২৮. চিত্রকল্প

চিত্রকল্প

মৌখিক কাব্যের সর্বাধিক গুরুত্বপূৰ্ণ বৈশিষ্ট্য বাক্‌সংযম। যদিও এটি বিবিধ উপায়ে সাধিত হত, তবু বাকস্বল্পতা অর্জনের প্রয়াস শুষ্ক ও নিম্প্রাণ আনুষ্ঠানিক সঙ্কেতসূত্রেই পর্যবসিত হয় নি। যে কোন মানদণ্ডেই ঋগ্বেদীয় সূক্তের অনেক সূক্তই কাব্যাপদবাচ্য।

বহু-কবি-বিরচিত এই জাতীয় বিপুল সাহিত্যে, খুব স্বাভাবিকভাবেই, কাব্যবিচারে বেশ কিছু অংশ উৎকৃষ্ট আবার অনেক অংশই নগণ্য হয়। প্রাচীন কাব্যে যে ধরনের প্রচলিত রীতি রয়েছে, সে সমস্তই বৈদিক সূক্তে ব্যবহৃত হয়েছে। বৈদিক সূক্তের বহুলাংশই অনলংকৃত এবং সম্ভবত তৎকালীন সাধারণ বাগভঙ্গির খুবই নিকটবতী; তবু এর বহুস্থানে চিত্রকল্প প্ৰযুক্ত হয়েছে এবং তা সার্থকভাবেই। মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রাচীন সাহিত্য চিত্রকল্প শুধুমাত্র শোভাবর্ধক নয়-এর একটি কার্যকরী ভূমিকাও রয়েছে, কেননা অলংকৃত কাব্যে শব্দনির্ভর এক ইন্দ্ৰজাল রচনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট প্ৰতীয়মান। বৈদিক চিত্রকল্পের অধিকাংশই নিমিত হয়েছে উপমা, রূপক, সমাসোক্তি ও অনুপ্রাসের প্রয়োগের দ্বারা। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমরা যাকে চিত্ৰকল্প বলে মনে করছি, বৈদিক কবিদের বা তাদের শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে তার তাৎপৰ্য সম্ভবত অনেকটাই ভিন্ন ছিল, কেননা তথাকথিত চিত্রকল্পগুলি ছিল তাদের দৈনন্দিন বাগব্যবহারের সাধারণ অঙ্গ। কিন্তু ভাষাগত অভ্যাস ও শৈলীগত প্রকরণের দিক দিয়ে বৈদিক সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যুগের যে স্পষ্ট ব্যবধান এসে গেছে, তার ফলে আমাদের পক্ষে পূর্বপরিকল্পিত আলংকারিক রীতির সঙ্গে সাধারণ ভাষার বিশেষভঙ্গির পার্থক্য নিরূপণ করা আজ খুবই কঠিন।

বৈদিক উপমা প্রধানত তিন ধরনের-স্বতঃস্ফুর্তভাবে কাব্যিক, পরিকল্পিতভাবে আলংকারিক ও স্পষ্টতই ঐন্দ্ৰজালিক। সংহিতায় নিছক শোভাবর্ধক উপমা প্রকৃতপক্ষে খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। কাব্যিক ও ঐন্দ্ৰজালিক উপমাই পৰ্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়-অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য এই দুই জাতীয় উপমা পরস্পর ভিন্ন নয়। অন্যভাবে বলা যায়, উপমা কবিতার সৌন্দৰ্য বৃদ্ধি করে বা দেবতা ও মানুষের নিকট আরো শ্রুতিকর করে তোলে ব’লেই সেহেতু কবি তার প্রয়োগ করেন, তাই একই সঙ্গে তাঁর অবচেতনায় এই উপলব্ধিও রয়েছে যে, উপমা সূক্তটিকে অনুষ্ঠানগতভাবে অর্থাৎ ঐন্দ্ৰজালিক দিক দিয়ে আরো নিশ্চিত ফলপ্ৰদ করে তুলবে। যজমানের অভীষ্ট সিদ্ধির প্রয়োজনে দেবতাকে তার প্রার্থনা পূরণের অনুকুল করে তোলার জন্য কবি যে সমস্ত অনুষ্ঠানগতভাবে কার্যকরি সূক্ত রচনা করতেন, তাতে উপমার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই বাচনিক উপাদান সূক্তকে অধিকতর মনোমুগ্ধকর ও জাদুশক্তিতে সমৃদ্ধতর করে তুলত। বৈদিক উপমা দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত গণ্ডী থেকেই উপমান সংগ্রহ করেছে। মোটামুটিভাবে সেই সব উপমানকে নিম্নোক্তভাবে বিন্যস্ত করা যায়-(ক) প্রকৃতি : যেমন নদী, বৃক্ষ, লতা ইত্যাদি। (খ) প্ৰাণীজগৎযেখানে পরিচিত প্ৰাণীদের মধ্য থেকে মানবিক গুণাবলীর সাদৃশ্য সন্ধান করা হত; (গ) বিভিন্ন মানবিক সম্পর্ক, যেমন-অপত্যস্নেহ, দাম্পত্য প্ৰেম, প্রতিবেশিগ্ৰীতি ও অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কের অনুভূতি; (ঘ) বিবিধ বৃত্তি (ঙ) দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন উপকরণ বস্তু এবং (চ) মহাজাগতিক।

অভিব্যক্তির কার্যকারিতাকে তীক্ষ্ণতর করে তোলার জন্যে মানুষ বহু প্ৰাচীন কালেই প্ৰতীক বা বস্তুর সমান্তরাল বিকল্প অর্থাৎ প্ৰত্নকথার সন্ধান ও প্রয়োগ করতে শিখেছিল। সুসংহত প্রত্নকথা থেকেই প্রথম পর্যায়ের উপমার সৃষ্টি এবং আরও বেশি সংহতি ও শব্দসংকোচের পর্যায়ে তা রূপকে পরিণত হয়েছিল। প্ৰাচীন কবিতায় এই সব চিত্রকল্পের নিজস্ব বাস্তব জীবন ছাড়াও তাৎক্ষণিক সৌন্দর্য সৃষ্টির অতিরিক্ত কিছু বিশেষ ধরনের ক্ষমতাও ছিল। কবির কল্পনা ও প্রতিভা অব্যবহিত পরবর্তী প্রসঙ্গে গভীরতর জীবনাবেগ যুক্ত করার জন্যই তাকে জীবনের অন্য কোন সমান্তরাল দিকের সঙ্গে তুলনা করত। প্রত্যক্ষ যে জগৎ অথবা পরম্পরাক্রমে আগত দেবপুরাণের যে জগৎ তার থেকে তুলনীয় উপাদান আহরণ করে বিবক্ষিত বস্তুটিকে স্পষ্টতর ও দৃঢ়তর করার প্রয়াসেই প্ৰথম ব্যবহৃত হ’ল উপমা। ফলে এই শক্তিসাধক অলংকরণের দ্বারা মন্ত্রের ব্যঞ্জনাশক্তি বহু শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও অনুষ্ঠানের ঈপ্সিত ফল উৎপাদনে সমর্থ বলে উপস্থাপিত করল। চূড়ান্ত বিচারে চিত্রকল্প বিষয়বস্তুর গৌরব বৃদ্ধি করে ফললাভের সম্ভাবনাকেই সুনিশ্চিত করে। বৈদিক উপমাগুলির শক্তি ও কার্যকারিতা সমান নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি অত্যন্ত সতেজ ও সজীব। অনুমান করা যায় যে, বৈদিক সূক্তগুলি রচিত হওয়ার বহু পূর্ব হতেই শ্লোক রচনার একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল; এমন কি সংহিতাতেও কিছু কিছু উপমাকে গতানুগতিক ও বিধিবদ্ধ মনে হয়; আবার একই সঙ্গে কিছু কিছু উপমা নবীন ও প্রাণবন্ত। উপমাকে সংক্ষিপ্ত করে, দৃঢ়তর ও শক্তিযুক্ত করে রূপক; ঋগ্বেদে বেশ কিছু রূপকেরও ব্যবহার আছে।

উপমা ও রূপকের তুলনায় অতিশয়ােক্তি কিছু অধিক সংখ্যায় পাওয়া যায়; শ্ৰোতৃমণ্ডলীকে প্রভাবিত করার জন্য চূড়ান্ত আতিশয্যের আশ্ৰয় নেওয়ার পদ্ধতি সাধারণভাবে প্রাচীন ও অর্বাচীন সব সাহিত্যেরই বিশিষ্ট, চরিত্রলক্ষণ ঋখেদে পড়ি : সমুদ্র যেভাবে জল ধারণ করে, ইন্দ্রের পাকস্থলীও তেমনি সোমরসে পূর্ণ (১ : ৮ : ৭)। বস্তুত ইন্দ্রের কীর্তি বৰ্ণনা প্রসঙ্গেই অতিশয়োক্তি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে; এছাড়া, বায়ুবাত দেবতাদের শক্তি, সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোন দেবতার বিশ্বজাগতিক কার্যকলাপ এবং আর্যদের শক্রবাহিনীর অত্যাচার ও বৈরিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রচুর অতিশয়োক্তি প্ৰযুক্ত হয়েছে। দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রশস্তি ও প্রার্থনা এই অলংকার প্রয়োগের ক্ষেত্ৰ প্ৰস্তুত করেছিল। বিশেষত যখন সদ্য ফললাভের আকাঙক্ষা প্রবল এবং অভীষ্ট পূরণে সূক্তের ক্ষমতা সম্পর্কে বিপুলসংখ্যক প্রত্যাশী ও সংগ্ৰহ অংশগ্রহণকারী শ্রোতৃমণ্ডলীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রভাবিত করা প্রয়োজন। বৈদিক কবিতায় অতিশয়োক্তির ভূমিকা নিছক আলংকারিক নয়, তার একটা ধমীয় ও প্রত্নপৌরাণিক কাৰ্যকারিতাও রয়েছে। দেবতাদের ঐশী ক্ষমতাসম্পন্ন রূপে উপস্থাপিত করার অর্থ তাদের অতিমানবিক গৌরব প্রতিষ্ঠা ; কল্পনাকে উদ্বুদ্ধ করে অভীষ্ট বস্তুদানের ক্ষমতা সম্পর্কে দেবতাদের উপর বিশ্বাস জাগাবার জন্য কবি তাদের ক্ষমতা ও কীর্তিকাহিনীকে মাত্রাহীন আতিশয্যে মণ্ডিত করতে চেয়েছেন। দেবতাদের অতীত কাৰ্যকলাপ সম্পর্কে বর্তমানে কোন প্ৰমাণ সংগ্রহের প্রয়োজন নেই ; সমাজের গোষ্ঠীগত প্রয়োজন নির্বাহের জন্য দেবতাদের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা লাভের গৌরবজনক অতীত কাহিনী বর্ণনা ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপিত করা হ’ত। শ্রোতাদের জানানো হ’ত, তাদের পূর্বপুরুষের জন্য দেবতারা কত কিছু করেছিলেন–যথোপযুক্তভাবে সন্তুষ্টি বিধান করা হলে তাদের জন্যও তারা একই রকম উদার বদান্যতায় দান করবেন। এই উদ্দেশ্যেই অতিশয়োক্তি প্ৰযুক্ত হাত-যাতে আকাঙক্ষা ও তার পূর্ণতা, এবং সম্ভাব্যতা ও বাস্তবের মধ্যবর্তী ব্যবধানের মধ্যে সেতু নির্মাণ করা যায়। অর্থাৎ তাদের প্রয়োগ নিছক আলংকারিক নয়, একই সঙ্গে প্ৰত্বপৌরাণিক ও আনুষ্ঠানিক। অতএর আমরা দেখছি যে, বৈদিক কবিতায় শুধুমাত্র শোভাবৃদ্ধির জন্য অলংকার ব্যবহৃত হয় না, তার কিছু সাহিত্যাতিরিক্ত উদ্দেশ্যও রয়েছে। কবি তার নিজের জন্য, গোষ্ঠীর জন্য এবং দেবতার জন্যই রচনা করতেন; কিন্তু অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে তিনি রচনা করতেন পুরোহিতের জন্য, যাতে সেই পুরোহিতরা গোষ্ঠীর প্রয়োজন দেবতার নিকট আরও ভালভাবে উপস্থাপিত করতে পারেন এবং দেবতা তাদের প্রার্থনা পূরণ করেন। এই প্রার্থিব প্রয়োজনের আবেগ অবশ্য কবির সমুন্নত দেবস্তুতিতে কোন হানি করে নি ; বস্তুত গোষ্ঠীর প্রয়োজনে কবির আবেগ পরিশীলিত হওয়াতে তার প্রার্থনার গৌরব বৃদ্ধি হত। এইজন্য কবি উপমা, রূপক, অনুপ্রাস এবং অতিশয়োক্তির মতো যে সমস্ত অতিরিক্ত শিল্প প্রকরণের আশ্রয় নিতেন–দেবতাদের নিকট প্ৰশক্তি তাতে আরো রমণীয় হত এবং দেবতারা তাতে যেন আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠতেন, ফলে প্রার্থনার সাফল্য তাদের কাছে নিশ্চিততর হয়ে প্রতিভাত হত এবং সেই সঙ্গে তাদের কল্পনায় যজ্ঞাও হয়ে উঠত আশু ফলপ্ৰদ।

শব্দালংকারের ক্ষেত্রে অনুপ্রাস সবচেয়ে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত। তবে পরবতী সংস্কৃত কাব্যের মতো অনুপ্রাস বৈদিক কাব্যে কবির রচনাপ্রতিভা প্রদর্শনের বা নিছক আঙ্গিকগত সমৃদ্ধির প্রয়োজনে খুব কমই ব্যবহৃত হয়েছে; মূলত মন্ত্র আবৃত্তিতে অধিকতর গতিময়তা ও সৌষ্ঠব সৃষ্টির জন্য এবং আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই সংহিতায় অনুপ্রাস প্ৰযুক্ত হয়েছে।

প্রাচীন গ্রিক ও ইরাণীয় সাহিত্য পর্যালোচনা ক’রে আমাদের মনে হয়, অনুপ্রাস ইন্দো-ইয়োরোপীয় কাব্যে সম্ভবত ব্যাপকভাবেই ব্যবহৃত হত। স্বরবর্ণের ছন্দোবদ্ধ পুনরাবৃত্তি এবং ব্যঞ্জন বর্ণের আনুপ্রাসিক প্রয়োগ সতর্ক যত্ন ও দক্ষ কারুকুশলতার পরিচয় বহন করে। সদৃশ ধ্বনির পরস্পর সংবেশন এবং বিশেষত নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে তাদের ছন্দোনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তি মাঝে মাঝে এমন ধরনের বাচনিক অভিঘাত নির্মাণ করেছে যেখানে ধবনির মধ্যে দিয়েই অর্থ স্পষ্ট উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

চতুস্পার্শ্বস্থ জীবনের ঘনিষ্ট প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ফলে এ ধরনের চিত্ৰকল্প নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল বলেই ঋগ্বেদীয় চিত্রকল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সজীবতা ও স্পষ্টতা। এটা অনস্বীকার্য যে, কিছু কিছু সূক্ত এমন ধরনের স্বল্পাধী উচ্ছাসপ্রবণ চারণকবিদের দ্বারা রচিত হয়েছিল, প্রতিভার দৈন্যে যাঁরা প্রাচীনতর কবিদের রচনা নির্বিচারে আত্মসাৎ করে প্রায়শই বিচিত্র উৎস থেকে সঙ্কলিত ও বহুব্যবহৃত চিত্ৰকল্প কাব্যে সরাসরি ব্যবহার করতেন। তবে সংহিতার বহু সূক্তই প্রকৃত শিল্পীর সৃষ্টি : সেখানেও শুধুমাত্ৰ শোভা বর্ধনের জন্য চিত্ৰকল্প ব্যবহৃত হয়নি; অভিজ্ঞতার অনিবাৰ্য প্রেরণার ফলেই এবং অনুষ্ঠানের অভীষ্ঠ সিদ্ধির জন্য এদের স্মফতঃস্ফুর্ত আবির্ভাব। চিত্রকল্পপ্রয়োগের পশ্চাতে এই দৃঢ়-বিশ্বাস সর্বদাই সক্রিয় ছিল যে, সার্থক বর্ণনা অনুষ্ঠানগতভাবেও অধিকতর ফলপ্রসু। সমস্ত ঋগ্বেদীয় সূক্তই যে স্বাধীন কাব্যিক অনুভূতির স্বতঃস্ফুর্ত উৎসসারণ নয়, সম্ভবত তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া মান্য সম্পূর্ণত অকাব্যিক দানীন্তুতিসমূহে, এবং সেইসব সূক্তগুলির মধ্যে যেখানে হোতা, পোতা, ঋত্বিক, নেষ্টা, প্রশাস্তা, অধ্বর্যু ও ব্ৰহ্মা শ্রেণীভূক্ত পুরোহিতদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নীরস অকাব্যিক গদ্যভঙ্গীতে বিবত হয়েছে।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ’ল শ্লোক রচনার আঙ্গিকটি শুধু বৈদিক কাব্যের সঙ্গেই সহব্যাপ্ত নয়, কেননা স্তবস্তুতি ছাড়াও আনুষ্ঠানিকভাবে তাৎপৰ্যপূর্ণ যে কোন বস্তুই সংহিতার উপজীব্য। যজ্ঞে ব্যবহারের উপযোগী বস্তুসমূহের আনুষ্ঠানিক পবিত্রীকরণের প্রয়োজনে সেখানে সূক্তগুলিতে সেই সব বস্তু উল্লিখিত হয়েছে, জনসাধারণের স্মৃতিতে তাদের ওপর অলৌকিক মহিমা আরোপ করার একমাত্র উপায়ই ছিল শ্লোক রচনার প্রচলিত আঙ্গিক। নিরীক্ষর সমাজে যেহেতু সমস্তই মৌখিকভাবে রচিত ও সংরক্ষিত হ’ত, তাই একমাত্র শ্লোকের আঙ্গিকই। কোনও রচনাকে স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারত। সাহিত্যগতভাবে সংরক্ষণযোগ্য সমস্ত কিছুই যেহেতু শুধু পদ্যেই রচিত হতে পারত, কারণ প্রাক-লেখন যুগে ছন্দোবদ্ধ রচনাই কণ্ঠস্থ করা সহজ ছিল, তাই বিশুদ্ধ কাব্যের তুলনায় তার ক্ষেত্র ব্যাপকতর ছিল। বস্তুত, সংহিতার বহু অংশ প্রাথমিকভাবে কাব্যিক রচনা নয়, আনুষ্ঠানিক কারণে কণ্ঠস্থ করার সহায়ক ; তাই বহু স্থানেই আমরা প্ৰকৃত কাব্য খুঁজে পাই না, এমনকি প্ৰত্যাশাও করি না। তাছাড়া চারণ কবিদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথাও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। লুই হ্রেনু যেমন বলেছেন ; বিভিন্ন পুরোহিত পরিবারের প্রতি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা একটি সামাজিক রীতি ছিল, তাই কার্যকরী ও শক্তিশালী সূক্ত রচনার জন্য পুরোহিতরা পরস্পর প্রতিস্পর্ধায় প্রবৃত্ত হতেন। নিঃসন্দেহে প্রেরণাই কাব্যচর্চার প্রধান উৎস ছিল, কিন্তু সে প্রেরণা গীতিকবি কিংবা মহাকাব্যিক চারণ কবি কী গীতিকার রচয়িতার বিমূর্ত ও নিরাসক্ত কাব্যরচনার সমগোত্রীয় নয়। পুরোহিতরা যখন সচেতনভাবে অনুষ্ঠান উপযোগী শ্লোক রচনার চেষ্টা করতেন তখন বহু স্বতঃস্ফুর্ত গীতিকবিতাই আনুষ্ঠানিক প্রয়োগের জন্য গ্ৰহণ করা হত। কবিরা সম্ভবত তাঁদের রচনার এই জাতীয় প্রয়োগ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে যজ্ঞের প্রয়োজনে তৎকালীন সামাজিক দাবি ও আকঙ্খা পূরণ করার চেষ্টা করতেন।

ঋগ্বেদের বহু অংশেই গীতিকা বা আখ্যান কাব্যের লক্ষণযুক্ত রচনা পাওয়া যায়, চরিত্রগতভাবে ধর্মীয় আবেদনযুক্ত মৌখিক সাহিত্যের পক্ষে তা-ই স্বাভাবিক। যুদ্ধগীতি, অলৌকিক আখ্যান ও প্রত্নকথা, প্ৰহেলিকা, রহস্যপূর্ণ এবং বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ স্বাভাবিকভাবেই বিবৃতিধর্মী আখ্যানকাব্যের উপযোগী আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছিল। ফলে যদিও ঋগ্বেদের অধিকাংশ রচনা ধর্মীয় চেতনা থেকেই হয়েছে এবং চরিত্রগতভাবে এগুলি অনুষ্ঠানকেন্দ্ৰিক, তবু বহু সূক্ত আঙ্গিকের দিক থেকে আখ্যানকাব্যের সঙ্গে গভীর সাদৃশ্যের চিহ্ন বহন করে। বস্তুত, কাব্য হিসাবে ঋথেদের বহু সূক্তই মানবিক আবেগের উত্তাপে আতপ্ত, কোথাও বা এগুলি আড়ম্বরপূর্ণ ও রহস্য-দ্যোতক ভাবনা উপস্থাপিত করে ; সেই সঙ্গে এগুলি সমুন্নত আদর্শ, স্পষ্ট বর্ণনা ও বিচিত্ৰ ভাবাবেগের কাব্যিক অভিব্যক্তি।