আমি, আমার মা ও কবরের অন্ধকার

সইয়ের বাড়িতে বসে খবরটা মা পেয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। গ্রামে মিলিটারি এসেছে, জ্বালাও পোড়াও করেছে, মানুষ মেরেছে। কিন্তু আমাদের বাড়িটা মিলিটারিরা লুটপাট করেনি।
কে করেছে?
লুট হয়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরেই আমি তা জেনে গিয়েছিলাম।
তখনও দুপুর হয়নি।
লুট হয়ে যাওয়া বাড়ির আঙিনায় বসে শিশুর মতো কাঁদছি। অদূরে লুটের হাত থেকে বেঁচে থাকা আমাদের একমাত্র সম্পদ মায়ের কোরআন শরীফটা রেহালের ওপর রাখা।
আমি কাঁদছিলাম সেই দিকে তাকিয়ে।
দুপুরের পর পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলেন মা। চার পাঁচমাইল দূরের কুম্বাইল গ্রাম থেকে ছুটতে ছুটতে এসেছেন। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি এসেছে, যেকোনও বিপদ আপদ হতে পারে রাস্তায়, মা সেইসব কেয়ারই করেননি। তাঁর পরনে সস্তা ধরনের একটা প্রিন্টের শাড়ি। বাড়িতে ঢুকে দেখে মাটিতে অসহায় ভঙ্গিতে বসে কাঁদছি আমি। প্রথমেই আমার দিকে তাকালেন না মা। চারদিক তাকিয়ে ফাঁকা শূন্য বাড়িটা দেখলেন। রেহালের ওপর রাখা কোরআন শরীফটা দেখে ছুটে গিয়ে সেই কোরআন শরীফ বুকে চেপে ধরলেন।
তারপর তাকালেন আমার দিকে।
একহাতে বুকে ধরা কোরআন শরীফ, অন্যহাত রাখলেন আমার মাথায়। কান্দিস না বাজান, কান্দিস না। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
মাকে দেখে আমার কান্না আরও বেড়ে গেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমগ কিছু নাই মা। আমরা পথের ফকির হইয়া গেছি।
মা আবার সেই কথা বললেন, ধৈর্য ধর।
পথে আসতে আসতে মা বোধহয় খবর পেয়ে গিয়েছিলেন কে লুট করেছে আমাদের বাড়ি।
সেই বদমাশ কেরামত আলীর ভাই। লোকটার নাম ফজল আলী।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়ে ফজলের বাড়িতে গেলেন মা। গিয়ে দেখেন আমাদের বাড়ির টিন কাঠ খাট চৌকি চেয়ার টেবিল এমনকি হাঁড়িপাতিল থালাবাসন পর্যন্ত সেই বাড়ির উঠানে। ফজল আর তার বড়ভাই কেরামত দুজনে আমাদের দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছে।
মা গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেন। ফজল এইটা তুমি কী করছ? আমার বাড়ির ঘরদুয়ার সব লুট করলা?
ফজল না, কেরামত কেলানো একটা হাসি হাসল। আমরা লুট করি নাই। লুটের হাত থিকা বাঁচাইছি।
কেমনে বাঁচাইলা? আমার বাড়ির সব জিনিস দেখি তোমগ উঠানে পইড়া রইছে।
সব আপনের না মামানী।
তয় কার?
এই উঠানে যেইসব জিনিস দেখতাছেন, এইসব জিনিস এই পাড়ার আরও কয়েকজন মাইনষের। যাগো যাগো বাড়ি লুট হইতেছিল, সেইসব বাড়িতে গিয়া লুটতরাজ করা মানুষগ আমরা ঠেকাইছি। তাগো হাত থিকা জিনিসপত্র যতটা রক্ষা করতে পারছি, সব এই বাড়িতে লইয়া আইছি।
কও কী?
এবার কথা বলল, ফজল। হ মামানী, আমরা আপনের লগে মিছাকথা কই না।
মা চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছেন আমাদের বাড়ির সব জিনিস ফজলের বাড়ির উঠানে। তারপরও তারা বলে ওইসব জিনিস নাকি আমাদের না!
মা অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্ক করলেন তাদের সঙ্গে। কাজ হলো না, মার কথা ওরা পাত্তাই দিল না।
শেষপর্যন্ত মা বললেন, তোমরা কী কইতে চাও উঠানের এইসব জিনিসের মধ্যে কিছুই নাই আমার?
কেরামত বলল, আছে।
কী আছে?
আপনের বাড়ির ছয়খান টিন আছে।
মাত্র ছয়খান টিন?
হ। লুটতরাজকারীদের হাত থিকা আপনের বাড়ির মাত্র ছয়খান টিনই আমরা বাঁচাইতে পারছিলাম। আপনের ছয়খান টিন আপনে লইয়া যান।
মা আর কোনও কথা বললেন না, বাড়িতে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। মা আর আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ধরাধরি করে ছয়টা টিন নিয়ে এলাম বাড়িতে। ওই ছয়খানা টিনই তখন আমাদের সম্বল, আর কিচ্ছু নেই। মার পরনে প্রিন্টের সস্তা একটা শাড়ি। আমার পরনে হাঁটুর কাছে ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট, আর কোড়া রঙের অতি পুরনো একটা স্যান্ডোগেঞ্জি।
মনে আছে, ছেঁড়া প্যান্টটার রঙ ছিল খয়েরি।
ততোক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে।
আমাদের খাওয়া হয়নি কিছুই। কোত্থেকে হবে, বাড়ির কোথাও কিছু নেই। সবই লুট হয়ে গেছে। আমার চোখের পানি আর ফুরায়ই না, শুধু ভাইয়ের কথা মনে হয়। কোথায় আছে আমার বড়ভাই, ভাবী আর ছোটবোন? কোথায় আছে আমার সেই বাউণ্ডুলে মেজোভাই, কে জানে? বেঁচে আছে , না মরে গেছে সবাই তাই বা কে জানে? যে বাড়িতে, যে ঘরের চার দেয়ালের মাঝখানে, মাথার ওপর রোদ বৃষ্টি ঠেকাবার চালা ছিল যে ঘরে, সেই ঘরের ভিতর জড়াজড়ি করে বড় হওয়া, জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো আজ কে কোথায়? পাকিস্তানী জন্তুগুলো হামলার পর হামলা চালিয়ে কোথায় কীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমাদেরকে। তাদের হামলার সুযোগে আমাদের কিছু নিজস্ব মানুষও নিঃস্ব করে দিয়েছে আপনজনকে।
অন্যদের কথা আমি তখন ভাবতে পারছিলাম না, ভাবছিলাম শুধু আমার আর আমার ওই দুঃখিনী মায়ের কথা।
এই দুজন মানুষ
আমরা বাঁচবো কী করে?
মাথা গুঁজবো কোথায়?
খাবো কী?
পরবো কী?
বুকে কোরআন শরীফটা মা ধরেই রেখেছেন। এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন ওই পবিত্র গ্রন্থ। যেন এই গ্রন্থই যাবতীয় বিপদ আপদ থেকে, ঝড়ঝঞ্জা থেকে রক্ষা করবে অসহায় মা এবং ছেলেকে।
আমার কান্না থামে না দেখে মা আমাকে বুঝাতে লাগলেন, এইভাবে কান্দিস না। কান্দন থামা। এইটাও আল্লাহর একটা পরীক্ষা। আল্লাহপাক বিপদ আপদ দিয়া তার বান্দাগো পরীক্ষা করে। ধৈর্য ধর, আল্লাই পথ দেখাইবো।
ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
কোথায় রাত কাটাবো আমরা?
চারপাশের যেকোনও বাড়িতে গিয়েই রাত কাটাতে পারি। কোনও বাড়িতেই সেভাবে লোকজন কেউ নেই। বেশিরভাগ বাড়িই খালি পড়ে আছে। যেকোনও একটাতে গিয়ে উঠলেই হয়।
মা বললেন, নিজের বাড়ি ছাইড়া আমি কোনখানে যামু না।
আমি অবাক! তাইলে থাকবা কই?
এই বাড়িতেই থাকুম।
এই বাড়িতে তো ঘরদুয়ার কিচ্ছু নাই?
তারপরও এই বাড়িতেই থাকুম।
গ্রামে যখন তখন আসতে পারে মিলিটারি। গুলি করে আর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে মারতে পারে সবাইকে। এসব শোনার পর থেকে প্রত্যেক বাড়িতেই বড় বড় গর্ত করা হয়েছিল, অর্থাৎ বাংকার করা হয়েছিল। থানাঅলারা আর গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকের বুদ্ধি পরামর্শে প্রত্যেক বাড়িতে বাংকার করেছিল লোকে। আমাদের বাড়িতে বড় একটা বাংকার করেছিলাম আমি। অনেকটা কবরের আকৃতি। বাড়ির পিছন দিকটায়। ভিতরে বসে থাকলে বাইরে থেকে দেখে মিলিটারিরা যেন কিছু অনুমান করতে না পারে এইভাবে করেছিলাম বাংকারটা। ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে বাংকার করে তার ওপর আড়াআড়ি করে বাঁশ ফেলে বাঁশের ওপর চালার মতো করে দিয়েছিলাম বাঁশের তৈরি একটা বেড়া, তার ওপর কয়েক ঝুড়ি মাটি আর মাটির ওপর কিছু ঝোঁপঝাড়। একদিককার মুখ ফাঁকা। সেই দিক দিয়ে বাংকারে নামা যাবে। ওই মুখটার ওপর ফেলে রেখেছিলাম আলগা একটা বেড়া। বাংকারে নেমে সেই বেড়া টেনে দিলে বোঝা যাবে না এর ভেতর মানুষ আছে কী না?
মা বললেন, রাতটা আমরা ওই গর্তে কাটামু।
শুনে আমি চমকে উঠলাম। কও কী তুমি?
হ।
ওই রকম জায়গায় সারারাত বইসা থাকতে পারবা?
পারুম। তুই পারবি কী না সেইটা ক?
তুমি পারলে আমিও পারুম।
তয় আর চিন্তা নাই।
কিন্তু খাইবা কী? খাওনের তো কোনও পথ দেখতাছি না।
কাইল সকাল পর্যন্ত না খাইয়া থাকন লাগবো। পারবি না?
আমি কাতর গলায় বললাম, আমার তো অহনই খিদায় পেট জ্বইলা যাইতাছে।
মা বললেন, ধৈর্য ধর বাজান, ধৈর্য ধর। একটা মাত্র রাইত। পেটের খিদা চাইপা রাখ। কাইল আল্লাহপাক কোনও না কোনও ব্যবস্থা করবোই। খিদা সহ্য করতে না পারলে চাপকল থিকা পানি খাইয়া আয়।
আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা চাপকল ছিল। সবই লুট হয়ে গেছে, চাপকলটা লুট হয়নি। ফজলের চোখে চাপকলটা বোধহয় পড়েইনি। পড়লে মাটির তলার পাইপ পর্যন্ত টেনে তুলে নিয়ে যেত।
মার কথায় চাপকলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একহাতে চাপকল টিপে, অন্যহাতে অনেকক্ষণ ধরে পানি খেলাম। গাল মুখ চটচটে হয়েছিল চোখের পানিতে। চাপকলের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখটা খুব ভালো করে ধুয়ে ফেললাম। ময়লা স্যান্ডোগেঞ্জি মুখের কাছে তুলে মুখ মুছতে মুছতে এলাম মার কাছে।
মার বুকে তখনও কোরআন শরীফ। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাচ্ছে চারদিকে। মার হাত ধরে বাংকারে গিয়ে নামলাম। প্রথমে নামালাম মাকে। তারপর নিজে নেমে আলগা ঝাপটা টেনে দিলাম বাংকারের মুখে। মুহূর্তে গভীর গভীরতর এক অন্ধকার জগতে চলে গেলাম।
মৃত্যুর জগৎ কী ঠিক এই রকম না?
কবর কী ঠিক এই রকম না?
এই রকম অন্ধকার আর নির্জন?
জীবিত মানুষের কবরবাসের অভিজ্ঞতা কী রকম কেউ তা জানে কী না জানি না। আমি আমার কবরবাসের অভিজ্ঞতা টের পেলাম সেই রাতে।
বাংকারের এককোণে বুকে কোরআন শরীফ জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন মা। মাঝখানে বিঘত পরিমাণ ব্যবধান, আমি বসে আছি। দুজন মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ টের পাই দুজনে কিন্তু কেউ কোনও কথা বলি না।
কবরে থাকা মানুষ কি কথা বলে?
মা সবসময় দোয়া পড়ে একটু শব্দ করে। সেই রাতে সেই কবরের অন্ধকারে বসে মা কোনও শব্দ করছিলেন না। বুকে জড়ানো কোরআন শরীফ নিয়ে আল্লাহকে মা ডাকছিলেন নিঃশব্দে। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন।
আল্লাহকে ডাকছিলাম আমিও। মায়ের মতো নিঃশব্দেই ছিল সেই ডাক। এই করে করে ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানকার একটা অবস্থা তৈরি হলো দুজনেরই। নাকি ওই অবস্থাটাকে বলে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানকার অবস্থা?
এই অবস্থা কাটলো ভোররাতের দিকে।
সারারাত আমাদের চারপাশে কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। ছিল মাটির তলার নৈঃশব্দ। সেই প্রথম আমি আবিষ্কার করেছিলাম নৈঃশব্দের ভিতরেও থাকে এক রকম শব্দ। সেই শব্দ জীবনের শব্দ না, সেই শব্দ মৃত্যুর শব্দ।
মৃত্যুর শব্দ থেকে জীবনের শব্দে ফিরলাম ভোররাতে। বহুদূর থেকে ভোরবেলার পবিত্র হাওয়ায় আমাদের মা ছেলের কবরের ভিতরে মিহিন সুরে ভেসে এলো ফজরের আজানের শব্দ। সেই শব্দে মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরে এলাম আমরা। মা একটু নড়েচড়ে উঠলেন। আজানের শব্দ পাছ লাল?
আমিও একটু নড়ে উঠলাম। হ মা পাই।
তয় তো ফজর হইছে?
হ।
ল অহন বাইর হই।
লও।
মা ছেলে তখন আমরা কবর থেকে বেরিয়ে এলাম। খোলা জায়গায় দাঁড়াবার পর আশ্চর্য এক অনুভূতি হলো আমার। ভোরবেলার হাওয়া, পাখির ডাক আর গাছপালার গন্ধে, পায়ের তলার ঘাস মাটির গন্ধে মনে হলো এই প্রথম পৃথিবীর মাটি হাওয়াতে, ঘাসের বনে আর গাছগাছালির শীতলতায় বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের অন্যকোনও গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসে যেন পা দিয়েছি আমি। অথবা মৃত্যুর জগৎ থেকে এইমাত্র ফিরেছি জীবনে। সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভিতর মুচড়ে উঠল তীব্রক্ষুধা। কাল থেকে কিছ্ইু যে খাওয়া হয়নি, কবরের অন্ধকারে একবারও টের পাইনি সেই অনুভূতি। এখন পেলাম।
মাকে বললাম, মা আমি খিদায় মইরা যাইতাছি। যেমনে পারো আমারে কিছু খাওয়াও।
মা বললেন, আমি বন্দোবস্ত করতাছি। তুই কোনও চিন্তা করিস না।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়েই বাঁশবাগানের ওদিককার রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন মা। কোথায় গেলেন জানি না। আমি বসে রইলাম কাল সারাদিন যেখানটায় বসেছিলাম, বাড়ির আঙিনার ঠিক সেই জায়গাটাতে। আমার তখন মাথা কাজ করছে না। চিন্তা চেতনা অনুভূতি সব লোপ পেয়ে গেছে খিদায়। বাংকারে রাত কাটিয়েছি বলে হাত পা মুখ মাথা সব ভরে আছে ধুলোতে। নিজেকে মনে হচ্ছে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা খিদার কষ্টে ধুকতে থাকা মৃতপ্রায় কোনও শেয়াল।
মা ফিরে এলেন বেশ তাড়াতাড়ি।
হাতে একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি। হাঁড়িতে কিছু চাল। এসেই কোরআন শরীফটা রাখলেন রেহালের ওপর। রেহালটা ঠিক সেই আগের জায়গাতেই ছিল।
মা তারপর চাপকলটার কাছে গিয়ে হাঁড়ির চালগুলো ধুঁয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে নিয়ে এলেন। আমাদের রান্নাচালার ওদিকটাও ফাঁকা। শুধু মাটির চুলা দুটো আছে। লাকড়ি খড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। চুলার একপাশে ছোট্ট ন্যাকডায় জড়ানো থাকে ম্যাচ। ম্যাচটা সেভাবেই আছে। সেই ম্যাচ জ্বেলে চুলায় আগুন জ্বাললেন মা।
এলুমিনিয়ামের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে লাগল চাল। জাউ রান্না করলেন মা। পাতলা জাউ না, থকথকে। থালা বাসন কিচ্ছু নেই। কেমন করে খাবো এই জিনিস?
একটা সময়ে দেখি নিজের অজান্তেই আমি এবং আমার মা মুঠো করে হাঁড়ি থেকে সেই থকথকে জাউ তুলছি আর পাগলের মতো খাচ্ছি। কোনও দিকেই খেয়াল নেই আমাদের।
পেটপুরে জাউ খাওয়ার ফলে শরীরের শক্তিটা আমার ফিরে এসেছিল। মাও বেশ শক্ত সমর্থ মহিলা। সারাদিন খেটেখুটে মা আর আমি মিলে ফজলের বাড়ি থেকে আনা ছয়টা টিন দিয়ে রোদ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার মতো একটা চালা মতো করে ফেললাম। বাঁশের খুঁটিখাঁটি দিয়ে একেবারেই যেনতেন একটা ব্যবস্থা। দুজন মানুষ কোনওরকমে ঘুমাতে পারে এইটুকু মাত্র জায়গা।
আহা রে, কত জৌলুশ একদিন এই বাড়ির ছিল। আর আজ?
চালাটার দিকে যতবার তাকাই, আমার চোখ ভরে আসে জলে। বুকটা হু হু করে। আমাদের বাড়ি লুট করেছিল কেরামতের ভাই ফজল। ফজলের কথা ভেবে বুকের ভেতর হুঙ্কার ছেড়ে জেগে উঠতে চায় এক ঘুমন্ত সিংহ।
ফজল শুয়োরের বাচ্চাকে আমি দেখে নেবো। কোনো না কোনোদিন প্রতিশোধ ওর ওপর আমি নেবোই।


এলাকার তরুণ যুবকরা তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া শুরু করেছে।
আগে থেকেই যাচ্ছিল। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি আসার পর গোপনে গোপনে যাওয়া বেড়ে গেল। আমার বয়সী আমার বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে গেল। যারা যায়, তারা কেউ কেউ গোপনে গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে। দেখা করে বলে, কী রে লাল, যাবি? চল যাইগা।
মার সামনেই কেউ কেউ এরকম কথা বলে। মা তাদেরকে বলেন, তোরা যা বাজান, লাল পরে যাইবো।
কেন যে মা আমাকে এভাবে ফিরিয়ে রাখছিলেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবাই জানে আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কোনও রকমে তৈরি করা একটা টিনের চালায় মা আর আমি থাকি। ধার উধার করে মা কিছু চাল জোগাড় করেন, কিছু আনাজপাতি ডাল মাছ জোগাড় করেন, ওই খেয়ে কোনও রকমে আমরা বাঁচি। কেরামত আলীর শত্র“তায় এই অবস্থা আমাদের। ভাইকে দিয়ে সে আমাদের বাড়ি লুট করিয়েছে। ওই যে আমার বোনকে পাঁচ নম্বর বউ বানাতে চেয়েছিল। মা রাজি হননি দেখে এইভাবে সে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল।
কেরামতের কথা ভাবলে আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে জন্মে, বাঙালির ঘরে জন্মে, বাঙালি হয়েও কোনও কোনও মানুষ ছিল পাকিস্তানী মিলিটারির নরপশুগুলোর চেয়েও নিকৃষ্ট।
আমার বুকটা তখন ক্রোধে জ্বলে। আমার ইচ্ছে করে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে ফিরে আসি। পাকিস্তানী মিলিটারিগুলোর সঙ্গে গুলি করে মারি কেরামত আর ফজলের মতো বাংলাভাষায় কথা বলা নিকৃষ্টতম জীবগুলোকে।
মাকে বলি এইসব কথা। মা আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে এসে এইসব অনাচারের প্রতিশোধ নিই।
মা বলেন সেই এক কথা। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
খুশিবুজি তখন কুম্বাইলে, মার সইয়ের বাড়িতে। ছোটবোন মাজেদা ঢাকায় বড়ভাইয়ের কাছে। মেজোভাইয়ের খবর নেই। কোথায় আছে কে জানে! শুনেছি বড়ভাইয়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম রেখেছে মামুন। ভাই ভাবী আর তাদের একমাত্র সন্তান , সঙ্গে আছে মাজেদা, আমার ছোটবুজি। কারও কোনও খবর নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। শুধু তিনজন মানুষের ব্যাপারে নিশ্চিত। যে হ্যাঁ, এই তিনজন মানুষ আমরা বেঁচে আছি। মা খুশিবুজি আর আমি।
মা আর আমি দুজন অসহায় মানুষ কী যে হতাশা নিয়ে বেঁচে আছি তখন। এই হতাশা সহ্য হয় না। এই হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভোররাতের দিকে একদিন আমি একা একা রওনা দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসবো।
মোস্তফা আর আবুল খায়ের আগেই চলে গিয়েছিল। গিয়ে কী যেন কী কারণে আবার ফিরে এসেছে। ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শুনেছি ফিরে এসেছে কিন্তু কোথায় আছে জানি না।
আমারও শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না। কাঁচামাটিয়া নদী পার হয়ে আটদশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে মনে হয়েছিল, এ আমি কী করছি? আমার অসহায় মাকে আমি কার কাছে ফেলে যাচ্ছি? আমি চলে গেলে মার আর থাকলো কে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে ফজল আলীর বাড়ি থেকে পাওয়া ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায় কুপি জ্বালিয়ে আমার আশায় বসেছিলেন মা। বসে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ছায়ার মতো নিঃশব্দে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কুপির আলোয় দেখি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মা আমার কোরআন শরীফ পড়ছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *