স্বত্বাধিকারে স্বাক্ষর রয়ে গেছে। দেবতা ও বিনিয়োগ অবশ্য কবিতা ও যজ্ঞানুষ্ঠান বিষয়ক রচনা থেকেও কিছু কিছু পাওয়া যায় কিংবা অনুমান করা যায়, কিন্তু পরবর্তীকালের কিছু রচনায় স্পষ্টত কাল্পনিক নামগুলি ছাড়া সর্বত্রই ঋষিকবির নাম সচেতন ও অবধারিতভাবে স্তোত্রের সঙ্গে স্মরন করা হয়েছে। এমন কি, তিন হাজার বছরের আগেও রচিত এই স্তোত্রগুলি যে কবিনামবিহীন নয়, তাতেই বৈদিক জনসাধারণের কবিতা ও স্ত্রোত্রবিষয়ক মনোভাবটি চমৎকারভাবে পরিষ্ফুট হয়েছে।