কবি – ২১ (শেষ)

কবি – ২১ (শেষ)

ঝুমুরের দল ধরিল দেশের পথ।
নিতাই কোন পথে কোথায় যাইবে তাহা ঠিক করে নাই, তবে ওই দলটির সঙ্গে থাকিবে না তাহা ঠিক, সেই কারণে দলের বন্ধন কাটাইবার অন্য একটা পথ ধরিল। কাটোয়া হইতে ছোট লাইন ধরিয়া ইহারা চলিল মল্লারপুরের দিকে। নিতাই বড় লাইন ধরিয়া উত্তর মুখে চলিল। শেষ মুহূর্তে ঠিক করিয়া ফেলিল সে কাশী যাইবে।
নির্মলা অনেকখানি কাঁদিল। মেয়েটা তাহকে দাদা বলিত। দাদা বলিয়া নিতাইয়ের জন্য কাঁদিতে তাহার সঙ্কোচের কোন কারণ ছিল না।
শেষ মুহূর্তে ললিতাও কাঁদিল। বলিল—জামাই, সত্যিই ছাড়লে!
প্রৌঢ়া বর্তমানের আশা ছাড়িয়াও কিন্তু ভবিষ্যতের আশা ছাড়ে নাই। সে বলিল—চিরকাল তো মামুষের মন বিবাগী হয়ে থাকে না বাবা। মন একদিন ফিরবে, আবার চোখে রঙ ধরবে। ফিরেও আসবে। তখন যেন মাসীকে ভুলো না। আমার দলেই এসো।
বেহালাদার স্নান হাসি হাসিয়া বলিল—আচ্ছা।
মহিষের মত লোকটাও কথা বলিল—চললে? তা— খানিকটা চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিল—সন্নাসী হওয়ার কষ্ট অনেক হে। ভিখ্‌ করে পেট ভরে না—তা নইলে—বেশ, এস তা হ’লে।
তাহারা যাইবে ছোট লাইনের ট্রেনে—যে লাইনের উপর নিতাইয়ের নিজের বাড়ী। ওই লাইনের ট্রেনেই নিতাই আসিয়াছিল—গ্রাম ছাড়িয়া। সেই ছোট গাড়ীতেই চড়িয়া মাসী বলিল—এস বাবা, এই গাড়ীতেই চড়। এই নাইনেই তো বাড়ী ৷ মন খারাপ হয়েছে—বাড়ী ফিরে চল বাবা।
বাড়ী! নিতাই চমকিয়া উঠিল। বাড়ী! স্টেশন! সেই কৃষ্ণচূড়ার গাছ! সেই রেল লাইনের বাঁক! সেই স্বর্ণশীর্ষবিন্দু কাশফুল! সোনার বরণ ঝকঝকে ঘটি মাথায় ক্ষার-ধোওয়া মোট খাটো কাপড় পরা অতি কোমল কালো মেয়েটি! সেই তাহার ঠাকুরঝি। ঠাকুরঝি।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়িয়া গেল সেই কতকালের পুরানো গান—
“কালো যদি মন তবে কেশ পাকিলে কঁদি কেনে?
কালো চুলে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?”
নিতাইয়ের মুখে হাসির রেখা দেখা দিল। অদ্ভুত হাসি। কত কথা মনে পড়িতেছে, কত কথা—কত পুরানো গান!
তবুও নিতাই বার বার ঘাড় নাড়িয়া নীরবেই জানাইল—না। না। না। না।
তাহার মনের মধ্যে সেই গানের কলি গুঞ্জন করিতেছিল—“চাঁদ তুমি আকাশে থাক।” মনে ঘুরিতেছিল—“তাই চলেছি দেশান্তরে—”—সে আবার একবার ঘাড় নাড়িয়া জানাইল— না। ঠাকুরঝি এতদিনে ভাল হইয়াছে, ঘরসংসার করিতেছে। সে গিয়া আর নূতন অশান্তির সৃষ্টি করিবে না। না। না সে যাইবে না। সে যাইবে না।
নিতাই নীরবেই বিদায় লইল। এই বিদায় তাহার শোকাচ্ছন্ন মনকে আরও উদাস করিয়া তুলিল। দলের প্রত্যেক জনটির মুখ তাহার চোখের সম্মুখে ক্ষণে ক্ষণে জাগিয়া উঠিতেছিল— বিদায়-ব্যথা-কাতর ম্লান মুখ। কাহারও সহিত কোনদিন তাহার ঝগড়া হয় নাই কিন্তু তাহারা যে এত ভাল—এ কথা আজিকার দিনের এই মুহূর্তটির আগে কোনদিন কোন একটিবারের জন্যও মনে হয় নাই। বরং সে সময় তাহদের দোষগুলাই অনেক বড় হইয়া তাহার চোথে পড়িয়াছে। মাসীকে দেখিয়া মনে হইত মুখে মিষ্টি কথা বলিলেও সমস্ত অন্তরটা বিষে ভরা, মিথ্যা ছাড়া সত্য বলিতে জানে না। পৃথিবীতে খাদ্য এবং অর্থ ছাড়া আর কিছুকে ভালবাসে না মাসী। আজ মনে হইল—না, না, মাসী—মাসীরই মত, ময়েরই মত ভালবাসিত তাহাকে। তাহার চোখের ওই কয় ফোঁটা জল বসন্তের মরণকালের ভগবানের নামের মতই সত্য।
নির্মলা চিরদিন ভাল। মায়ের পেটের বোনের মতই ভাল।
ললিতার চোখা চোখা ঠাট্টাগুলি—শ্যালিকার মুখের ঠাট্টার মতই মিষ্ট ছিল।
বেহালাদারের কথা মনে করিয়া তাহার চোখে জল আসিল। কানের কাছে বাজিয়া উঠিল সেই সুর।
সেই সুরটাই ভাঁজিতে ভাঁজিতে সে ফিরিয়া বসিল গঙ্গার ঘাটে। গঙ্গায় স্নান করিয়া সে মনে মনে একখানি গঙ্গা স্তব রচনা করিবার চেষ্টা করিল ৷ হইল না। ঘাটের উপরেই একটা গাছের তলায় আসিয়া সে বসিল। কিন্তু কোথায় সে যাইবে? পথে পথে ভিক্ষা করিয়া ফিরিবে বাউল দরবেশের মত? না। এ কল্পনা তাহার ভাল লাগিল না। তবে? কি বা করিবে— কোথায়ই বা যাইবে? হঠাৎ তাহার মনে হইল—হায় হায় হায়, হায় রে পোড়া মন! এই কথা কি ভাবিতে হয়? ঠাকুর, ঠাকুরের কাছেই যাইবে সে! গোবিন্দ। বিশ্বনাথ! প্রভু, প্রভুর কাছে যাইবে সে! মায়ের কাছে যাইবে! মা অন্নপূর্ণা। রাধারাণী রাধারাণী রাধারাণী! সে সেই সব দেবতার দরবারে বসিয়া গান গাহিবে—মহিমা কীর্তন করিবে—ভগবানকে গান শুনাইবে—শ্লোতারা শুনিয়া চোখের জল ফেলিবে—সঙ্গে সঙ্গে তাহাকেও কিছু কিছু দিয়া যাইবে—তাহাতেই তাহার দিন গুজরান হইবে। তাহার ভাবনা কি? হায় রে পোড়া মন—এতক্ষণ তুমি এই কথাটাই ভাবিয়া পাইতেছিলে না? এখান হইতে কাশী, বাবা বিশ্বনাথ—মা অন্নপূর্ণা। কাশী হইতে অযোধ্যা, সীতারাম–সীতারাম! সীতারামের রাজ্য হইতে রাধাগোবিন্দ, রাধরাণী—রাধারাণীর রাজ্য বৃন্দাবন।
তারপর মথুরা—না, না, মথুরা সে যাইবে না। রাধারাণীকে কাঁদাইয়া রাজ্যলোভী শ্যাম রাজা হইয়াছে সেখানে, সে রাজ্যে নিতাই যাইবে না। মধুরা হইতে বরং কুরুক্ষেত্র–হরিদ্বার।
হরিদ্বারের পরেই হিমালয়—পাহাড় আর পাহাড়। ছেলেবেলায় পড়া ভূগোল মনে পড়িল— পৃথিবীর মধ্যে এত উচু পাহাড় আর নাই—হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ গৌরীশঙ্কর। হিমালয়ের মধ্যেই মানস-সরোবর। সেখান পর্যন্তও নাকি মানুষ যায়। নিতাই মানস-সরোবরে স্নান করিবে। তারপর জনশূন্য হিমালয়ের কোখাও একটা আশ্রয় বানাইয়া সেইখানেই থাকিয়া যাইবে। নিত্য নূতন গান রচনা করিবে—গাহিবে, পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া খুদিয়া লিথিয় রাখিবে। সে মরিয়া যাইবে—তাহার পর যাহার সে-পথ দিয়া যাইবে তাহারা সে গান পড়িবে আর মনে মনে নিতাই-কবিকে নমস্কার করিবে।
শেষ বৈশাখের দ্বিপ্রহর। আগুনের মত তপ্ত ঝড়োহাওয়া গঙ্গার বালি উড়াইয়া হু হু করিয়া বহিয়া চলিয়াছে। দুই পায়ের শস্যহীন চরভূমি ধূসরবর্ণ-যেন ধুধু করিতেছে। মানুষ নাই, জন নাই; কেবল দুই-চারিটি চিল আকাশে উড়িতেছে—তাহারাও যেন কোথায় কোন দূরদুরন্তরে চলিয়াছে। সব শূন্য—সব উদাস—সব স্তব্ধ—একটা অসীম বৈরাগ্য যেন সমস্ত পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। নিতাই সেই অগ্নিগৰ্ভ রৌদ্রের মধ্যেই বাহির হইয়া পড়িল। “চলো মুসাফের বাঁধো গাঁঠোরী—বহুদূর যানা হোগা।” কাশী! সে স্টেশনে ফিরিয়া বড় লাইনে কাশীর টিকিট কাটিয়া ট্রেনে চড়িল।
নিতাই আসিয়া উঠিল কাশীতে।
ব্রিজের উপর ট্রেনের জানাল দিয়া কাশীর দিকে চাহিয়াই সে মুগ্ধ হইয়া গেল। বাঁকা চাঁদের ফালির মত গঙ্গার সাদা জল ঝক্‌ঝক্ করিতেছে—সমস্ত কোল জুড়িয়া মন্দির, মন্দির আর ঘাট, আরও কত বড় বড় বাড়ী। নিতাইয়ের মনে হইল মা-গঙ্গা যেন চোখঝলসানো পাকা বাড়ীর কণ্ঠি গাঁথিয়া গলায় পরিয়াছেন। ট্রেনের যাত্রীরা কলরব তুলিতেছে—জয় বাবা বিশ্বনাথ —অন্নপূর্ণামায়ী কি জয়!
সেও তাহদের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে নিজের কণ্ঠস্বর মিশাইয়া দিল। জয়ধ্বনির স্বরের সঙ্গে সুর মিশাইয়া দিল। জয় বাবা বিশ্বনাথ! অন্নপূর্ণামায়ী কি জয়!
স্টেশনে নামিয়া কিন্তু অকস্মাৎ একসময় তাহার মনের ছন্দ কাটিয়া গেল। সে যেন হুঁচোট খাইয়া দাঁড়াইয়া গেল। সে বিব্রত এবং বিহ্বল হয়ে অনুভব করিল সে কোন বিদেশে আসিয়া পড়িয়াছে!
বাংলা দেশের শেষ হইতেই সে একটা অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিতেছিল। ট্রেনে ক্রমশই ভিন্নভাষাভাষী ভিন্ন বেশভূষায় ভূষিত লোকের ভিড় বাড়িতেছিল। কাশীতে নামিয়াই সে ভিন্ন ধরণের মামুষের মেলার মধ্যে মিশিয়া গিয়া এক সময় প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করিল যে, এখানকার মানুষের জীবনের ছন্দের সঙ্গে তাহার জীবনের ছন্দ কোনখানে মিলিতেছে না। তাহার উপর কাশী-কাশী-কাশী—তাহার কল্পনার কাশী কোথায়? সে তো এই দোকানদানিভরা বিকিকিনির কোলাহলে মুখর এই নগরীটি নয়! কোথায় সেই বিশ্বনাথের কাশী?
বিহ্বলের মতই সে দাঁড়াইয়া রহিল।
বিহ্বলের মত চারিদিকে চাহিতে চাহিতে এক পথ হইতে অন্য পথে চলিতেছিল। কতক্ষণ চলিয়াছিল তাহার ঠিক ছিল না। অবশেষে একখানা এক্কায় উঠিয়া সে এক্কাওয়ালাকে কোনমতে বুঝাইল যে সে বিশ্বনাথের মন্দিরে যাইবে। এক্কাওয়ালাই তাহাকে একটা চৌরাস্তায় নামাইয়া দিয়া বলিল—এই দিকে যাও! সেই পথে কয়েক পা অগ্রসর হইয়া অকস্মাৎ তাহার মুখ চোখ আনন্দে প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। পূজার থালা হাতে ধপধপে সাদা খান পরিয়া একটি মহিলা যাইতেছিলেন। সে আনন্দে অধীর হইয় তাহার দিকে আগাইয়া গেল। তাহার মনে হইল—এ যে তাহাদের গ্রামের সেই রাঙা মা-ঠাকুরুণ। হ্যাঁ-তিনিই তো! তেমনি ঝলমলে সন্ত্রম-ভরা ভঙ্গিতে কাপড় পরিয়াছেন, মাথায় তেমনি আধ-ঘোমটা, মাথার চুলগুলি তেমনি ছোট করিয়া ছাঁটা—অবিকল তিনি। হারাইয়া-যাওয়া ছেলে যেন মাকে খুঁজিয়া পাইয়াছে এমনিভাবেই নিতাই আশ্বস্ত এবং উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। ছুটিয়া আসিয়া সে তাঁহার আগে গিয়া জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল।
না, রাঙা মা-ঠাক্‌রুণ নন, তবে ঠিক রাঙামায়ের মতই। ইনি যে তাহদের দেশের অন্য কোন গ্রামের আর কোন রাঙামা—তাহাতে নিতাইয়ের আর সন্দেহ রহিল না। এবং সত্যসত্যই সে হিসাবে তাহার ভুল হইল না –তিনি বাঙালী বিধবা এবং যাঁহারা গ্রামে মা-ঠাক্‌রুণ হইয়া দাঁড়ান তাহদেরই একজন বটেন। পতিপুত্রহীন বাঙালী বিধবা কাশীতে বিশ্বনাথকে আশ্রয় করিয়া মণিকর্ণিকার ঘাটের দিকে তাকাইয়া আছেন। জীবনের বোঝা নামাইবেন সেইখানে। মন্দিরে পূজা সারিয়া তিনি বাড়ী ফিরিতেছিলেন। নিতাই আসিয়া হাত জোড় করিয়া বলিল—মা-ঠাক্‌রুণ!
তিনি থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। প্রথমে ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। নিতাইয়ের দিকে চাহিয়া দেখিয়া প্রসন্ন হইয়া বলিলেন—কে তুমি বাবা?
নিতাই গড় হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল—আজ্ঞে মা, আমি এখানে বড় ‘বেপদে’ পড়েছি।
‘বেপদ’ শব্দটি তাহাকে সকল বিপদ হইতে রক্ষা করিল। শব্দটি শুনিয়া তিনি বুঝিলেন লোকটি পল্লীর মানুষ এবং একেবারে নূতন এখানে আসিয়াছে।
তিনি প্রসন্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন—কি বিপদ বাবা?
—আমি এখানকার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না মা! তার ওপর গরীব নোক’, আশ্রয় নাই; নতুন এসেছি।
হাসিয়া তিনি বলিলেন—বুঝেছি এস, আমার সঙ্গে এস। স্টেশন থেকে আসছ বুঝি?
—হ্যাঁ মা! পথে পথে নিতাই যেন বাঁচিয়া গেল।
তাহার এই নূতন মা–তাঁহাকে সে নূতন মাই বলিল; তিনি নিতাইকে নিজের বাসায় লইয়া গেলেন। মানুষটি বড় ভাল।
নিতাই মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। ভাগ্যবিধাতাকে বলিল—প্রভু, তোমার মত দয়াল আর হয় না। অধমের ওপর দয়ার তোমার শেষ নাই। নইলে এমন বিদেশে বিভূরে এসেও মা যশোদার মত মায়ের আশ্রয় পেলাম কি ক’রে?
এই নূতন মা তাহাকে নিজের বাসায় লইয়া গেলেন। কোন এক আদিঅন্তহীন আঁকাবঁকা গলির ভিতর তার বাসা—একখানি ঘর, এক টুকরা বারান্দা। আর রান্না করিবার জন্য ছোট আর একটা বারান্দার একটা কোণ। নিতাই সঙ্কুচিত হইয়া বলিল—আমি বরং বাড়ীর বাইরে বসি। জাতে আমি বড় নীচু।
—কেন বাবা? এই বারান্দায় ব’স। হ’লেই বা নীচু জাত।
নিতাইয়ের চোখে জল আসিয়া গেল। সত্যই মা যশোদা। বৃন্দাবনের মায়েরা—যশোমতীর দেশের মায়েরা কেমন মা তাহা সে জানে না, কিন্তু তাহার দেশের মায়ের ছাড়া যশোদার মত মা অন্য কোন দেশে আছে বলিয়া তাহার মনে হয় না। সে দেখিয়াছে এই দেশের কত লোক —হিন্দুস্থানী কথা যাহারা বলে—তাহারা তাহাদের দেশে যায়–অনায়াসে এক বৎসর, দুই বৎসর এক নাগাড়ে কাটাইয়া দেয়, কই মাকে দেখিবার জন্য তো তাহারা ছুটিয়া যায় না! মায়েরাও নিশ্চয় দেশে দিব্য থাকে! যে যশোদা গোপালকে এক বেলার জন্য গোষ্ঠে পাঠাইরা কাঁদিতে বসিতেন, সে যশোদার মত মা তাহারা কি করিয়া হইবে? তা ছাড়া এমন মিষ্ট কথা—আহা-হা-রে —মা গো মা! না—কি বাবা গোপাল! এমন ডাক—এমন সাড়া— আর কোথায় মেলে?
মা তাহাকে একে একে কত কথা জিজ্ঞাসা করিলেন—কি নাম, কোথা ঘর, কোথা পোস্টাপিস, কোন্‌ জেলা? অবশেষে জিজ্ঞাসা করিলেনা, বাড়ীতে কে কে আছে বাবা? মা, ভাই, বিয়ে করনি বাবা? নিতাইয়ের মনে পড়িয়া গেল ঠাকুরঝিকে, মনে পড়িয়া গেল বসন্তকে। সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—না।
নূতন মা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন—তোমাদের গ্রামে কত ঘর ব্রাহ্মণ— কত ঘর কোন জাত আছে বাবা মাণিক? তোমাদের কোন স্টেশন? তোমাদের ওদিকে গেল বার ধান কেমন হয়েছিল বাবা? ধান ছাড়া আর কোন ফসল হয়? বর্ষা কেমন হয় বাবা? বাদলা হয় ঘন-ঘন?
মায়ের চোখ দুইটি স্বপ্নাতুর হইয়া উঠিল।
—বর্যায় কাদা কেমন হয় বাবা? তোমাদের দেশের ভাবের গাছ বেশী, না তালের গাছ বেশী? ডাবের দর কি রকম? মাছ কেমন—কোন মাছ বেশী? তোমাদের দেশের মুড়ি কেমন হয় বাবা?
নিতাই একে একে জবাব দিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাহারও মনে ভাসিয়া উঠতে লাগিল এক একটি ছবি।
–তোমাদের গ্রামের কাছে নদী আছে বাবা? বড় দীঘি আছে গ্রামে? আঃ, কতদিন দীঘির জলে স্নান করি নাই! দীঘিতে পদ্মফুল ফোটে? শালুক সব গ্রামেই আছে। নীল শালুক আছে বাবা তোমাদের গ্রামে? কলমীশুশুনীর শাক হয় বাবা?
মধ্যে মধ্যে প্রশ্ন ফুরাইয়া যায়। মা চুপ করিয়া থাকেন উদাস মনে। বোধ হয়, তাহারও মনে পড়ে দেশের কথা। আবার হঠাৎ মনে পড়ে কোন একটা নূতন কথা, সেইটার পিছনে পিছনে আসিয়া দাঁড়ায় আবার এক বাক প্রশ্ন।
—তোমাদের ওদিকে সজনের ডাঁটা হয়? ‘নজনে’ আছে? পানের বরজ আছে? কেয়া-র গাছ আছে তোমাদের গ্রামে, সাপ থাকে গোড়ায়? গোখরো কেউটে সাপ খুব বেশী ওদিকে, না? নদীর ধারে শামুকভাঙা কেউটে থাকে? গাঙ-শালিক আছে। বউ কথা কও পার্থী আছে? থাকবেই তো। ‘চোখ গেল’ অনেক আছে, না? ‘কৃষ্ণ কোথা রে’ পাখী? অনেকে বলে গেরস্তের খোকা হোক, গায়ের রঙ হলুদ, মাথাটি কালো, ঠোঁটটি লাল টুকটুকে, আমরা বলি—‘কৃষ্ণ কোথা রে’ পাখী। বেনে বউও বলি—আছে?
হঠাৎ মায়ের চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। তিনি চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন কিছুক্ষণ। দেখিতে দেখিতে ফোঁটা দুই জল যেন আপনা-আপনি চোখ কাটিয়া বাহির হইয়া টপ টপ করিয়া ঋরিয়া পড়িল।
নিতাই কোন প্রশ্ন করিতে সাহস করিল না। কিন্তু ‘কৃষ্ণ কোথা রে’ পাখীর কথা জিজ্ঞাসা করিতে গিয়া চোখে জল আসিল দেখিয়া তাহার মনে হইল—বোধহয় তাহার কৃষ্ণও কোথায় চলিয়া গিয়াছে।
মা বলিলেন—মা যশোদা গোপালের জন্য কাঁদছিলেন আর হলুদ বাটছিলেন। বাটা হলুদ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই গড়লেন এক পাখী। সেই পাখীর মাথায় ঝরে পড়ল-তাঁর চোখের এক ফোট জল! সেই জলের তাপে পুড়ে তার মাথাটি হয়ে গেল কালো—আর জলের সঙ্গে ছিল যে চোখের রক্ত, সেই রক্তে তার ঠোঁট হয়ে গেল লাল। পাখীটিকে ছেড়ে দিয়ে বললেন–পাখী, তুই দেখে আয় আমার কৃষ্ণ কোথায়। পাখী ডেকে ডেকে ফিরতে লাগল—‘কৃষ্ণ কোথা রে?’ ‘কৃষ্ণ কোথা রে?’ চিরকাল সে ডেকেই ফিরছে।
নিতাইয়ের চোখ দিয়াও জল ঝরিতে আরম্ভ করিল।
মা বলিলেন—আমার কৃষ্ণও চলে গেছে বাবা। ব্রহ্মাণ্ডেও আর কেউ নেই। তাই এসেছি বাবার চরণে। নইলে দেশ ছেড়ে— অর্ধপথেই থামিয়া মা চোখ মুছিলেন। আবার প্রশ্ন করিলেন—তুমি কাশী এসেছ তীর্থ করতে? এই বয়সে তীৰ্থ? কিছু মনে ক’রো না বাবা— তোমাদের জাতের কেউ তো এমন ভাবে আসে না! তাই জিজ্ঞাসা করছি।
হাত দুটি জোড় করিয়া নিতাই বলিল–পূর্বজন্মের কর্মফল—হয়তো আমার কর্মফের, নইলে— নিতাই কথাটা শেষ না করিয়াই চুপ করিল। মা জিজ্ঞাসা করিলেন–কি বলছিলে বাবা?
নিতাই একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—আপনার কাছে লুকোব না মা। আমার বাবা, দাদা, ভাই, মামা, মেসো এরা সব চুরি-ডাকাতি করত। জেলও খাটত। সেই বংশে আমার জন্ম মা। আমি—বলিয়া সে থামিয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত পরে সে আবার বলিল—বলিতে সে বোধহয় সঙ্কোচ অনুভব করিতেছিল, সসঙ্কোচেই বলিল— দেশে কবিগান শুনেছেন মা? দুই কবিয়ালে মুখে মুখে গান বেঁধে পাল্লা দিয়ে গান করে?
—শুনেছি বইকি বাবা। কত শুনেছি। আমাদের গায়ে নবান্নের সময় বারোয়ারী অন্নপূর্ণা পূজো হত। কবিগান হ’ত পূজোয়। দুর্গাপূজোয় হ’ত যাত্রাগানা, কৃষ্ণযাত্রা–শখের যাত্র। নীলকণ্ঠের গান—“সাধে কি তোর গোপালে চাই গো? শোন যশোদে!” সে সব গান কি ভুলবার। মনসার ভাসান গান হ’ত মনসাপূজোয়। চব্বিশ প্রহরের সময় কীর্তন হ’ত! বাউল বৈরেগীরা খঞ্জনী একতারা নিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষে করত—“আমি যদি আমার হতাম কুড়িয়ে পেতাম হেমের ঘড়া ” আহা-হা! বাবা সেই কীর্তন-গানে শুনেছিলাম— “অমিয় মথিয়া কেবা লাবনি তুলিল গো তাহাতে গড়িল গোরাদেহ”–গোরাচাঁদের দেহ অমৃত ছেঁকে তৈরী হয়েছে। এ সব গান যে অমৃত-ছাঁকা জিনিস বাবা। কবিগান শুনেছি বইকি!
চুপ করিয়া গেল। ইহার পর আর নিজেকে কবিয়াল বলিয়া পরিচয় দিতে সাহস হইল না।
বিধবাই জিজ্ঞাসা করিলেন—তুমি কি কবির দলে থাকতে বাবা? নিজে কবিগান করতে?
হাত জোড় করিয়া নিতাই বলিল—হ্যাঁ মা, অধম একজন কবিয়াল। তবে মা বড় দরের কবিয়াল আমি নই। আমি ঝুসুর দলের সঙ্গে থেকে গান করতাম।
—তা হোক না বাবা! কবিয়াল তো বটে। তা তীর্থ করতে বেরিয়েছ বুঝি?
একটু চুপ করিয়ু থাকিয়া নিতাই বলিল—আর ফিরব বলে বেরুই নাই মা। ইচ্ছে আছে ভগবানের দরবারে পথে পথে গান করব, তাতেই দিন কটা কেটে যাবে আমার।
বিধবা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন—তাতে তো তুমি মুখ পাবে না বাবা। তুমি কবিয়াল–গান গাইবে—লোককে আনন্দ দেবে, হাসাবে, কাঁদাবে, মেডেল পাবে, কত লোক কত প্রশংসা করবে—তবে তো তোমার আনন্দ হবে, মুখ হবে! বলিতে বলিতে তিনি হঠাৎ থামিয়া গেলেন।–সুখ সংসারে মেলে না বাবা। যদি মেলে, যদি বিশ্বনাথ দেন তো তোমার আপন কাজের মধ্যেই পাবে।
অপরাহ্লে সে মায়ের কাছ হইতে বিদায় হইল। ইহারই মধ্যে সে তাহার সকল কথাই বলিল। রাজার কথা, বিপ্ৰপদর কথা। এমন কি বসন্তের কখাও বলিল। বলিল না শুধু ঠাকুরঝির কথা। শুধু তাই নয়, তাহাকে সে গানও শুনাইল।
মায়ের বৃত্তান্তও সে সব জানিল। আপনার জন মায়ের কেউ নাই, একমাত্র সন্তানকে হারাইয়া মা এখানে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছেন। দেশ হইতে জ্ঞাতিরা যাহারা তাহার শ্বশুরের সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাইয়াছে, তাহারা মাসে দশটি করিয়া টাকা পাঠায়, তাও অনিয়মিত। মা হাসিয়া বলিলেন–পেটের জন্যে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয় না বাবা, লজ্জা হয়। আহার কমিয়ে আধপেট অভোস করলে এক মাসের থোরাকে দুমাস যায়। তার মধ্যে উপোস করতে পারলে —বিধবার উপেস তো অনেক।
নিতাই অধীর হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। ওঃ—সে মায়ের এই আধপেটা অন্নের ভুগি লইয়াছে! মা তাহাকে হাসিমুখে দিয়াছেন। ও:! সে বলিল—আমি এইবার উঠি মা! থাকলে আবার আসব।
নিতাই প্রণাম করিল, দূর হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়া বলিল—আপনি দু’পা পিছিয়ে যান মা। আমি ওই ঠাঁইটির ধুলো নেব।
মা বলিলেন—তুমি আমার পা ছুঁয়েই নাও বাবা। আমি তে চান করব এখুনি।
—না। নিতাই তাহার পা ছুঁইল না।
মা বলিলেন—অনেক সত্ৰ আছে; জায়গা মিলবে। আমার ঘর এই তো দেখছ—তা, ছাড়া এ বাড়ীতে আর দশজন থাকে। সবাই মেয়েছেলে এখানে—
নিতাই হাসিয়া বলিল—দেবতার দেখা খানিকক্ষণের জন্যই বটে মা। চিরকালের পুণ্যি তো আমার নয় মা অন্নপূর্ণা আপনি আমার সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা।
মা বলিলেন—তোমার কচি বয়স, তুমি কবিয়াল—তুমি দেশে ফিরে যাও বাবা। চমৎকার তোমার গলা। গানও তোমার ভাল। দেশে তোমার কদর হবে। এ তো বাংলা গানের দেশ নয় বাবা। অবিশ্যি গঙ্গার ঘাটে—ঘাট তো এথানে অনেক আর বাঙালীও অনেক— সেখানে বসে গান করলে অনেক শুনবার লোক পাবে—কিছু কিছু হয়তে পাবেও। কিন্তু সংসারে পেট চলাই তো সব নয় বাবা। একটু বিষন্ন হাসির সঙ্গে কথাটি শেষ করিলেন মা।
এই কথাটার নিতাই একটু ক্ষুণ্ণ হইল। এই লইয়া মা তাহাকে দুইবার কথাটা বলিলেন।
সন্ধ্যায় বিশ্বনাথের মন্দির-প্রাঙ্গণে আসিয়া মায়ের কথার সত্যতা কিন্তু সে অনুভব করিল। ঘটনাট ঘটিল এইরূপে। প্রাঙ্গণের এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া মন্দিরশীর্ষের ধ্বজ ও কলসের দিকে সে তাকাইয়া ছিল। সোনার পাত দিয়া মোড়া মন্দির। আকাশে ছিল পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নার ছটায় ঝলমল করিতেছিল।
চারিদিকে আরতি ও শৃঙ্গার-বেশ দর্শনার্থীর ভিড়। হাজার কণ্ঠে বিশ্বনাথের জয়ধ্বনি, সেই ধ্বনির সঙ্গে সে নিজের কণ্ঠও মিশাইয়া দিল—জয় বিশ্বনাথ!
তারপর সে মনে মনে গান রচনা আরম্ভ করিল—

“ভিখারী হয়েছে রাজা মন রে আমার দেখ রে নয়ন মেলে
সাতমহলা সোনার দেউল গড়েছে সে শ্মশান ফেলে।”

গুন্‌গুন্‌ করিয়া সুর ভাঁজিয়া গানখানি রচনা শেষ করিয়া সে গলা চড়াইয়া গান আরম্ভ করিল—আহা! প্রাণ ঢালিয়া সে গাহিতেছিল।
গান শেষ হইলে—অল্প কয়েকজন লোক, যাহারা শেষে আসিয়া জমিয়াছিল—তাহদের একজন তাহাকে কিছু বলিল—তাহার বক্তব্য সম্পূর্ণ বুঝিতে না পারিয়া নিতাই সবিনয়ে বলিল—কি বললেন প্রভু? আমি বুঝতে পারতা নাই।
একজন হাসিয়া বাংলায় বলিল—তুমি বুঝি সবে এসেছ দেশ থেকে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
—উনি বলছেন হিন্দী ভজন গাইতে। তোমার এমন মিষ্টি গল, তোমার কাছে হিন্দী ভজন শুনতে চাইছেন।
—হিন্দী ভজন? নিতাই জোড়হাতে বিনয় করিয়া বলিল-আজ্ঞে প্রভু, আমি তো হিন্দী ভজন জানি না।
বাঙ্গালীটি হিন্দী-ভাষী প্রশ্নকারী লোকটিকে যাহা বলিল, আন্দাজে নিতাই সেটা বুঝিল; বোধ হয় বলিল—হিন্দী ভজন ও জানে না।
জনতার অধিকাংশই এবার চলিয়া গেল। যেন তাহার মধ্যে উপেক্ষা ছিল বলিয়া নিতাইয়ের মনে হইল।

* * *

মন্দির হইতে সরাসরি আসিয়া সে গঙ্গার ঘাটে হাজির হইল।
চোখ তাহার জুড়াইয়া গেল! আহ, এ যে দিন-রাত্রি মেলা লাগিয়াই আছে। আর এ কি বিচিত্র মেলা! মা গঙ্গাকে সামনে রাখিয়া এ যেন ভবের খেলার হাট বসিয়া গিয়াছে! একদিকে মণিকর্ণিকা অন্যদিকে রাজা হরিশ্চন্দ্রের ঘাটে শ্মশানচুল্লী জ্বলিতেছে অবিরাম; ধ্বনি উঠিতেছে রাম-নাম সত্য হ্যায়। লোকে বলে এখানে যাহারা ভস্ম হইল তাহারা শিবলোকে চলিয়া গেল। শিবরাম! শিবরাম! শিবশম্ভূ! কি তাহার মনে হইল, দশাশ্বমেধ হইতে পথের জনকে শুধাইয়া শুধাইয়া আসিয়া উঠিল মণিকর্ণিকার ঘাটে। মণিকর্ণিকার ঘটে আসিয়া হঠাৎ সে পুটুলিটা খুলিয়া বাহির করিল একটা পিতলের আংটি। অংটিটা বসনের। বসনের এই একটিমাত্র স্মৃতিচিহ্ন তাহার কাছে আছে। সেইটিকে এই রাজা মণিকর্ণিকার ঘাটে গঙ্গার জলে ফেলিয়া দিবে। এই পুণ্যে বসনের সকল পাপ মুছিয়া যাক।
বসন তুমি স্বর্গে যাও।
কিন্তু ফেলিতে গিয়াও সে ফেলিতে পারিল না। হাত গুটাইয়া কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াইয়া থাকিয়া সে প্রায় ছুটিয়া পলাইয়া আসিল। বসনের আর কিছু নাই। শুধু এইটুকু! না— থাক এটুকু। থাক। তাহার জীবনের শেষ পর্যন্ত থাক। ওঃ! বসন দিন-দিন হারাইয়া যাইতেছে। কাশী আসিয়া অবধি বসনকে তাহার বোধ করি মনেই পড়ে নাই। স্বপ্নও দেখে নাই। কাটোয়ার ঘাটে বসিয়া সে চোখ বুজিলেই বসনকে দেখিয়াছিল। গান বাঁধিয়াছিল—

“মরণ তোমার হার হ’ল যে মনের কাছে!
ভাবলে যারে—কেড়ে নিলে—সে যে আমার মনেই আছে, মনেই আছে!”

কিন্তু কই? ওঃ! মনের কদমতলাও শুকাইতে শুরু করিয়াছে। বুসনের মুখটা পর্যন্ত ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। চোখ দুইটা তাহার জলে ভরিয়া উঠিল। মনের মধ্যে সেই গানটি আবার গুনগুন করিয়া উঠিল—

এই খেদ মোর মনে।
ভালবেসে মিটাল নাসাধ কুলাল না এ জীবনে।
হায়-জীবন এত ছোট কেনে—?
এ ভুবনে?

আংটিটা সে হাতের কড়ে আঙুলে পরিয়া ফিরিয়া আসিল। দশাশ্বমেধ ঘাটে আসিয়া বসিল। ধীরে ধীরে মনটা তাহার জুড়াইয়া আসিল। বড় ভাল স্থান এই দশাশ্বমেধ ঘাট। এত বড় তীর্থ আর হয় না। কত দেশের কত মানুষ। কত পাঠ। কত গান। কত দান। কত ভিক্ষা কত কামনা। কত দুঃখ। এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত ঘাটটা কত প্রশস্ত! মনে হইল—এই ভাল। বাকী দিনগুলা এই ঘাটে ঘাটে বাসা বাঁধিয়া গান গাহিয়া ভিক্ষা করিয়াই কাটাইয়া দিবে।
পরদিন অপরাহ্লে সামনে গামছা পাতিয়া ঘাটের এক পাশে বসিয়া সে গান ধরিয়া দিল—

এই খেদ মোর মনে।

কণ্ঠস্বর তাহার অতি মিষ্ট। লোক জমিল। পয়সাও কিছু পড়িল। কিন্তু গান শেষে একজন বলিল—কাশীতে এসে এ খেদ কেন হে ছোকরা?
একজন মহিলা বলিলেন—হ্যাঁ বাবা, ভাল গান গাও। মহাজনের পদ গাও। রামপ্রসাদের গান—কমলাকান্তের গান—এই সব গান।
সে এবার ধরিল—

“আমার কাশী যেতে মন কই সরে?
সর্বনাশী এলোকেশী—সে যে সঙ্গে সঙ্গে ফেরে!”

গান শেষ করিবার সঙ্গে সঙ্গে মন যেন তাহার বিকল হইয়া গেল। তাহার সমস্ত অন্যরটা এক গভীর বেদনার উদাসীনতায় ভরিয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িল গ্রামের মা চণ্ডীকে। রামপ্রসাদের এলোকেশীর মত মা চণ্ডী আজ এই কাশীতে আসিয়া তাহার আশেপাশে ফিরিতেছেন। মায়ের পিছু পিছু যেন বসন ফিরিতেছে; ঠাকুরঝি ফিরিতেছে; রাজন ফিরিতেছে। বিপ্ৰপদ ফিরিতেছে। মাসী বেহালাদার—ভিড় করিয়া ফিরিতেছে। কাশীর চেয়ে তাহার গ্রাম ভাল। কাশীতে জীবনের জন্য খেদ করিবার অধিকার নাই। কিন্তু জীবনের জন্য খেদ না করিয়া সে বাঁচিবে কি করিয়া? নিতাই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যা। এখানে এখন প্রচণ্ড গরম। ঘাটে ও ঘাটের উপর পথে দলে দলে লোক আসিতেছে যাইতেছে, আলাপ-আলোচনা চলিতেছে—কিন্তু সব কথাই যেন নিতাইয়ের নিকট হইতে বহুদূরের কথা বলিয়া মনে হইতেছে, স্বরধ্বনির রেশই কানে আসিতেছে, কিন্তু শব্দের অর্থের কথা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। কাছে থাকিয়াও মানুষগুলিও যেন অনেকদূরের মানুষ।
ভাল লাগিতেছে না। এ তাহার ভাল লাগিতেছে না। হোক কাশী; বিশ্বনাথের রাজত্ব; স্বর্গের সিংহ-দরজা, তবু তাহার ভাল লাগিতেছে না। ভিক্ষা তাহার ভাল লাগিতেছে না। মহাজনের পদ তাহার ভাল জানা নাই। আর নিজের গান ছাড়িয়া ওসব গান যত ভাল হোক গাহিয়া কাল কাটাইবার কল্পনাও করিতে পারে না সে। নিজের যেন ওরকম পদ ঠিক আসেও না। তাহার উপর, সে ভিক্ষা বৃত্তিতেও ঠিক আনন্দ পাইতেছে না। কোথায় আনন্দ। সে অন্তত পাইতেছে না। কবিগানের আসর। ঝলমলে আলো। হাজারে লোক। ভাল লাগিতেছে না তাহার।
মনে পড়িল মায়ের কথা কয়টি। কবিয়াল তুমি, দেশে ফিরে যাও। স্তব্ধ হইয়া অনেকক্ষণ সে বসিয়া রহিল। কতক্ষণ পরে—তাহার খেয়াল ছিল না—অকস্মাৎ সে অনুভব করিল জনকোলাহল স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। সচেতন হইয়া—চারিদিকে চাহিয়া দেখিল—লোকজন নাই; বোধ হয় যে যাহার ঘরে ফিরিয়া গিয়াছে। ঘাটের উপর দুই-চারিজন লোক ঘুমে অসাড় হইয়া পড়িয়া আছে। সেও ঘাটের উপর শুইয়া পড়িল। এই গভীর রাত্রে অচেনা শহরে পথ চিনিয়া যাওয়া সম্ভবপর হইবে না। আর কোথায়ই বা যাইবে? চারিদিক নিস্তব্ধ। কেবল ঘাটের নীচে গঙ্গাস্রোতের নিম্ন কলস্বর ধ্বনিত হইতেছে। সেই শবাই সে শুনিতে লাগিল। অপরিচয়ের পীড়ায় পীড়িত অস্বচ্ছন্দ তাহার মন অদ্ভূত কল্পনাপ্রবণ হইয়া উঠিয়াছিল —গঙ্গার স্রোতের শব্দ শুনিতে শুনিতেও নিতাইয়ের মনে হইল—গঙ্গাও যেন দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলিতেছে। কাটোয়ায়, নবদ্বীপেও তো সে গঙ্গার শব্দ শুনিয়াছে; কাটোয়ায়, যে-দিন বসন্তর দেহ পোড়াইয়াছিল, সে দিন তো গঙ্গা স্পষ্ট ভাষায় কথা বলিয়াছিল। এখানকার সবই কি দুর্বোধ্য ভাষায় কথা কয়?
আবার তাহার মায়ের কথা মনে পড়িল। সমস্ত দিনের মধ্যে পাখীর ডাক সে অনেক শুনিয়াছে, কিন্তু ‘বউ কথা কও’ বলিয়া তো তাহদের কেউ ডাকে নাই; ‘চোখ গেল’ বলিয়া তো কোন পাখী ডাকে নাই—’কৃষ্ণ কোথা রে’ বলিয়াও তো কোন পাখী কাঁদিয়া ফেরে নাই ” কাকের স্বর পর্যন্ত কেমন ভিন্ন রকম! মা তাহাকে যাহা বলিয়াছিলেন তাহাই সঠিক।
অকস্মাৎ তাহার মনে হইল—বিশ্বনাথ? বিশ্বনাথই যে এই রাজ্যের রাজা; তবে তিনিও কি—এই দেশেরই ভাষা বলেন? তাহার এই ভক্তদের মতই তবে কি তিনি তাহার কথা— তাহার বন্দনা বুঝিতে পারেন না? হিন্দী ভজন? হিন্দী ভজনেই কি তিনি বেশী খুশী হন? ‘মা অন্নপূর্ণা –তিনিও কি হিন্দী বলেন? ক্ষুধার সময় তিনি যদি নিতাইকে প্রশ্ন করেন— তবে কি ওই হিন্দীতে কথা বলিবেন? তবে? তবে? তবে সে কাহাকে গান শুনাইবে? আবার তাহার মনে পড়িল—তাহাদের গ্রামের ‘মা চণ্ডী’কে, সঙ্গে সঙ্গে ‘বুড়াশিব’কে। পাগলিনী ক্ষ্যাপা মা। ভাঙড় ভোলা!

“ওমা দিগম্বরী নাচ গো।”

সঙ্গে সঙ্গে বেহারার কাঁধে চড়িয়া ক্ষ্যাপী মা নাচে।

“হাড়ের মালা গলায় ভোলা নাচে থিয়া থিয়া।”

ভোলানাথ নাচে, তাহার সঙ্গে গাজনের ভক্তেরা নাচে। হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে লোক আশেপাশে যাহার দাঁড়াইয়া থাকে—তাহারাও মনে মনে নাচে। আবার সর্বনাশী এলোকেশীর মত মা চণ্ডী আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইলেন। তাঁহার সঙ্গে সবাই। সবাইকে মনে পড়িল।
প্রথমেই মনে পড়িল ঝুমুর দলটিকে—নির্মলা বোনকে মনে পড়িল—ললিতাকে মনে হইল, মাসী আসিয়া ‘বাবা’ বলিয়া তাহার চোথের সামনে দাঁড়াইল। বেহালাদার, দোহার, বাজনদার, রাজন, বণিক মাতুল, বিপ্ৰপদ ঠাকুর, সকলে দূরে যেন ভিড় জমাইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ঠাকুরঝিকে মনে পড়িল, কৃষ্ণচূড়ার গাছতলায় পথের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ওই যে! —গ্রামের ধারের নদী ও নদীর ধারে চরভূমিতে তরির চাষ, বিস্তীর্ণ মাঠ, বৈশাখে মাঠের ধূলা, কালবৈশাখীর ঝড়, কালো মেঘ, ঘনঘোর অন্ধকার, সেই চোখ ধাঁধানে বিদ্যুৎ—সেই কড়্‌ কড়্‌ শব্দে মেঘের ডাক —ঝর্‌ ঝর্‌ বৃষ্টি—সব মনে হইল। পূর্ণিমায় ধর্মরাজ-পূজার উৎসব। ঢাক শিঙা কাঁসির বাজনার সঙ্গে ফুলের মালা গলায় ভক্তদলের নাচ। গভীর রাত্রে বাগান হইতে ভক্তদলের ফল সংগ্রহ; কত কথা মনে পড়িল;–বাবুদের পুরানো বাগানে গাছের কোটরে অজগরের মত গোখরার বাস; গোখুরাগুলা ডালে ডালে বেড়ায়, দোল খায়; কিন্তু ভক্তের যখন ‘জয় ধৰ্মরঞ্জো’ বলিয়া রোল দিয়া গাছে চড়ে, তখন সেগুলা সন্তর্পণে কোথায় গিয়া লুকাইয় পড়ে। বাগানের সেই পুরানো বটগাছতলায় অরণ্যষষ্ঠীর দিন মেয়েদের সমারোহ মনে পড়িল। আল-পথ ধরিয়া বিচিত্র বর্ণের কাপড়চোপড় পর সারিবন্দী মেয়েদের যাওয়ার ছবি নিতাইয়ের চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল। আল-পথের দু’ধারে লকলকে ঘন-সবুজ বীজধানের ক্ষেত; মাঝখান দিয়া পথ। আষাঢ় আসিতেছে। আকাশে হয়তো ইহারই মধ্যে মেঘ দেখা দিয়াছে, শামলা রঙের জলভরা মেঘ। ভাবিতে ভাবিতে নিতাইয়ের ‘বার-মেসে’ গানের কথা মনে হইল।

বৈশাখে সুর্যের ছটা—
যত সূর্য-ছটা, কাটফাটা, তত ঘটী কালবৈশাখী মেঘে—
লক্ষ্মী মাপেন বীজ-ধান্ত চাষ-ক্ষেতের লেগে।,
পুণ্য ধরম মাসে–
পুণ্য—ধরম মাসে—ধরম আসে- পূর্ণিমাতে (সবে) পূজে ধৰ্মরাজায়—
আমার পরাণ কাঁদে, হায় রে বিধি কাঠের মতন বক্ষ ফেটে যায়।
তারপরে জ্যৈষ্ঠ আসে—
জ্যৈষ্ঠ এলে, বৃক্ষতলে, মেয়ের দলে অরণ্যষষ্ঠী পূজে।
জামাই আসে, কন্যা হাসে—সাজেন নানা সাজে।
দশহরায় চতুভূজা—
দশহরায় চতুভূজ গঙ্গা পূজা, এবার সোজা মাঠ ভাসিবে বস্তায়—’
আমার পরাণ কাঁদে, হায় রে বিধি— চোখের জলে বক্ষ ভেসে যায়।

এমনি করিয়া আষাঢ়ের রথযাত্রা–বর্ষার বাদল–অম্বুবাচীর লড়াই, শ্রাবণের রিমিঝিমি বর্ষণ মাথায় করিয়া ধানভরা ক্ষেত পার হইয়া সেই বাবাজীর আখড়ায় ঝুলন-উৎসব দেখার স্মৃতি হইতে চৈত্রের গাজন পর্যন্ত মনে করিয়া করিয়া সে এক নূতন বারমেসে গান মনের আবেগে রচনা করিয়া ফেলিল—

বছর শেষে-চৈত্র মাসে—
বছর শেষে চৈত্র মাসে, দিব্য হেসে বসেন এসে অন্নপূর্ণা পূজোর টাটে।
ভাণ্ডার পরিপূর্ণ, মাঠ শূন্য, তিল পুষ্প ফুটছে শুধু মাঠে—
তেল নাহি হ্যায় শিবের মাথায়, ভরল জটায়–অঙ্গেতে ছাই গাজনে ভূত নাচায়।
আমার পরাণ কাঁদে— হায় রে বিধি—পক্ষ মেলে উড়ে যেতে চায় ॥

অধীর হইয়া সে প্রভাতের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। বারবার এখানকার নূতন-মাকে মনে মনে উদ্দেশ করিয়া বলিল—তুমি আমাকে ছলনা করেছ মা! সেখানকার মা তুমি, আমাকে ফেরাবার জন্য আগে থেকে এখানে এসে বসে আছ? তোমার আজ্ঞা আমি মাথায় নিলাম। শিরোধার্য করলাম।

* * *

মাসখানেক কোনরকমে কাশীতে কাটাইয়া নিতাই আবার একদিন ট্রেনে চড়িয়া বসিল। কোন রকমেই সে ঐখানে থাকিতে পারিল না।
এই এক মাস সে ভাল করিয়া ঘুমায় নাই। তাহার সঙ্গে উৎকণ্ঠার, উদ্বেগের তাহার অবসান হইয়াছে। ঘুম যেন তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে। মোগলসরাই জংশনে কোনরূপে উঠিয়া ট্রেন পালটাইয়া নূতন গাড়ীতে উঠিয়া সে বাঁচিয়া গেল। ছাদের সঙ্গে ঝুলানো বেঞ্চগুলার একটা খালি ছিল, সেই বেঞ্চে উঠিয়াই সে শুইয়া পড়িল। আঃ-নিশ্চিন্ত! সোনার দেশে আপন মায়ের কোলে ফিরিয়া চলিয়াছে সে।
পরদিন সকালে যখন তাহার ঘুম ভাঙিল তখন মনে হইল অতি পরিচিত জন কেহ তাহাকে ডাকিতেছে। পরিচিত কেহ ভারি মিষ্টমুরে যেন তাহাকে ডাকিল—
–কে, কে? নিতাই ধড়, মড়, করিয়া উঠিয়া বসিল।
না, চেনা কেহ নয়, তাহাকে নয়। নীচের বেঞ্চে একজন লোক গোটা বেঞ্চটা জুড়িয়া শুইয়া আছে, তাহাকেই কতকগুলি নবাগত যাত্রী ডাকিতেছে—ওঠ—ওঠ।
নিতাই হাঁপ ছাড়িয়া বঁচিল। আঃ, গাড়ীটা চেনামূখে যেন ভরিয়া গিয়াছে। সব চেনা, সব চেনা! নিতাই তাড়াতাড়ি উপর হইতে নীচে নামিয়া—সবিনয়ে আগন্তুক যাত্রীদলের একজনকে বলিল—মালগুলো ওপরে তুলে দি?
—দাও তো দাদা, দাও তো।
—বেঁচে থাক বাবা; বড় ভাল ছেলে তুমি। এক বৃদ্ধ তাহাকে আশীৰ্বাদ করিল।
মালগুলা তুলিয়া দিয়া নিতাই জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিল। ইন্টিশানের বাহিরের দিকে চাহিয়া তাহার চোখ জুড়াইয়া গেল। সব চেনা—সব চেনা! আঃ–তবে তো দেশে আসিয়া পড়িয়াছে! জানালার বাহিরে বাংলা দেশ। সব চেনা। রাণীগঞ্জ পার হইল। এইবার বর্ধমান। বাহিরে আকাশে ঘন মেঘ করিয়াছে।
বর্ধমানে গাড়ী বদল করিয়া—ঘণ্টা দুয়েক মাত্র, তাহার পরই সে গ্রামে গিয়া পড়িবে। মা চণ্ডী, বুড়ে শিব!
মা চণ্ডী বুড়োশিবের দরবারে বসিয়াই সে ভগবানকে গান শুনাইবে। তীর্থে তীর্থে মেলায় মেলায়—তারকেশ্বরে—কালীঘাটে গিয়া গান শুনাইয়া আসিবে। দেশের জেলায় জেলায় ঘুরিয়া দেশের লোককে গান শুনাইয়া ফিরিবে। সে নিশ্চয় করিয়া জানে যে তাহাদের গান শুনাইয়া পরিতৃপ্ত করিতে পারিবে। সে এবার নিজেই কবির দল করিবে, এখন তাহার নাম হইয়াছে, বায়নার অভাব হইবে না। কবিয়াল নিতাইচরণের নামে দেশের লোকও ভাঙিয়া আসিবে। মেলা-খেলায় গালাগাল খেউড় নইলে চলে না। তাহার মধ্যেও কৌতুক আছে, তবু সে ভালবাসার গানকেই বড় করিবে। বসন্তকে হারাইয়া সে বুঝিতে পারিয়াছে সমস্ত পৃথিবী জুড়িয়া ওই একই খেদ। জীবন এত ছোট কেনে? ভালবাসিয়া সাধ কেন মেটে না, ছোট এতটুকু জীবনের পরিসরে ভালবাসিয়া কেন কুলায় না? ভালবাসার গান। খেদের গান। এই খেদ মোর মনে –সেই থেদের গান –বসন্তের নাম করিয়া গান ৷
কোকিল কি বসন্তকে ভুলিতে পারে?
এক্সপ্রেস ট্রেনটা থামিয়া গেল। একটা বড় স্টেশনে আসিয়া পড়িয়াছে। বর্ধমান! বর্ধমান!

* * * *

বর্ধমান হইতে লুপ লাইনের ট্রেন। নিতাই আবার সেই ট্রেনে চড়িয়া বসিল। মনে মনে তখন তাহার গান রচনা আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। গ্রামে পৌঁছিয়াই সে সর্বাগ্রে মা চণ্ডীর দরবারে যাইবে প্রণাম করিতে। সেই প্রণাম করিবার জন্য সে গান রচনা শুরু করিয়াছে। এই গান গাহিয়াই সে মাকে প্রণাম করিবে। জয়ন্তী মঙ্গলা কালী নয়, সে নিজের গান গাহিয়াই মলকে প্রণাম করিবে।

‘সাড়া দে মা—দে মা সাড়া,
ঘরপালানো ছেলে এলো—বেড়িয়ে বিদেশ-বিভূঁই পাড়া।
তোর সাড়া না পেলে পরে মা, কিছুতে যে মন ভরে না,
নাচ-দুয়ারে পা সরে না, চোখে বহে জলের ধারা ‘

আকাশ জুড়িয়া ঘন কালো মেঘ। হু-হু করিয়া ভিজা জলো বাতাস বহিতেছে। আঃ, দেহ জুড়াইয়া যাইতেছে। মাটির বুক আর দেখা যায় না; লকলকে কাঁচা ঘাসে ভরিয়া উঠিয়াছে। ও-ইহারই মধ্যে এদিকটায় বর্ষা নামিয়া গিয়াছে। চষা ক্ষেতগুলির কালে মাটি জলে ভিজিয়া আদরিণী মেয়ের মত তুলিয়া ধরিতে যেন গলিয়া পড়িতে চাহিতেছে। টেলিগ্রাফের খুঁটির উপর একটা ভিজা কাক পাখা দুটা অল্প বিছাইয়া দিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বসিয়া আছে, মনের আনন্দে ভিজিতেছে। কচি নতুন অশ্বত্থ-বট-শিরীষের পাতাগুলি ভিজা বাতাসে কাঁপিতেছে। লাইনের দুধারের ঝোপগুলিতে থোপা থোপা ভাঁট ফুল ফুটিয়াছে। আহা-হ! ওই দূরে নালার ধারে একটা কেয়া-ঝোপ বাতাসে দুলিতেছে। কেয়া-ঝোপটার বাহার খুলিয়াছে সব চেয়ে বেশী। সঙ্গে সঙ্গে আবার তাহার বসন্তকে মনে পড়িয়া গেল,

“করিল কে ভুল—হায় রে,
মন-মাতানো বাসে ভরে দিয়ে বুক
করাত কাটার ধারে ঘেরা কেয়া-ফুল!”

ঝমৃ-ঝম্ শব্দে ট্রেন চলিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও নামিয়াছে। মধ্যে মধ্যে মেঘের উপর ঘনাইয়া আসিতেছে সন্ধ্যাবেলার কাজলদীঘির জলের রঙের মত রঙ; বৃষ্টি জোর হইতেছে, অমনি চারিদিক ঝাপসা। ওঃ, এদিকটায় প্রচুর বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। মাঠ জলে থৈ থৈ করিতেছে। ব্যাঙের গ্যাঙোর গ্যাঙোর ডাক ট্রেনের শব্দকে ছাপাইয়াও কানে আসিতেছে। এদিকে কাড়ান লাগিয়া গেল।
ঘং-ঘং গম্গম্ শব্দে ট্রেনখানা ধ্রুপদ ধামারে গান ধরিয়া দিল। নদীর পুল! গেরুয়া রঙের জলে সাদা সাদা ফেনা ভাসিয়া চলিয়াছে। এপার হইতে ওপার পর্যন্ত লাল জল থৈ থৈ করিতেছে। জল ঘুরপাক খাইতেছে, আবার তীরের মত সোজা ছুটিয়া চলিয়াছে। দুপাশে কাশের ঝাড়, ঘন সবুজ। অজয়! অজয় নদী! দেশে আসিয়া পড়িয়াছে। দেশ, তাহার গাঁ! তাহার মা!

‘তোর সাড়া না পেলে পরে মা, কিছুতে যে মন ভরে না
চোখের পাতায় ঘুম ধরে না, বয়ে যায় মা জলের ধারা।‘

এইবার বোলপুর-তারপর কোপাই, তারপর, তারপর জংশন; ছোট লাইন। ঘটো-ঘটো ঘটো-ঘটো ঘং-ঘং ঘং-ঘং। সর্বাঙ্গে দুরন্ত দোলা দিয়া নাচাইয়া ছোট লাইনের গাড়ীর চলন; হায়-হায়-হায়-হায়! সঙ্গে সঙ্গে নিতাইয়ের বুকের ভিতর নাচিতেছে নিমাইয়ের মন। ছেলেমানুষের মত নাচিতেছে। চোখ ভাসাইরা জল আসিতেছে অজয়ের বানের মত। মাগো—মা, আমার মা। আমার গাঁ। ওই যে—সেই ‘নিমচের জোল’ ‘উদাসীর মাঠ’ – ওই সে কাশীর পুকুর; –ওই যে সেই কালী-বাগান—যে বাগানের গাছগুলি ছিল তাহার কবিজীবনের গানগুলির প্রথম শ্রোতার দল!
গাড়ীটা ঈষৎ বাঁকিল—ইস্টিশনে ঢুকিতেছে। ওই যে, ওই যে —গাড়ী থামিল।

ট্রেন চলিয়া গিয়াছে।
নিতাই দাঁড়াইয়া আছে। তাহার চারিদিকে বিস্মিত একটি জনতা। নিতাই এমনটি প্রত্যাশ করে নাই। এত স্নেহ, এত সমাদর তাহার জন্য সঞ্চিত হইয়া আছে এখানে? রাজার মুখে পর্যন্ত কথা নাই। বেনে মামা, দেবেন, কেষ্ট দাস, রামলাল, কয়েকজন ভদ্রলোক পর্যন্ত তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সম্মুখে সেই কৃষ্ণচূড়ার গাছটি। ফুলের সময় শেষ হইয়া আসিয়াছে, ঘন সবুজ চিরোল চিরোল পাতায় ভরিয়া উঠিয়াছে; তবু দুই-চারিটি ফুল যেন নিতাইয়ের জন্যই ধরিয়া আছে। নিতাইয়ের চোখে জলের ধারা। নিতাই কাঁদিতেছে; কাঁদিতেছে বিপ্ৰপদ ঠাকুরের মৃত্যুকে উপলক্ষ করিয়া। বিপ্ৰপদ ঠাকুর মরিয়া গিয়াছে।
বিপ্ৰপদর জন্য নিতাইয়ের কান্নায় সকলে বিস্মিত হইয়া গিয়াছে। কথাটা কৌতুকের কথা। কিন্তু নিতাইয়ের ওই নীরব বিগলিত অশ্রধারা এমন একটি অনুচ্ছ্বসিত প্রশান্ত মহিমায় মহিমাম্বিত হইয়া উঠিয়াছিল যে, তাহার কান্নাকে উপহাস করিবার উপায় ছিল না। নিতাইয়ের কবিয়ালির খ্যাতি দেশে সকলেই শুনিয়াছে, তাহার জন্য সকলে তাহাকে শ্রদ্ধা না হোক প্রশংসাও করে মনে মনে; কিন্তু এ তাহা নয়, তাহারও অতিরিক্ত কিছু। তাহার চোখের ওই দর-বিগলিত ধারার সেই মহিমাতেই নিতাই মহিমান্বিত হইয়া সকলের চেয়ে বড় হইয়া উঠিয়াছে। বিপ্ৰপদকে হারাইয়াই সে শুধু কাঁদে নাই, তাহাদের সকলকে ফিরিয়া পাইয়াও কাঁদিতেছে।

কতক্ষণ পর।
নিতাই আসিয়া বসিল সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। রাজাকে ডাকিয়া পাশে বসাইল। লাইন যেখানে বাঁকিয়াছে, দুটি লাইন যেখানে একটি বিন্দুতে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে মনে হয়, সেইখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিতাই বলিল—রাজন! ভাই!
—ওস্তাদ! ভেইয়া!
—ঠাকুরঝি?
—ওস্তাদ!
–রাজন!
–ঠাকুরঝি তো নাই ভাইয়া!
—নাই?
–নাই! উতো মর গেয়ি। রাজার মত শক্ত মানুষের ঠোঁট দুইটিও কাঁপিতে লাগিল। বলিল—ঠাকুরঝি ক্ষেপে গিয়েছিল ওস্তাদ। তোমার যাবার পরে—
রাজার চোখ হইতে জল পড়িতে আরম্ভ করিল। ঠাকুরঝি নাই। ঠাকুরঝি মরিয়াছে! পাগল হইয়া ঠাকুরঝি মরিয়াছে! এই কয়টা কথাই নিতাইয়ের কাছে অনেক কথার তুফান হইয়া উঠিল, বুকের মধ্যে ঝড় বহিল,চোখ ফাটিয়া জল আসিল। মনে পড়িল—জীবন এত ছোট কেনে? তাহাকে কাঁদিতে দেখিয়া রাজা বলিল—ওস্তাদ, ভাইয়া, রোতা হ্যায়? কাঁদছ? ঠাকুরঝির জন্যে? ‘
চোখ মুছিয়া, বিচিত্র হাসি হাসিয়া ফেলিয়া নিতাই বলিল—গান শোন রাজন, গান শোন। গুন গুন করিয়া ভাজিয়া লইয়াই সে গলা ছাড়িয়া গাহিল—

‘এই খেদ আমার মনে—
ভালবেসে মিটল না সাধ, কুলাল না এ জীবনে।
হায়-জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?’

রাজা তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল—হায় হায় হায় রে! বল ওস্তাদ, জীবন এত ছোট কেনে? হায় হায় হায়।
নিতাই বলিল—তাই যদি জানব রাজন! —আবার তাহার চোখ হইতে জল ঝরিতে শুরু হইল। আবার কাঁদিল। নিতাইয়ের চোখ হইতে আবার অনর্গল ধারায় জল পড়িতে আরম্ভ হইল।
কান্নার মধ্যেই আবার তাহার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল। না—ঠাকুরঝি মরে নাই, সে যে স্পষ্ট দেখিতেছে, ওই যেখানে রেলের লাইন দুটি একটি বিস্মৃত মিলিয়া বাঁকিয়া চলিয়া গিয়াছে দক্ষিণ মুখে নদী পার হইয়া, সেইখানে মাথায় সোনার টোপর দেওয়া একটি কাশ ফুল হিল-হিল করিয়া দুলিতেছে, আগাইয়া আসিতেছে যেন! সে আছে, আছে। এখানকার সমস্ত কিছুর সঙ্গে সে মিশিয়া আছে। এই কৃষ্ণচূড়ার গাছ। হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল—এইখানে বসন আসিয়া প্রথম দিন শুইয়া বলিয়াছিল—কই হে! ওস্তাদ না—ফোস্তাদ! চকিতের মত মনেও হইল— বসনও যেন শুইয়া আছে! আঃ! ঠাকুরঝি, বসন—দুইজনে যেন পাশাপাশি দাঁড়াইয়া আছে। মিশিয়া একাকার হইয়া যাইতেছে।
নিতাই উঠিল, বলিল—চল।
—কাঁহা ভাইয়া?
—চণ্ডীতলায়। চল, মাকে প্রণাম করে আসি।
রাজার মুখের দিকে চাহিয়। সে বলিল—গড়াগড়ি দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্ৰণিপাত করব মাকে।
তাহার সর্বাঙ্গ যেন এখানকার ধূলামাটির স্পর্শের জন্য লালায়িত হইয়া উঠিয়াছে। মায়ের দরবারে মাকে গিয়া শুধইবে—মাগো—জীবন এত ছোট কেনে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *