৩১. নীতিবোধ

নীতিবোধ

যজ্ঞানুষ্ঠাতা বৈদিক আৰ্যগোষ্ঠীর বিশ্ববীক্ষায় দৈব হস্তক্ষেপ ছিল স্বাভাবিক ও অনিবাৰ্য। কেননা তখন দৈনন্দিন জগতে দেবতা, দানব, পিশাচ, প্ৰেত, নাগ ও পশু বিরাজ করত। প্রত্নকথাগুলিতে তখন এই বিশ্বাস পরিস্ফুট হয়েছে যে, সৃষ্টিতে কোনো নীতিহীন বিশৃঙ্খলা নেই; বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড নিয়মে শাসিত। বিশ্বজগতের অন্তলীন সাম্যবোধ বিপর্যন্ত করার জন্য কিছু কিছু শক্তি সক্রিয়; বিধ্বস্ত ঐক্যবোধকে পুনর্বিন্যস্ত করার অনিবাৰ্য আবশ্যিক প্রেরণা থেকে প্রাগুরু প্ৰত্নকথাগুলির জন্ম হয়েছে। সৃষ্টির মূলগত ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেবতারা মানুষের ওপর অর্পণ করেছিলেন বলেই মানব জীবন একটি কেন্দ্রীভূত বিশ্ববোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আধ্যাত্মবাদী প্রবণতা থেকেই এক মহৎ নীতিবোধের জন্ম হয়েছিল; তাই অনুষ্ঠানকেন্দ্ৰিক মানসিকতাই তৎকালীন সমাজে একমাত্র স্বীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠল এবং প্রত্যেক তাৎপৰ্যপূর্ণ মানবিক কাৰ্যই হয়ে উঠল ধর্মাচরণের অঙ্গ। যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রত্যেক অনুপুঙ্খ প্রত্ন-পৌরাণিক তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে নীতিবোধের বিচিত্রগামী অভিব্যক্তিতে নতুন একটি মাত্রা যোগ করল। ঋগ্বেদের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাওয়া যায়। সেই সমস্ত সূক্তে যেখানে দেবতা এবং মানুষকে ধৈৰ্য, দান, ঋজুতা, দয়া, অতিথিপরায়ণতা ও সহযোগিতা জাতীয় গুণাবলীর জন্য প্ৰশংসা করা হয়েছে। অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্ৰ কিংবা অশ্মীদের মতো দেবতারা পূর্বোক্ত গুণগুলির জন্যই মহৎ; বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে জীবনকে সার্থকভাবে সমন্বিত করার প্রেরণা তারা দিয়েছেন; সেই সঙ্গে বিপদ, ক্ষুধা, ব্যাধি, অন্ধকার ও মৃত্যুর কবল থেকে জীবনকে মুক্ত করার যথার্থ পথও তারা নির্দেশ করেছেন। বিশেষত আলোর জন্য নিরস্তর তৃষ্ণ ঋগ্বেদে বারেবারে ব্যক্ত হয়েছে। কেননা বৈদিক আৰ্যদের নিকট এই আলো একই সঙ্গে জ্ঞান, উপলব্ধি, আনন্দ ও জীবনের প্রতীক। ঋগ্বেদের বিখ্যাত প্রার্থনা– ‘উদয় সূর্যকে যেন আমরা চিরদিন দেখতে পাই’। ঋগ্বেদের নীতিবোধের মূল প্রেরণাই এই যে, জীবন অমূল্য এবং মূলত কল্যাণময়, মধুর ও উপভোগ্য বলেই এই আশ্চর্য রহস্যময় জীবনকে যতদিন পর্যন্ত সম্ভব, উপভোগ করাই বাঞ্ছনীয়।