৮. মন্তব্য – ইতিহাসের গোড়ার কথা

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
অষ্টম পরিচ্ছেদ – মন্তব্য

মন্তব্য

শতাব্দী পর শতাব্দীর বিরোধ-মিলনের মধ্য দিয়া এমন করিয়া ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বুকে আর্যভাষী আদি-নর্ডিকেরা এক সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিল। সে জনের রক্তবিশুদ্ধতা আর রহিল না; তাহার রক্তে বিচিত্র রক্তধারার স্রোতধ্বনি রণিত হইতে লাগিল, কোথাও ক্ষীণ, কোথাও উচ্চগ্রামে। এই সমন্বিত জনের নাম ভারতীয় জন। সে ধর্মও আর বেদ-ব্ৰাহ্মণের ধর্ম রহিল না। তাহার মধ্যে বিভিন্ন বিচিত্র পূর্বতন ধর্মের আদর্শ, আচার, অনুষ্ঠান সব মিলিয়া মিশিয়া এক নূতন ধর্ম গড়িয়া উঠিল; তাহার নাম পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। সে সভ্যতাও বৈদিক আর্যভাষীর সভ্যতা থাকিল না; বিচিত্র পূর্বতন সভ্যতার উপাদান উপকরণ আহরণ করিয়া তাহার এক নূতন রূপ ধীরে ধীরে পৃথিবীর দৃষ্টির সম্মুখে ফুটিয়া উঠিল। এই নূতন সমন্বিত সভ্যতার নাম ভারতীয় সভ্যতা। আর সেই সংস্কৃতিই কি বেদ-ব্ৰাহ্মণের সংস্কৃতি থাকিতে পারিল? তাহার মানসলোকে কত যে পূর্বতন জন ও সংস্কৃতির সৃষ্টি-পুরাণ, দেবতাবাদ, ভয়-বিশ্বাস, ভাব-কল্পনা, স্বভাব-প্রকৃতি, ইতিকাহিনী, ধ্যানধারণা আশ্রয়লাভ করিল তাহার ইয়ত্তা নাই। সকলকে আশ্রয় দিয়া, সকলের মধ্যে আশ্রয় পাইয়া, সকলকে আত্মসাৎ করিয়া, সকলের মধ্যে বিস্তৃত হইয়া এই সংস্কৃতিও এক নূতন সমন্বিত রূপ লাভ করিল; তাহার নাম ভারতীয় সংস্কৃতি। আজ আবার গত সাতশত বৎসর ধরিয়া আর এক বৃহৎ সমন্বয় চলিতেছে এবং তাহার ফলে আমাদের এই বৃহৎ দেশখণ্ডে আর এক নূতন জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি রূপ লাভ করিতেছে।

এই সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা এবং সংস্কৃতিও একটি চলমান প্রবাহ। এই প্রবাহ আজও চলিতেছে। পরবর্তী কালে ইতিহাসের আবর্তচক্রে বারবার নূতন নূতন জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিচিত্ররূপে তাঁহাদের বিরোধ-মিলন ঘটিয়াছে, আজও ঘটিতেছে। ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। চলমান প্রবাহ, বিরুদ্ধ প্রবাহ, সমন্বিতপ্রবাহ—ইহাই জীবনের গতিধর্ম। এই গতিধর্ম স্মৃতি ঐতিহ্যবহ; এই ধর্মই জীবনীশক্তি, প্রাণশক্তি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই ধর্মের বিকাশের দিকে তাকাইয়া বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হইয়াছে;

রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত যারা এসেছিল সবে
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে, কেহ নহে নহে দূর—
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তারি বিচিত্র সুর।

যাহাই হউক, যে সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা এইমাত্র বলিলাম, তাহার জন্মনীড় হইল উত্তর-ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশ। তাঁহাদের বাহন হইল আর্যভাষা। এই আর্যভাষাকে আশ্রয় করিয়া ধীরে ধীরে গাঙ্গেয় প্রদেশের ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবাহ বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-সপ্তম শতক হইতে। আদিমতম স্তরে, আদি-অষ্ট্রেলীয়, তারপর দীর্ঘমুণ্ড ভূমধ্য-নরগোষ্ঠী, গোলমুণ্ড অ্যালপো-দীনারায় নরগোষ্ঠী এবং সর্বশেষে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশের মিশ্র আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর ক্ষীণ ধারা— এই কয়েকটি ধারার মিলনে বাঙালী জনের সৃষ্টি। অ্যালপো-দীনারায় প্রবাহপূর্ব আদিম-বাঙালী মুখ্যত অনার্য; আর্য-প্রবাহ প্রথম আনিল অ্যালপো-দীনারীয় জাতিই। তারপর দ্বিতীয় প্রবাহ ক্ষীণ ধারায় আনিল আদি-নর্ডিকেরা, কিন্তু উত্তর ভারতের সেই প্রবাহ মিশ্রিত হইয়া গিয়াছিল। যাহাই হউক, উত্তর ভারতের মিশ্র আদি-নর্ডিকদের এবং কিয়ৎপরিমাণে অ্যালপো-দীনারীয়দের আর্যভাষাই সৃজ্যমান বাঙালী জনকে একটা নূতন মানসরূপ দান করিল; আদিম বাঙালীর আদি-অষ্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় মন ও প্রকৃতির উপর ব্রাত্য অ্যালপো-দীনারায় এবং মিশ্র আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর মন ও প্রকৃতির চন্দনানুলেপন পড়িল এবং তাহাই বাঙালীকে, বাঙালী চরিত্রকে একটা ফুটতর বৈশিষ্ট্য দান করিল। এই বিবর্তন-পরিবর্তন একদিনে হয় নাই, হাজার বৎসরেরও (খ্ৰীষ্টপূর্ব তাহা ষষ্ঠ-সপ্তম শতক হইতে খ্ৰীষ্টপরবর্তী ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত মোটামুটি) অধিককাল ধরিয়া তাহা চলিয়াছিল। কিন্তু সে তথ্য এবং তথ্যগত বিবরণ ইতিবৃত্তের কথা; এ অধ্যায়ে তাহার স্থান নাই।

এই অধ্যায়ে আমি যাহা বলিতে চেষ্টা করিলাম, যে ভাবে অস্ফুট অপরিস্তুত ঐতিহাসিক উষাকালের রেখাচিত্র আঁকিতে, যে সব ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করিলাম, ঐতিহাসিকেরা সকল ক্ষেত্রে তাহা স্বীকার করিবেন, আমি তাহা আশা করি না। সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট পাথুরে প্রমাণ না পাইলে সাধারণত ইতিহাসের দাবি মেটে না; অথচ যে প্রাগৈতিহাসিক কালের কাহিনী এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সেই কালের ঐতিহাসিক-গ্রাহ্য প্রমাণ সুদুর্লভ। তবু, মানুষের জানিবার আকাঙক্ষা দুর্নিবার, সেই আগ্রহে মানুষ নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবন করে; নরতত্ত্ব, জনতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এবং প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব তাহা কয়েকটি উপায় মাত্র। এইসব উপায়ের সাহায্যে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা এ পর্যন্ত যে সব নির্ধারণে পৌঁছিয়াছেন, তাহাই বিচার ও বিশ্লেষণ করিয়া, কিছু রাখিয়া কিছু ছাঁটিয়া, কিছু বাছিয়া, নানা ইঙ্গিতগুলি ফুটাইয়া আমার এই রেখাচিত্র। ঐতিহাসিক কালে বাঙলার ও বাঙালীর যে ইতিহাস আমাদের চোখের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়, তাহার সকল তথ্য, সকল ইঙ্গিত, সকল ভাব-কল্পনা, ধ্যান-ধারণা, উপাদান-উপকরণ, আচার-অনুষ্ঠান, গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি ঐতিহাসিক কালের তথ্য-প্রমাণের মধ্যে পাওয়া যায় না, সে তথ্য ও প্রমাণ ঐতিহাসিক কাল অতিক্রম করিয়া প্রাগৈতিহাসিক কালের মধ্যে বিস্তৃত। বাঙালীর ইতিহাস বলিতে বসিয়া সেইজন্য সেই অস্ফুট কাল সম্বন্ধে এই সুদীর্ঘ প্রস্তাবের অবতারণা করিতে হইল। শুধু প্রাচীন নয়, আজিকার বাঙালীরও এই ক্ষীণালোকদীপ্ত উষার ইতিহাস যতটুকু সাধ্য জানা প্রয়োজন। এই ইতিহাস বাদ দিলে বাঙালীর ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না; এই কারণেই আমি এমনভাবে এমন ইঙ্গিতে এই ইতিহাস উপস্থিত করিলাম যাহার ফলে বাঙালীর এবং বাঙলার জীবন-প্রবাহের মূল উৎস আমাদের হৃদয়মনের নিকটতর হইতে পারে। “আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যাবেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো।” এই অধ্যায় সেই ‘সকালবেলায় সল্‌তে পাকানো।’