প্রজাপতি – ০৯

প্রজাপতি – ০৯

যখন চোখ মেলে চাইলাম, তখন একেবারে অন্ধকার। প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারলাম না, উঠে বস্‌লাম, আর তখনই বুঝতে পারলাম শিবেটার শ্মশান চাটাইয়ে শুয়ে আছি। এখান থেকে অন্ধকারে, আর একটা দালান পার হতে হয়, তবে উঠোন, অন্ধকারে যেতে পারব তো! মঞ্জরীর নাম ধরে ডাকলাম, কেউ জবাব দিল না, তারপরে শিবের। তাও না। তখন শুনতে পেলাম, কে যেন শিবের নাম ধরে ডাকছে। গলা শুনেই চিনতে পারলাম শুটকা ডাকছে—আর ডাকতে ডাকতে ও একেবারে ঘরের কাছে এসে পড়লো, আর বলতে লাগলো, ‘ধূ-র, ভূতের বাড়ি মাইরি, কেউ নেই!’

‘আমি আছি।‘

‘কে, গুরু?’

‘হ্যাঁ।‘

‘আরে, আমি তো তাই দেখলাম, তোমার মোটরবাইকটা রয়েছে দরজার কাছে, অথচ কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।‘

তখন শুটকার কথা আমার মনে পড়লো, ওকে আমি খুঁজেছিলাম, কেশবের লুকনো মালের কথা বলে দেবার জন্যে কিন্তু এখন ওর ওপরে আমার রাগ হচ্ছে না, কেন তা জানি না। মিথ্যা কথা তো বলেনি। শুটকা আবার বললো, সারাদিন কি এখানেই ছিলি?’

‘না, দুপুর থেকে।‘

শুটকা ফস করে একটা দেশলাইয়ের কাটি জ্বালালো, আর এগিয়ে গিয়ে, একটা কুলুঙ্গিতে মোমবাতি ধরালো। ও সব জানে এ ঘরের। বললো, একটা দিশি রেখে গেছলাম, দেখি আছে না সেঁটে দিয়েছে!’

মধ্যেই কোথা থেকে একটা বোতল টেনে বের করলো। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘খাবি?’

বোতলটা নিয়ে খানিকটা খেলাম। পেটটা কীরকম জ্বালা জ্বালা করে উঠলো, কিছু তো নেই পেটে। আরো খানিকটা খেয়ে, বোতলটা ওকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় ছিলি রে সারাদিন, দেখতে পেলাম না।‘

যেন খেতেই ব্যস্ত, এইভাবে খানিকক্ষণ কাটিয়ে বললো, ‘বাড়িতেই।‘ মনে হল মিথ্যা কথা বলছে। কিন্তু আমার রাগ হল না। উঠে পড়ে বললাম, ‘চলি। এদের বাড়িতে কেউ নেই নাকি? বোনেরা, ওদের মা?’

‘কাউকে তো দেখতে পেলাম না। তুই এখন কোথায় যাবি গুরু?’

‘বাড়ি।‘

‘চ’, তোর সঙ্গে চলে যাই।‘

শুটকার সঙ্গে বেরিয়ে এলাম, ও পিছনে উঠলো, ডায়নামোটা অন করে এগিয়ে চললাম। রাস্তায় বেশ ভিড়, কাল তো হরতাল, তাই সবাই বাজার-টাজার করে নিয়ে যাচ্ছে, সিনেমাও নিশ্চয় বন্ধ থাকবে, তাই সেখানেও ভিড়, কালকেরটা আজই মিটিয়ে নিতে হবে।

শুটকা বলে উঠলো, ‘বাড়ি যাবি বললি যে?’

তা-ই নাকি, কিন্তু আমি তো শিখাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছি, শিখাকে বলে এসেছিলাম, এবেলা যাব। হাত তুলে ঘড়ি দেখলাম, সোয়া আটটা। বললাম, ‘শিখাদের বাড়ি যাব।‘

‘তবে আমাকে এখানেই নামিয়ে দে।‘

ব্রেক কষে দাঁড়ালাম, আর তখনই দেখলাম, কেশব দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজনের সঙ্গে ৷ একবার কোনরকমে চোখাচোখি হতেই, চোখ দুটো সরিয়ে নিল ও। আর আমার মনে পড়লো, ‘ওকে বলে দিও, ও সাপের গায়ে পা দিচ্ছে ‘….রোয়াব! চোট্টা কোথাকার, বেশী বললে, আজই শহরের সব লোককে বলে দেব। ওর চোখ জ্বলছিল, আর তখন রমেশের চোখ দুটোও আমার মনে পড়ে গেল, গরীবদের নেতা। নিরাপদবাবুরা কিছু বলেন না কেন, ভয় পান, না কি ভাবেন, রমেশদের কথা ফাঁস করে দিলে তাঁকে বিশ্বাস করবে না? আচ্ছা, আসলে কেশবের আলমারি থেকে সেদিন মালের বোতল ফাঁক করেছিলাম বলে ওরকম চটে নেই তো! না, তা হলে শিখা বলতো।

শিখাদের বাড়ির ভিতরে গাড়িটা রেখে, বাইরের ঘরে দেখি, শিখা একলা বসে আছে। তার আগেই, কোথা থেকে যেন ডাক্তারের হাসি-কাশি মেলানো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বোধ হয় বেলাদির আসরে। শিখা আমার দিকে চেয়েই চমকে উঠলো, বললো, ‘এ কি, কোথেকে এলে?’

আমি বসে পড়ে বললাম, ‘কী জানি স্‌লা, মনে পড়ছে না।‘

শিখা আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, আমার আপাদমস্তক দেখলো, যেন বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, তারপরে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাড়ি যাওনি তখন থেকে?’

‘না।‘

শিখা বারে বারে আমার প্যান্টের দিকে তাকাতে, আমিও তাকালাম। বিচ্ছিরি, তাড়াতাড়ি বোতাম লাগালাম, খেয়ালই ছিল না। জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় ছিলে?’

‘শুটকাদের বাড়ি।‘

মিথ্যা কথা না বলে উপায় ছিল না, কারণ আমি জানি, শিবেদের বাড়ির কথা বললেই, মঞ্জরীর কথা ওর মনে হবে। অবিশ্যি জানি না, ও বিশ্বাস করলো কিনা, সেরকম ভাবেই তাকিয়ে রইলো, যেন বিশ্বাস করছে না, ও চোখ দুটো নামিয়ে রাখলো।

বললাম, ‘বড্ড খিদে পেয়েছে।‘

ও আবার অবাক হয়ে বললো, ‘খাওনি সারাদিন?’

‘না।‘

সেই মুহূর্তেই নাক কোঁচকালো, ঠোঁট কুঁচকে বললো, ‘কাড়িখানেক মদ গিলে এসেছ দেখছি।’

‘কিছু ভাল লাগছিল না।‘

শিখা আমার দিকে একবাব তাকিয়ে, ঘরের বাইরে চলে গেল, খানিকক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললো ‘রুটি আর কুমড়োর তরকারি খাবে?’

‘খাব।‘

‘তবে একটু বস।‘

বলে আমার হাতখানেক দূরের চেয়ারে বসলো। আমি শিখার দিকে চেয়ে কী যেন বলব বলব ভেবে বললাম, ‘আমি শিবেদের বাড়িতে ছিলাম দুপুরে।’

বলে যেন নিজেই অবাক হয়ে গেলাম, আর শিখার ভুরু দুটো কেমন একরকম ওপর দিকে ঠেলে উঠলো, জিজ্ঞেস কবলো, ‘কোনটা সত্যি?’

‘এটা।’

‘বলতে গেলে কেন?’

‘কী রকম খারাপ লাগছে।‘

শিখা চেয়ে রইলো। এখন ওর চুলে বিনুনি, কালো আর চকচকে, বাসন্তী রঙের জামা, সবুজ একটা এমনি সাধারণ শাড়ি। কিন্তু ওবেলার মতন শুধু জামা না, নিচেও কিছু আছে। আমি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালাম, একটু পায়চারি করে হঠাৎ বললাম, ‘জান শিখা, ছেলেবেলা থেকে-না, আমার-না, আমার কীরকম একটা ভয় ভয় ভাব আছে, আমি কোনদিন কারুকেই বলিনি, কীরকম একলা একলা থাকলে—মানে একা একা কারুকেই বলিনি, কীরকম একলা একলা থাকলে—মানে একা একা লাগলে, বুক গুরগুরিয়ে ওঠা একটা ভয় হয়, তখন আমি চেঁচামেচি করি, যা-তা…।”

শিখা যেন কীরকম অবাক হয়ে গেছে, আর শক্ত হয়ে বসে আছে। সেই অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কী হয়েছে?’

আমি কীরকম একটা চাপ ফীল করছিলাম বুকের কাছে, তাই বুকের কাছে হাত রেখে শিখার সামনে এসে বললাম, ‘জানি না, কিছু ভাল লাগছে না। আমি আজ চোপরার কাছে কাজ চাইতে গেছলাম, মানে চাকরি—শুয়োরের বাচ্চাটা কীরকম যেন প্রায় তাড়িয়েই দিল, মাইরি—আচ্ছা শিখা—!’

শিখা উঠে দাঁড়ালো, আর বুকের ওপর রাখা আমার হাতটার ওপরে ওর একটা হাত রাখলো, আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে তোমার বল তো?’

আচ্ছা, কেন, শিখা আমার মুখের এত সামনে, মদের গন্ধ তো পাচ্ছে, বলছে না তো! যেন এখন ওর সেকথা মনেই নেই। আমি বললাম, ‘আচ্ছা, আজ তুমি একলা কেন?’

‘আজ তো সবাই ব্যস্ত, কাল হরতাল, কেশবদাদেরও কী একটা আছে, আমার খুব খারাপ লাগছে, কাল একটা কাণ্ড না ঘটায়। কিন্তু শোন—’

‘আচ্ছা শিখা, আমি তো খুব খারাপ—তবু আজ আমার মনে হচ্ছিল, আমি যদি নিরাপদবাবু হয়ে যাই—তুমি হয়তো আমাকে—উহ্, শিখা, আমার ভীষণ বমি পাচ্ছে—‘

কিন্তু শিখা আমাকে ছাড়লো না, হাতটা ধরে তাড়াতাড়ি বাইরে টেনে নিতে গেল, বললো, ‘চল, কুয়াতলায় চল।‘

যেতে গিয়েও পারলাম না, শিখার গায়ের ওপরেই বমি করে ফেললাম—ভাবলাম, শিখা ছিটকে সরে যাবে। কিন্তু ও আমাকে টেনে বসিয়ে দিয়ে বললো, এখানেই কর। ইস, কেন এসব ছাইপাশ খাও, কী দুৰ্গন্ধ।‘

‘ওয়াক-ও-ও-ওয়াক, শিখা, আমি তোমার গায়ে—ওয়াক…।’

তখন আমি বসে পড়েই বমি করছি মেঝেতে। আর শিখা আমার ঘাড়ের কাছে হাত রেখেছে, বললো, আমি কাপড়টা ছেড়ে আসি, উঠো না যেন।’

আমি মেঝেতে একটা হাত রেখে, শুধু মদ বমি করতে লাগলাম। মনে হল, কে যেন একবার এল, কার যেন একটা ছায়া পড়লো, আবার সরে গেল, তারপরেই শিখা এল, বেলাদিকে সঙ্গে নিয়ে। বেলাদির হাতে একটা জলের বালতি আর ঘটি। শিখা তখন একটা অন্য শাড়ি পরে এসেছে। জিজ্ঞেস কবলো, ‘হয়েছে?’

বললাম, ‘হ্যাঁ।‘

ঘটি থেকে ও আমাকে জল ঢেলে দিল, আমি মুখ ধুয়ে নিলাম। তারপরে ও জল-হাত দিয়ে আমার মুখে মাথায়, জামার কয়েক জায়গায় বুলিয়ে দিল, বললো, ‘যাও, বস গে ওখানে।‘

বলেই, আমার কোমরের বাঁ দিতে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কী?’

আমি জবাব দেবার আগে, ও নিজেই আবার বললো, ‘আবার তুমি ছুরিটা নিয়ে বেরিয়েছ। বারণ করেছি না?’

এখন আর জবাব দিতে পারছি না, আসলে ওটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, সারাদিনই ওটা আমার কোমরে আছে, ওবেলা শিখা টের পায়নি। আমি উঠে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।

পাখাটা খুলে দিল, আর দুজনেই জল দিয়ে বমি ধুয়ে পরিষ্কার করলো। বেলাদি তিনবার তিন বালতি জল নিয়ে এল, শিখা একটা ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করলো। বেলাদি একবার বললো, ‘কেন যে খাও।‘

বেলাদি যেন আমাকে বললো না, হয়তো ওর বাবার বন্ধু সেই ডাক্তারকেই বললো, তবু বেলাদির বলাটা যেন কষ্টের মত। তারপরে শিখা এসে আবার বসলো, বেলাদি চলে গেল। আমি চেয়ারের পিছনে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছিলাম—এমন কিছু না, একটু দুর্বল লাগছিল। মাথাটা আস্তে আস্তে তুলে তাকালাম, দেখলাম, পাশে শিখা আর-একটা চেয়ারে বসে আছে, আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। কী যে বলতে যাচ্ছিলাম, কিছুই মনে করতে পাবছিলাম না। শিখা জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবে বলছিলে?’

‘এখন আর খেতে পারব না। আমি বাড়ি যাই।‘

‘না, না, এখন না, একটু বস। এখন তুমি মোটর-সাইকেল চালাতে পারবে না।”

‘পারব।‘

‘একটু বস-না!’

‘আস্তে আস্তে যাব। শিখা—।‘

‘বল।‘

কিছু না বলে, হাত বাড়িয়ে আমি ওর একটা হাত ধরলাম, তারপরে উঠে দাঁড়ালাম। শিখাও উঠলো। আমি ওর হাত ধরে বাইরে গেলাম, সেখানে অন্ধকার—বিশেষ করে এ বাড়িটার চার পাশেই গাছপালার জন্যে অন্ধকার। বারান্দা থেকে নামবার সময়, তখনো ওর হাতটা ছাড়িনি, ও বললো, ‘কাল বাড়ি থেকে বেরিও না, বলা যায় না, কী গোলমাল হবে?’

‘বিকেলের দিকে টুক করে একবার তোমার কাছে চলে আসব।’

ও বললো, ‘সত্যি চালিয়ে যেতে পারবে?

‘পারব। এইমাত্র বমি করেছি—সত্যি, মদের গন্ধ, তবু একটা চুমু খেতে দেবে?’

নিশ্চয়ই দেবে না, কিন্তু ঠোঁটটা অন্ধকারে এগিয়ে নিয়ে এসে, নিজেই খেল, বরং আমাকেই দিল না। গাড়িটা ঠেলতে আমার কষ্ট হল, তবু ঝাঁপের বাইরে নিয়ে গেলাম, ডায়নামে অন করে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম, মনে হল, একবার যেন শিখাব গলা শুনতে পেলাম, ‘সাবধান।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *