কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৪

কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৪

হাসান হোটেলের দিকে হাঁটতে থাকে।

দূরে একটা দশতলা দালান যেনোনা হাস্যানের সাথে কথা বলতে চায়।

হাসান বলে, তুমি একটি অশ্রুবিন্দু; তুমি চোখে টলমল ক’রে কাঁপছে, তোমার বুকের গভীরে অজস্র দুঃখ।

তোমাকে আমি শিশিরের মত্যুে মুঠোতে ধরতে চাই।

তুমি প্রজাপতি, সরষে খেতে উড়ে যাও, দশতলা, তুমি কদম ডালে ফুটে ওঠো আষাঢ়ের তুমুল বৃষ্টিতে।

দশতলা, তুমি প্রজাপতি হয়ে হারিয়ে গেছো, তোমার প্রত্যেক তলায়, নিজেকে তুমি খুঁজে পাচ্ছো না, তুমি জানাে না তুমি খুঁজছাে কাকে।

হাসানের মনে হয় দালানটিকে সে মুঠোতে ক’রে হাঁটছে, আর দালানটি তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরঝর ঝ’রে পড়ছে ঝরনাধারার মতো।

হোটেলে ঢোকার সময় ম্যানেজার উঠে তাকে একটা মস্ত সালাম দেয়। হাসান থমকে দাঁড়ায়; কলেজটা ছেড়ে আসার পর এমন সালাম সে অনেক দিন পায় নি। তার বেশ ভালো লাগে, মানুষের মাঝেমধ্যে সালামটালাম পাওয়াও দরকার। তাহলে সেও মানুষ, সালাম পেয়ে তার ভালো লাগছে?

ম্যানেজার বলে, ছার, আপনে পারমিশন দিলে আপনের ঘরে আধঘণ্টা পর আমি একটু আসুম।

হাসান বলে, আমি কি কোনো অপরাধ করেছি?

ম্যানেজার বলে, কন কি, কন কি ছার, আপনে অপরাধ করবেন ক্যান? আমিই অপরাধ করছি, দুই একদিন আগেই আমার যাওনা উচিত আছিল।

আধঘণ্টা পর ম্যানেজার তার ঘরের দরোজায় বেশ জোরে কড়া নাড়ে। হাসান দরোজা খুলে তাকে চেয়ারে বসতে বলে, আধশোয়াভাবে সে বিছানায় বসে।

ম্যানেজার বলে, ছার, আপনের বিছানায় দেহি খালি বই আর বই, এত বইপত্র পইর‍্যা আপনে কী করেন?

হাসান বলে, পড়ি, বই প’ড়ে কিছুই করি না।

ম্যানেজার জিজ্ঞেস করে, চাকরিবাকরি করেন কই?

হাসান বলে, আগে একটা কলেজে পড়াতাম, এখন কিছু করি না।

ম্যানেজার বলে, সারাদিন বইয়া আমি খুডইয়া খুডাইয়া প্যাপার পরি, আইজ প্যাপারে একটা কবিতার নিচে আপনের নাম দেখলাম। আমার মনে লয় অই কবিতাডা আপনেই লেখছেন।

হোটেলের ম্যানেজােরও কবিতা পড়ে, কবিতা কি বিচিত্র পথ পেরিয়ে এখন সর্বত্রগামী হয়ে উঠেছে?

হাসান বলে, হ্যাঁ, আমিই লিখেছি।

ম্যানেজার বলে, তাইলে ত আপনে কবি।

হাসান বলে, এখনো কবি হই নি, তবে হতে চাই।

ম্যানেজার বলে, আমার কি ভাইগ্য, আমার হোটেলে একজন কবি ওঠছেন, আমি একজন কবির দেখা পাইলাম; বুড়া আইলে কইতে পারুম অই কবিরে আমি চিনি, আমার হোটেলে সে আছিল।

হাসান বলে, ততোদিন আপনি আমাকে ভুলে যাবেন।

ম্যানেজার এবার একটু চুপ ক’রে থাকে, হাসানের দিকে ভালো ক’রে তাকায়, এবং বলে, ছার, কবিরা তা মাইয়ালোক পছন্দ করে?

হাসান বলে, সবাই মেয়েলোক পছন্দ করে। ম্যানেজার বলে, হ, হ, সবাই করে, আমিও করি, রাইতে একবার মাইয়ালোক ছারা আমারও চলে না।

হাসান বলে, আপনার স্বাস্থ্য দেখে তো মনে হয় একবার কেনো, দু-তিনবারই আপনার দরকার। আপনার বউ কটি?

ম্যানেজার বলে, বউয়ের দরকার কি ছার, বউ ত একটাই আছে গ্যারামে, হে পোলাপান লইয়া থাকে, আমার মাইয়ালোক লাগে বউ লাগে না, বিনাপয়সায়ই আমি মাইয়ালোক পাই।

হাসান বলে, আপনাকে আমার মহাপুরুষ মনে হচ্ছে।

ম্যানেজার বলে, আমার হোটেলে ভাল ভাল মাইয়া আছে, রেটও বেশি না, ছার, পুলিশরেও ট্যাকাপিয়সা দেওয়া আছে, ডর নাই, আপনের কি লাগবো?

হাসান জিজ্ঞেস করে, কাগজে আমার কবিতাটি কি আপনি পড়েছেন?

ম্যানেজার হা হা ক’রে হাসে, ছার, একবার পরছি, তয় অই কবিতা বোঝানের কি আমার সাইধ্য আছে, তয় একটা কথা মনে হইল।

হাসান জিজ্ঞেস করে, কথাটি কী?

ম্যানেজার বলে, কবিতাটায় মাইয়ালোকের দেহের কথা আছে, দুখের কথা আছে, লজ্জার জায়গার কথাও আছে, মনে হইল অনেক দিন আপনে মাইয়ালোকের লগে শোন নাই, কিন্তু শোআনের লিগা আপনের শরিল ফাইট্যা যাইতেছে।

হাসান বলে, ম্যানেজার সাহেব, আপনি কবিতা বেশ বোঝেন, ইউনিভার্সিটির প্রফেসরগুলোও এতোটা বোঝে না।

ম্যানেজার বলে, কি যে কান ছার, কি যে কন।

হাসান বলে, চলুন, মেয়েগুলোকে দেখি।

ম্যানেজার হাসানকে নিয়ে তেতলার একটি ঘরে যায়; হাসান দেখে মেয়ে কলকল খলখল করছে, ওদের কণ্ঠের শব্দ ওদের মুখের রঙের মতোই শস্তা ও তীব্র।

ম্যানেজার বলে, ছার, দেখেন কোনাডারে আপনের পছন্দ হয়। সবগুলিই মাল ভাল, ইচ্ছা লইলে ধইর‍্যাও দেখতে পারেন।

হাসান মেয়েগুলোর দিকে বিব্রতভাবে তাকায়; মেয়েগুলোকে কি সে টিপে টিপে পরীক্ষা ক’রে দেখবে, ওদের জিভ টেনে বের ক’রে দেখবে, ওদের শরীরের ওপরের কটকটে রঙিন বস্তিগুলো ছিঁড়ে ওদের খুলে দেখবে, অন্ধকার সুড়ঙ্গগুলোতে উঁকি দিয়ে দেখবে?

একটি মেয়ে বলে, চোখ-মেইল্যা ভাল কইর‍্যা দেখেন, সাব, কোনাডারে আপনের পছন্দ। আমাগো সবারই শরিল আর বুক ভাল; আমাগো অসুক নাই, আমরা গিরস্ত ঘরের মাইয়া, আমরা বেশ্যা না।

হাসান দুটি মেয়েকে দেখিয়ে ম্যানেজারকে বলে, এই মেয়ে দুটি আমার পছন্দ। ম্যানেজার বলে, কন কি, ছার, আপনের দুইডা মাইয়া লাগবো?

হাসান বলে, হ্যাঁ।

ম্যানেজার বলে, সারারাত ধইরা লাগবো, ছার?

হাসান বলে, হ্যাঁ।

ম্যানেজার বলে, দইজনের দুইশ টাকা লাগবো, ছার।

হাসান বলে, তাতে অসুবিধা নেই।

ম্যানেজার বলে, একটা কেরু লাগবো না, ছার?

হাসান বলে, হ্যাঁ, তাও লাগবে। হাসান চ’লে আসে, কিছুক্ষণ পর মেয়ে দুটি খলখল ক’রে তার ঘরে ঢোকে। ঢুকেই একটি মেয়ে বলে, আপনের দেখি বিছনা ভরা বই, আমাগো লইয়া শুইবেন কই?

খিলখিল ক’রে হাসে মেয়েটি। আরেকটি মেয়ে বলে, বইই বোধয় সাবের বউ, সাবের আবার মাইয়ালোকের দরকার কি?

হাসান বলে, দেখছো তো আমার দুটি মেয়েলোক লাগে, একটিতে হয় না।

প্রথম মেয়েটি বলে, এইটা ভাইব্যাই আমরা তাজব হই, দুইটা মাইয়া দিয়া আপনে কি করবেন? একটা লইয়া লোকজন পারে না, সারারাইতের জাইন্যে নিয়া একঘণ্টা পরই বাইর কইর‍্যা দোআনের লিগা অস্থির হইয়া ওঠে।

হাসান কেরুটা খোলে, একটা তীব্ৰ দুৰ্গন্ধ এসে তার রক্তে ধাক্কা দেয়; তবু সে তিনটি সবুজ-শাদা শস্তা গেলাশে কেরু ঢালে, পানি মেশায়।

নিজে একটু চুমুক দিয়ে বলে, তোমরা নাও। মেয়ে দুটি বিছানার ওপর বসে গেলাশে চুমুক দেয়। হাসান এক চুমুকে গোলাশটি শেষ ক’রে আবার গেলাশ ভরে, চুমুক দেয়; এবং মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে বলে, তোমাদের নাম আমি জানি না।

একটি মেয়ে বলে, আমার নাম সুন্দরী।

হাসান বলে, তোমার আমি নাম দিলাম কংকাবতী।

মেয়েটি বলে, কি নাম দিলেন, নামটা ত সোন্দর।

হাসান বলে, কংকাবতী।

মেয়েটি বলে, আইজ থিকা আমি কংকাবতী, নামটা ভুলুম না, নামটা আমার সোন্দর লাগতেছে।

হাসান আরেকটি মেয়েকে বলে, তোমার আমি নাম দিলাম আফ্রোদিতি।

মেয়েটি বলে, কি নাম কইলেন? খুব কঠিন আর সোন্দর লাগতেছে ত।

হাসান বলে, আফ্রোদিতি।

মেয়েটি বলে, তাইলে আমিও আইজ থিকা আফরদিতি।

হাসান জিজ্ঞেস করে, আমাকে কেমন লাগছে তোমাদের?

কংকাবতী বলে, খুব ভাল মনে হইতাছে; অন্য পুরুষগো মতন লাগতেছে না। তারা ত ঘরে ঢুকাইয়াই ছিইর‍্যাফাইর‍্যা শুরু কইর‍্যা দেয়।

হাসান বলে, তোমরা কি জানাে একধরনের মানুষ আছে, যারা কোনাে অপরাধ করে নি, তবু তারা অপরাধী, তারা সবচেয়ে সুস্থ, তবু তারা সবচেয়ে বড়ো পাগল, এতো বড়ো পাগল আর নেই?

কংকাবতী আর আফ্রোদিতি গেলাশে চুমুক দিতে দিতে বলে, না ত, এমুন মাইনষের কথা আমরা শুনি নাই। অপরাধ না করলে আবার অপরাধী হইব কেন, পাগল না হইলে আবার পাগল হইব কেন?

হাসান বলে, আমাকে দেখো, আমি সেই মানুষ।

তারা চমকে ওঠে, অ্যা, আপনে পাগল? আপনেরে দেইখা ত পাগল মনে হইতেছে না, আপনেরে তা ভাল মানুষ মনে হইতেছে।।

হাসান বলে, যাদের দেখে পাগল মনে হয়, তারা গভীর পাগল নয় পবিত্র পাগল নয় বিশুদ্ধ পাগল নয়, তারা পাগলদের নকল, গভীর বিশুদ্ধ পবিত্র পাগল দেখে কখনাে পাগল মনে হয় না।

কংকাবতী বলে, আমারে আরেক গেলাশ দেন, সাব, জিনিশটা টানতে আমার ভাল লাগতেছে। আপনে পাগল হইলে আমিও পাগল; আইজ রাইতে আমার পাগল হইতে ইচ্ছা লাগতেছে।

আফ্রোদিতিও বলে, আমারেও আরেক গেলাশ দেন, সাব, এমুন রাইতু আর পামু না এমুন রাইত আর আইব না, এত ভাল পাগল আর পামু না; দুনিয়াতে একটাও খাঁটি পাগল দ্যাখলাম না।

হাসান তাদের গেলাশে কেরু ঢালতে ঢালতে বলে, আমি তোমাদের সাথে আজ রাতে কবিতা দিয়ে করবাে, সেইটা দিয়ে না; কবিতা দিয়ে তোমাদের স্তন ছোঁবাে ঠোঁট ছোঁবাে কবিতা দিয়ে তোমাদের ভেতরে নামবো, এতো ভেতরে নামবাে যেখানে কখনাে কেউ নামে নি।

আফ্রোদিতি গেলাশে চুমুক দিতে দিতে বলে, যা দিয়া ইচ্ছা আপনের তা দিয়াই করেন, আমাগো ভালই লাগতেছে, তয় দেইখ্যেন আমাগো যেন কোনো ক্ষতি না হয়, ছিররাফাইররা না যায়।

হাসান তার পােশাক খুলে ফেলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

মেয়ে দুটি একবার চমকে ওঠে; তার শিশ্নের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হাসান বলে, তোমরাও হও, আমার মতো নগ্ন পবিত্র শুদ্ধ আদিম, আমার মতো কবি।

কংকাবতী বলে, বাত্তি জ্বলাইয়া এমন হইতে আমাগো শরম লাগে, সাব।

হাসান বলে, নগ্নতা সুন্দর, নগ্ন না হ’লে মানুষ পবিত্র হয় না, নগ্নতায় লজ্জা নেই, তোমরা কবিতার বোন, কবিতার মতো নগ্ন কবিতার মতো শুদ্ধ, কবিরা চিরকাল তোমাদের বন্দনা করেছে, আলো অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য নেই তোমাদের রক্তে, আলোই অন্ধকার, আলোর অন্ধকারেই তোমাদের আমি নগ্ন পবিত্র বিশুদ্ধ সুন্দর দেখতে চাই। আমি তোমাদের দেখতে চাই, তোমাদের কেউ দেখতে চায়না, তোমাদের স্তনবৃত্তের দিকে কেউ তাকায় না, তোমাদের গ্ৰীবার জ্যোৎস্নার দিকে কেউ তাকায় না, সবাই তোমাদের মাংস খেতে চায়।

মেয়ে দুটি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে থাকে। হাসান বলে, নগ্নতা মাথা নিচু ক’রে থাকার জন্যে নয়, কংকাবতী; নগ্নতা লজ্জা পাওয়ার জন্যে নয়, আফ্রোদিতি।

হাসান একটি বস্তু দেখিয়ে বলে, এ হচ্ছে পবিত্র ভ্রাতা।

কংকাবতী আফ্রোদিতি সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

হাসান একটি বস্তু দেখিয়ে বলে, এ হচ্ছে বিশুদ্ধ ভগিনী।

কংকাবতী আফ্রোদিতি কেঁপে ওঠে।

হাসান তাদের প্রসারিত অঞ্চলে হাত বুলিয়ে বলে, এ হলো সবুজ তৃণভূমি; এখানে তৃণ ঘাস থাকার কথা ছিলো, কেনো নেই?

মেয়ে দুটি হাসে, তাদের হাসিতে ঘাস গজিয়ে ওঠে।

হাসান মন্দিরের দরোজায় হাত রেখে বলে, এটা হচ্ছে দেবীমন্দির, এই মন্দিরে সবাই পুজো দেয়, সবাই মাথা নত করে। আমি পূজারী।

মেয়ে দুটি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে

হাসান বিছানায় উঠে তাদের মাঝখানে ব’সে বই খুলে জীবনানন্দের ‘অন্ধকার’ কবিতাটি পড়তে থাকে, তার স্বরে মেয়ে দুটি মুখ তুলে হাসানের দিকে তাকায়।

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনিত ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি। কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি। হে নর, হে নারী, তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন; আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।

কংকাবতী গেলাশে চুমুক দিতে দিতে জড়ানো স্বরে বলে, আপনে কি পরতেছেন বোঝতে পারতেছি না, তয় মনে হইতেছে আমি পুকইরের কালা পানির ভিতর সাতর কাটতাছি, ডুবাইতে ডুবাইতে পুকইরের মইদ্যে গিয়া শাপলাফুল তোলতাছি, আমার উপর মেঘ পরতেছে, আমার চুল ভাইস্যা যাইতাছে। সাবা আপনে পরেন, রাইত ভইর‍্যা পরেন।

কংকাবতী একটি হাত দিয়ে জড়ায় হাসানকে, ওর শরীর থেকে ধূমায়িত একটি গন্ধ না সুগন্ধ না রঙ এসে ঢাকতে থাকে হাসানকে।

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে কেন জাগাতে চাও? হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন।

আফ্রোদিতি কাঁপা কাঁপা হাতে হাসানের ঠোঁট ছোঁয়, হাসানের স্বর্গীয় অরণ্যের তলদেশে সোনালি সাপের ফণায় গিয়ে যেনো ওর আঙুল লতাগুল্মজালে জড়িয়ে পড়ে, সে জড়ানো গলিত স্বরে বলে, আমার মনে হইতেছে গোস্তের ভিতর আগুন জ্বলতেছে, আমার দেহে আর গোস্ত নাই, সব পুইর‍্যা আগুন হইয়া জ্বলতেছে, সাবরে জরাইয়া ধইর‍্যা আমার পদ্মানদীর ঢেউয়ের লগে ভাইস্যা যাইতে ইচ্ছা হইতাছে, সাব, আপনে আমারে ধরেন, আমার সবখানে আপনের হাত দেন, গলায় কামড় দেন, শিনায় কামড় দেন, সবখানে আপনের দাঁত বসাইয়া দেন।

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর; তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকিব–ধীরে–পাউষের রাতে–কোনোদিন জাগাব না জেনে–কোনোদিন জাগাব না আমি–কোনোদিন আর।

কংকাবতী বলে, আরও পরেন, সাব, মেঘ হইতাছে বাজ ডাকতাছে, ঘরের চাল উইর‍্যা যাইতাছে।

হাসান বলে, কংকাবতী আফ্রোদিতি, তোমাদের পূর্ণিমাজ্বলা স্তনের দিকে তাকিয়ে দেখো, তোমাদের স্তন পদ্মার নৌকোর পালের মতো ফুঠে উঠছে, পালে আষাঢ় শ্রাবণের ঝড় ঢুকছে বৃষ্টি ঢুকছে।

হাসান বিপর্যস্ত মাঝির মতো পালগুলো স্পর্শ করে, দড়ি টেনে টেনে যেনো মাস্তুলের শীর্ষে তুলতে থাকে; একটি পাল থেকে আরেকটি পালে যেতে থাকে, তার আঙুল আর ওষ্ঠ শ্ৰাবণ হয়ে বয়ে যেতে থাকে–পাল থেকে নৌকোয়, ছাইয়ে, গলুইয়ে, সমস্ত বাকে, এবং সে দেখে তার নোঙর কোনো গভীর অতলে ডুবে যাওয়ার জন্যে অনন্ত কাল ধ’রে যেনো অপেক্ষা ক’রে আছে।

কংকাবতী জিজ্ঞেস করে, পাল কারে কয়?

হাসান বলে, নৌকোর বাদাম, এই যে দুটি বাদাম।

আফ্রোদিতি বলে, এমুনি কইর‍্যা বাদাম আগে কোনোদিন ফোলে নাই।

কংকাবতী বলে, আমার বাদাম থারথার কইর‍্যা কাপতেছে, গাঙে তুফান আসছে, এমুন তুফান আর আসে নাই।

হাসান বলে, তোমাদের শরীর সোনার গাছের মতো ঝলমল করছে। তোমরা সোনার গাছ, তোমাদের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে আঙুরের লাল কামনা। মানুষ হচ্ছে সোনার গাছ, তার শিরায় শিরায় রক্ত নয় বয়ে চলে আঙুর।

আফ্রোদিতি বলে, প্রত্যেক রাইতে আপনেরে লইয়া আমার থাকনের ইচ্ছা হইতেছে, তয় আপনেরে তা পামু না। আপনে বলছিলেন আপনে পাগল, নিজেরে আমার মনে হইতেছে পাগলি। আমি পাগলি, আমারে ধইরা যা ইচ্ছা করেন, ছিইর‍্যা ফালান, ভাইঙ্গা ফালান, আমি জ্বইল্যা যাইতেছি।

কংকাবতী বলে, রাইত য্যান না ফুরায়, আমার যান ঘোম না আসে।

হাসান ঘুমের ঘোরে নোঙর ফেলতে থাকে, সে এক সোনার নৌকো থেকে আরেক সোনার নৌকোয় গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে, নৌকোর ছইয়ে উঠতে থাকে, গলুইয়ে গিয়ে বৈঠা বাইতে থাকে, এক নদী থেকে যেতে থাকে আরেক নদীতে হাজার বছর ধ’রে অনন্ত বৃষ্টিতে অনন্ত অন্ধকারে অনন্ত চাঁদের তলে, সে গ’লে যেতে থাকে জলের মতো, আবার নোঙর হয়ে উঠতে থাকে, নোঙর ফেলতে থাকে, তীর ভেঙে পড়তে থাকে নদী তোলপাড় ক’রে।

আলোটাকে এক সময় হাসানের কাছে মনে হয় অশ্লীল অসভ্য অন্ধকার, কেঁপে কেঁপে উঠে সে আলোটা নিভিয়ে দেয়, অন্য আলো ছড়িয়ে পড়ে।

দুটি নদীর মিলনস্থলের মতো সে আবার প্রবেশ করে, তার মনে হ’তে থাকে সে কখনো মানুষ ছিলো না, ছিলো হয়তো কোনো বন্যপ্ৰাণী, সবুজ জঙ্গলের পাতার আদরে সে হাজার হাজার বছর ধ’রে বেড়েছে, গুহায় বাস করেছে, কাদায় গড়িয়েছে অনন্ত কাল; হয়তো সে ছিলো নদী, বা পুকুর, বা ধানখেত, বন্যশুয়োর বা মত্ত হাতি বা ক্ষুধার্ত বাঘ।

ভোর হয়ে এলে কংকাবতী বলে, যাইতে ইচ্ছা করতেছে না, এই দিকে ভোর হইয়া আসতেছে।

আফ্রোদিতি বলে, এমুন রাইত আর আসব না, যত দিন বাচুম এই রাইতরে মনে করুম।

হাসান বলে, আমার জীবনেও আসবে না; তোমরা আবার এলেও এ-রাত আর আসবে না। তোমাদেরও আমি আর কোনো রাতে চাই না।

মেয়ে দুটি একটু আহত বোধ করে।

আফ্রোদিতি বলে, আমাগো আপনে ঘিন্না করতেছেন, সাব?

হাসান বলে, না, না, ঘেন্না নয়। তোমাদের নিয়ে আজ রাতে আমি একটি শরীরের কবিতা লিখেছি, পবিত্র অপরাধ করেছি, যা আমি আর কোনোদিন লিখতে পারবো না কোনোদিন করতে পারবো না।

কংকাবতী আফ্রোদিতি বেরিয়ে যায়, হাসান বিছানায় গড়াতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *