ফাতেমা আক্তার ও আলী আহম্মদদের কথা একটু ভাবুন

এসএসসির রেজাল্টের পর খবরের কাগজগুলোতে শহরের বিখ্যাত স্কুলগুলোর আর তাদের ছাত্রছাত্রীদের কৃতিত্বের কথা যেমন বিস্তারিত লেখা হয় তেমন করেই লেখা হয় দেশের গ্রামগঞ্জে অতিকষ্টে পড়াশুনা করে ভালো রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েদের কথা। তেমন দুজন ছেলেমেয়ের কথা পড়লাম ‘ভোরের কাগজ’ এর ১ জুন ২০০৯ সংখ্যায়। মফস্বল পাতায় ছাপা হয়েছে রংপুরের ফাতেমা আক্তারের কথা আর মাদারীপুরের আলী আহম্মদের কথা। আসুন, আগে তাদের দুজন সম্পর্কে জানি।
‘মাহফুজার রহমান, বদরগঞ্জ (রংপুর) থেকে : এবারের এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলার মোমিনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ফাতেমা আক্তার। শখ ভালো কলেজে পড়ার, কিন্তু বিধবা মায়ের সামর্থ্য না থাকায় হয়তো অঙ্কুরেই ঝরে যাবে এই অদম্য মেধীবী ফাতেমা আক্তার।
অজ পাড়াগাঁ দক্ষিণ মোমিনপুর স্কুলপাড়া। সে গ্রামেই বাস করেন পিতৃহীনা হতভাগ্য ফাতেমা আক্তার। আড়াই বছর আগে ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় মারা গেছেন তার বাবা আয়নাল হক। আবাদি জমি মাত্র দেড় বিঘা। এ জমির ফসল দিয়েই চলে ফাতেমাদের সংসার। স্বামী মারা যাওয়ার পর খেয়ে না খেয়ে ৫ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বহন করছেন ফাতেমার মা তরিফোন নেছা। বড়মেয়ে ডিগ্রিতে, ছোটমেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী, একছেলে ৭ম শ্রেণীতে লেখাপড়া করে। এসএসসির ফলাফল বের হওয়ার পর মানুষের মুখে মেয়ের ভালো ফলাফলের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা তরিফোন নেছা।
কথা হচ্ছিল ফাতেমাদের উঠোনে বসে। ছবি তুলবো বলে জামা পরে আসতে বলায় ঘরে ঢুকে মা-মেয়ে যে জামা ও শাড়ি পরে এলেন তা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা বাড়িতেও পরে না। ভবিষ্যতে কী হতে চাও, প্রশ্ন করতেই কান্না ছলছল চোখে ফাতেমা জবাব দেয়, কলেজে পড়ার সামর্থ্যই যেখানে নেই, সেখানে বড় কিছু হতে চাওয়ার আশা করি কী করে?।
ফাতেমার মা তরিফোন নেছা মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহনের জন্য সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চাইলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বদিউজ্জামান, শিক্ষক নাজমা খাতুন ও সভাপতি ডা. মানিক ফাতেমার ফলাফলে খুবই খুশি এবং তার সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করলেন।’
প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, শিবচর (মাদারীপুর) থেকে : প্রায় ১০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবার পঙ্গুত্বের পর বড়ভাই সংসারের হাল ধরেন। ৪ বছর আগে সেই ভ্যানচালক বড়ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েন। সেই থেকে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকেই পঙ্গু বাবা ইউনুছ মিয়া, মা ও দুই বোনসহ পরিবারের সব দায়িত্ব বহন করে অনাহারে-অর্ধাহারে জিপিএ ৫ পেয়েছে উপজেলার উমেদপুর অফিজা রবিউল্লাহ লাইসিয়াম উ”চ বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র আলী আহম্মদ। এই সাফল্যগাথা ও গৌরবের ফলাফলের কথা শুনতে গিয়ে আলী আহম্মদ ও তার মায়ের অশ্রুসিক্ত বর্ণনা উপস্থিত সকলের চোখে পানি আনে।
আলী আহম্মদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মাটির মেঝে, পাটকাঠির ভাঙাচোরা একটি মাত্র ঘরে বসত হতদরিদ্র পরিবারটির। বাঁশের মাচায় তৈরি বিছানায় নেই কোনো চাদর। ছেঁড়াফোঁড়া কাপড়ের তৈরি চাদরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ঘরটিতে। বোনরা বড় হয়ে যা”েছ।
তাই মাটির মেঝেতে বা অন্যের ঘরের বারান্দায় ঘুমিয়েই কেটেছে আলীর ১৬টি বছর। মায়ের সঙ্গে ভাইবোনরা বাঁশের সামগ্রী য়োড়া তৈরি করেই চালিয়েছেন সংসার জীবন। জুটেছে মরিচ পান্তা কিংবা কখনো গরম ভাতের সঙ্গে শাক। মাছ কোনো মাসে জুটেছে কিন্তু মাংস কখনোই জোটেনি।
অভাবের তাড়নায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ বার লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছিল আলীর। কিন্তু প্রতিবারই মায়ের ইচ্ছা, নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও একাগ্রতায় লেখাপড়া চালিয়ে গেছে সে। মায়াবী ও সুশ্রী মুখমণ্ডল দেখে বোঝারই উপায় নেই, দারিদ্র্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত আলীর সংগ্রামী জীবন। আলী জানায়, অল্প বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব নেয়ায় সপ্তাহে সর্বাধিক ২ দিন ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে সে।
খাতা কেনার ভয়ে মুখস্ত পড়ে ও ধার করা বই দিয়েই চলেছে শিক্ষাজীবন। হাটের দিনে বাঁশের তৈরি য়োড়ার কদর থাকায় শুক্রবার, সোমবার ও মঙ্গলবার রাতদিন কাজ করতে হয়েছে। ফলে এই তিনদিন কখনোই পড়ার সুযোগ এমনকি বই ধরারও সুযোগ পায়নি আলী। শিক্ষকদের সহযোগিতায় স্কুলে টাকা দিতে হয়নি। পরিধানের জন্য সর্বসাকল্যে শার্ট একটি। প্যান্টও একটি তাও ছেঁড়া।
অদম্য মেধাবী আলীকে নিয়ে এখন বিস্ময় এলাকাজুড়ে। স্কুলের শিক্ষার্থীসহ পরিচিত অপরিচিতরা দেখতে আসছেন আলীকে। তাকে নিয়ে এলাকায় উচ্ছাস বয়ে গেলেও কোনো অনুভূতি বা উচ্ছাসই ছুঁতে পারেনি আলীকে। মন দিয়ে মাকে নিয়ে বাঁশের য়োড়া বানিয়ে যাচ্ছে এই অদম্য মেধাবী।
বন্ধুর ফলাফলের মিষ্টি খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে আলীকে। পাড়া প্রতিবেশী বা পরিবারের কাউকেই এখনো মিষ্টি খাওয়াতে পারেনি ঋণে জর্জরিত পরিবারটি। ফলাফলের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে ক্ষুধার কাছে। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন জিজ্ঞাসা করলে আলী বলেছে, ‘কোনো স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাই না। প্রথমে মা বাবা ও বোনদের শাক পাতা খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এরপর লেখাপড়া। জানি না কী করবো? প্রতি সপ্তাহে পুরোনো ঋণের বড় অংকের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। না হলে ঘরটিও যাবে।’ এলাকাবাসী জানান, আলীকে পরীক্ষার মধ্যেও কাজ করতে হয়েছে। না হলে ওর মা বাবা ও বোনদের না খেয়ে থাকতে হতো। ওর জিপিএ ৫ পাওয়াটাই তাই একটা আশ্চর্যের ব্যাপার।
মা শিমুলা বেগম বলেন, ‘আলীর বাবা দুর্ঘটনার পর থেকে কাজ করতে পারেন না। তাকে বাঁচাতেই প্রায় দেড় দুলাখ টাকা ঋণ হয়েছে। আলীই সংসার চালায়। বই খাতাতো দূরে থাক, কোনো দিন ওরে পেট ভইরা খাওয়াইতেও পারি নাই। এরপর কলেজের এতো খরচ দিয়া আলীর লেখাপড়া কেমনে করামু জানি না।’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এতো কঠোর পরিশ্রমের পর আলীর জিপিএ ৫ প্রাপ্তি একটা বিস্ময়। সুযোগ পেলে ও প্রমাণ করতে পারবে নিজেকে। ওর মতো মেধাবীদের সুযোগ পাওয়া উচিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ওকে এতো বড় সংসার চালাতে হয়। সবাই এগিয়ে না এলে বড়ভাইয়ের মতো আলীকেও ভ্যান অথবা কামলা দিতে হবে। তাই আলীর উচ্চ শিক্ষায় সহায়তার হাত বাড়াতে নিজের মোবাইল ০১৭১২৪৩১৫৬৬ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য সকলকে অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।’
মাত্র দুজনের কথা আমি লিখলাম। এরকম কতো মেধাবী ছেলেমেয়ে অবহেলায় পড়ে আছে আমাদের গ্রামগঞ্জে। তাদের খবরও আমরা রাখি না। তাদের কথা কেউ ভাবি না। রেজাল্টের পর পর খবরের কাগজে এই অসহায় মেধাবীদের কথা লেখা হয়। তারপর তাদের আর কোনো খবর আমরা রাখি না বা পাই না।
কী হয় এইসব ছাত্রছাত্রীর? তারা কি চালিয়ে যেতে পারে পড়াশুনা? তারা কি পৌঁছাতে পারে তাদের স্বপ্নের কাছাকাছি? সমাজের মানুষ কি সাহায্য সহযোগিতা করেন তাদেরকে?
এইসব দরিদ্র, অসহায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকার কি বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না? কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় কি এইসব ছাত্রছাত্রী আর তাদের পরিবারকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে না? আমাদের এইসব লেখালেখি কতোটা মনোযোগ আকর্ষণ করে সরকারের কিংবা কতোটা গুরুত্ব দেয়া হয়, কিংবা আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় কিনা আমি জানি না। তবু লেখালেখি ছাড়া আমাদের উপায় কী? সরকারকে আমাদের কথা জানাবার আর কোনো মাধ্যম তো নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *